মে ১০, ২০২১ ১৯:৫১ Asia/Dhaka

গত কয়েক আসরে আমরা বলেছি, বদর অভিযানে ইরান কাঙ্ক্ষিত সবগুলো লক্ষ্য অর্জন করতে না পারলেও ইরানি যোদ্ধারা শত্রুকে হতচকিত করে দিয়ে তাদের রণকৌশল প্রদর্শন করতে সক্ষম হন।

খায়বার ও বদর অভিযানে সামরিক দিক দিয়ে ইরান সাফল্য অর্জন করলেও রাজনৈতিক দিক দিয়ে এগুলো তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। খায়বার অভিযানের শুরু থেকে ইরাকি বাহিনী রাসায়নিক হামলা জোরদার করে। গণবিধ্বংসী ও নিষিদ্ধ এই অস্ত্র প্রয়োগ করে আগ্রাসী সাদ্দাম বাহিনী বিভিন্ন ফ্রন্টে ইরানি যোদ্ধাদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করতে সক্ষম হয়। আর ইরাকিদের রাসায়নিক হামলা কার্যকরভাবে প্রতিহত করার কৌশল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তখন ইরানের ছিল না।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স সরকার বাগদাদের হাতে ব্যাপক মাত্রায় রাসায়নিক অস্ত্র তুলে দেয় এবং ইরাক সরকার বিভিন্ন ফ্রন্টে সেনা সংখ্যা বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি ইরানের আবাসিক এলাকাগুলোর ওপর হামলা অব্যাহত রাখে আগ্রাসী সাদ্দাম বাহিনী। এ কাজে ইরাকের উদ্দেশ্য ছিল ইরানি জনগণের মনোবলে ফাটল সৃষ্টি করে এদেশের নেতৃবৃন্দকে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য করা। অন্যদিকে ইরানের তেল রপ্তানির প্রধান বন্দর খার্কসহ ইরানি তেলবাহী ট্যাংকারগুলোর ওপরও হামলা চালিয়ে যায় বাগদাদ। এ কাজে ইরাক সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, ইরানের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতকে পঙ্গু করে দিয়ে এদেশের যুদ্ধ করার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া। সেইসঙ্গে ইরানি জনগণের জীবন-জীবিকাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়া। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ইরান একটি নিয়ামক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা হাতে নেয় যাতে বড় ধরনের একটি সাফল্য অর্জন করে যুদ্ধের সমাপ্তি টানা যায়। কিন্তু ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম বিষয়টি জানত বলে সে কোনো অবস্থায় বড় ধরনের পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না।

বদর অভিযানের পর ইরানের পক্ষ থেকে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আগ পর্যন্ত যুদ্ধের ফ্রন্টগুলোতে ইরাকি বাহিনীকে ব্যস্ত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছিল। কারণ, যুদ্ধ পুরোপুরি থামিয়ে রাখলে আগ্রাসী বাহিনী নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পেত। এ কারণে ১৯৮৫ সালে কয়েকটি ফ্রন্টে ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে সীমিত আকারে কয়েকটি অভিযান চালানো হয়। পাশাপাশি ফাও দ্বীপ দখলের লক্ষ্যে ওয়ালফাজর-৮ অভিযান পরিচালনার পূর্ণ প্রস্তুতি চলতে থাকে। ছোট ছোট অভিযানগুলো এমনভাবে চালানো হয় যাতে বড় অভিযানটির প্রস্তুতিতে কোনোরকম ভাটা না পড়ে।  ছোট অভিযানগুলোর বেশিরভাগ চালানো হয় জলাশয়বেষ্টিত হোর অঞ্চলে। ফলে এসব অভিযান সামাল দিতে ইরাকি বাহিনীকে বেশ বেগ পেতে হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ইরাকি বাহিনী নিজের প্রতিরক্ষা ব্যূহ শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেয়।

এমন পরিস্থিতিতে ইরানের পক্ষ থেকে নিজের সামরিক শক্তি বাড়ানোর কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু ভারী অস্ত্রসস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে যেমন বিপুল অংকের অর্থের প্রয়োজন ছিল তেমনি বিষয়টি ছিল সময়সাপেক্ষ। কিন্তু ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি হাল্কা অস্ত্রসস্ত্র ও ন্যুনতম সামরিক সরঞ্জাম নিয়েই রণক্ষেত্রে ব্যাপক শক্তিমত্তা দেখাতে সিদ্ধহস্ত হয়ে পড়েছিল। বদর অভিযানের পর আইআরজিসির পক্ষ থেকে সামরিক শক্তি বাড়ানোর কিছু পরিকল্পনা পেশ করা হয়। কিন্তু ইরানের রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিতে এসব পরিকল্পনা তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য ছিল না। তাদের দৃষ্টিতে এগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রচুর লোকবল, অর্থ ও দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল।  কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আইআরজিসি’র সামরিক শক্তি ও লোকবল বাড়ানোর পরিকল্পনা অনুমোদন করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ কারণে ইরানের প্রেসিডেন্টসহ পদস্থ কর্মকর্তারা আইআরজিসি’কে তাদের বিদ্যমান শক্তি দিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

তবে আইআরজিসি’র পরিকল্পনা অনুযায়ী ইরানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করলে যুদ্ধক্ষেত্রে তেহরানের পক্ষে দ্রুত নতুন নতুন সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হতো। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) সে সময় যুদ্ধের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখতেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করার জন্য আইআরজিসি’র শক্তিবৃদ্ধি করার নির্দেশ দেন। আমরা আগেই বলেছি, যুদ্ধের এ পর্যায়ে ইরানের পরিকল্পনা ছিল বড় ধরনের একটি সাফল্য অর্জন করে যুদ্ধের ইতি টানা। কিন্তু প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে সাদ্দামের সহযোগী দেশগুলো ইরানকে সেরকম কোনো সফল অভিযান চালানোর সুযোগ দিতে চাইছিল না। তারা এ সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপ সৃষ্টি করে ইরানকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করার পরিকল্পনা করে। তারা যুদ্ধ শুরু করার জন্য ইরাকি শাসক সাদ্দামকে অভিযুক্ত না করেই যুদ্ধের ইতি টানতে চেয়েছিল।

পশ্চিমা শক্তিগুলো যেকোনো মূল্যে সাদ্দামকে ইরাকের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এ লক্ষ্যে তারা ইরাকের প্রতি সমরাস্ত্রের চালান বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে ইরানের সমরাস্ত্র আমদানি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা কঠোর করে পশ্চিমা শক্তিগুলো। কিন্তু ইরান কোনো অবস্থাতেই অপমানজনক আত্মসমর্পনের মাধ্যমে যুদ্ধের ইতি টানতে রাজি ছিল না। অন্য কথায় বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইরানকে বড় ধরনের কোনো নিয়ামক অভিযান চালাতে দেয়ার সুযোগ দিতে প্রস্তুত ছিল না। এ কারণে পশ্চিমা শক্তিগুলো সাদ্দাম সরকারের সামরিক শক্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে ইরাকের বিমান বাহিনীকে ব্যাপকভাবে শক্তিশালী করে দেয় পশ্চিমা শক্তিগুলো। পাশাপাশি ইরান যাতে কোনো অবস্থায় বড় ধরনের কোনো অভিযান চালাতে না পারে সে লক্ষ্যেও ব্যাপক চেষ্টা চালায় সাদ্দামের পশ্চিমা মিত্ররা।  পাশ্চাত্য ইরানের ওপর ‘চাপ সৃষ্টির’ নীতি গ্রহণ করে এবং ইরাকের সাদ্দাম সরকারের মাধ্যমে সেই চাপ সৃষ্টি করা হয়।

ইরাকের আগ্রাসী সরকারের পৃষ্ঠপোষক প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো বাগদাদকে চার ধরনের সহযোগিতা করে।  এক, ইরাককে সর্বাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি সরবরাহ বিশেষ করে বিমান হামলায় ব্যবহৃত সামরিক সরঞ্জাম হস্তান্তর; দুই, অত্যাধুনিক রাডার ও গোয়েন্দা প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ‘অ্যাওয়াক্স’ বিমান সরবরাহ; তিন, ইরানের সামরিক শক্তি সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে তা বাগদাদের কাছে হস্তান্তর এবং চার, সাদ্দাম সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার জন্য পাশ্চাত্যের অনুগত আরব শাসকদেরকে বাধ্য করা। এতসব সহযোগিতা নিয়ে ইরাক সরকার তার সামরিক শক্তিকে এতটা উন্নত করতে সক্ষম হয় যে, কিছুদিনের জন্য বিভিন্ন ফ্রন্টে ইরানের অগ্রগতি থামিয়ে রাখা সম্ভব হয়। কিন্তু এই অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি বরং ইরান আবার শক্তি সঞ্চয় করে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের সামরিক শক্তির ভিত কাঁপিয়ে দেয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।