মে ২০, ২০২১ ১৮:২৩ Asia/Dhaka

ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে এবং ইরাকের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে আরভান্দ নদীর তীরে ফাও উপত্যকার অবস্থান।

ওয়ালফাজর-৮ অভিযান পরিচালনার জন্য ইরানি যোদ্ধাদেরকে দু’দেশের সীমান্তবর্তী খরস্রোতা ‘আরভান্দ’ নদী পাড়ি দিতে হতো।  এ কারণে বদর অভিযানের পর ওয়ালফাজর অভিযানের প্রস্তুতি নিতে প্রায় এক বছর লেগে যায়। এর আগে বদর ও খায়বার অভিযান হোর অঞ্চলের জলাভূমিতে হয়েছিল বলে ওই দুই যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ ইরানি যোদ্ধাদের হাতে ছিল। ওই অভিযানগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে এবার ইরান যাতে পরবর্তী কোনো অভিযানে ইরাকি ভূমি দখল করতে না পারে সেজন্য ইরাকি যোদ্ধারা সীমান্তে সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তারা সীমান্ত জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া ও ভূমি মাইন স্থাপন করে।

১৯৮৫ সালের শীতকালে ইরান সেই ভাগ্য নির্ধারণী অভিযান চালানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এ সময় ইরানের পার্লামেন্ট- মসলিসে শুরায়ে ইসলামির তৎকালীন স্পিকার হাশেমি রাফসানজানি ফ্রন্টের কমান্ডারদের এক সমাবেশে ভাষণ দেন। ওই ভাষণে তিনি কমান্ডারদের উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা যদি আরভান্দ নদী পেরিয়ে ওপার যেতে পারেন এবং ফাও উপত্যকা দখল করতে পারেন তাহলে আমরা যুদ্ধের ইতি টানব।

ফাও হচ্ছে এমন একটি দ্বীপ যা আরভান্দ নদী, পারস্য উপসাগর ও খোর-আব্দুল্লাহ উপসাগর দ্বারা বেষ্টিত। এই ফাও অঞ্চলের উত্তরে আবাদান দ্বীপ অবস্থিত এবং এটির ৯০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে শিল্পনগরী বসরা।

ফাও উপত্যকা সাগর ও নদীর তীরে অবস্থিত বলে এই বিস্তীর্ণ জলরাশির জোয়ার-ভাটার প্রভাব এখানে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। অর্থাৎ এই উপত্যকার বেশিরভাগ অঞ্চলের মাটি ভিজা এবং লবনাক্ত। অর্থাৎ, আরভান্দ নদীর তীর থেকে ফাও-বসরা মহাসড়ক পর্যন্ত এলাকার মাটি স্বাভাবিক এবং সেখানে কৃষিকাজ করা সম্ভব। এছাড়া বাকি পুরো উপত্যকার মাটি লবনাক্ত এবং সামান্য বৃষ্টি হলেই এই মাটি গভীর কাদায় পরিণত হয় এবং সেখান থেকে ট্যাংক বা সাঁজোয়া যানের মতো কোনো ভারী যানবাহন নিয়ে চলাচল করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আরভান্দ নদীর উৎপত্তি হয়েছে ইরাকের দজলা ও ফোরাত নদীর পানি দিয়ে এবং ইরানের ভেতর থেকে ‘কারুন’ নদীর পানিও গিয়ে আরভান্দ নদীতে পড়েছে। আর এই সবগুলো নদীর পানি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে পারস্য উপসাগরে গিয়ে মিশে যায়।

পারস্য উপসাগরের পানির প্রভাবে আরভান্দ নদীতে প্রতিদিন দু’বার জোয়ার ও দু’বার ভাটা হয়। জোয়ারের সময় নদীর গভীরতম স্থানে পানির উচ্চতা হয় ২৫ মিটার এবং এখানে জোয়ার ও ভাটার সময় পানির উচ্চতার তারতম্য হয় প্রায় সাড়ে তিন মিটার। 

এদিকে ফাও শহর এবং এর তেল ও শিল্প স্থাপনাগুলো যুদ্ধের বছরগুলোতে ইরানের বিমান হামলা ও কামানের গোলার আঘাতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজেই ফাও উপত্যকা দখলের পরিকল্পনা করার সময় ইরানি সেনা কমান্ডারদেরকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু’টি দিকই ভাবতে হচ্ছিল। একদিকে এটি দখল করলে স্বাভাবিকভাবে ইরাকি বাহিনীর বিপরীতে ইরানের অবস্থান শক্তিশালী হতো। অন্যদিকে এই অভিযানের সামনে যেসব প্রতিবন্ধকতা ছিল সেগুলো বিবেচনায় নিলে এর সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এখানেই ছিল এই অভিযানের মূল জটিলতা।

২৪ ঘণ্টায় যে আরভান্দ নদীতে চারবার জোয়ার-ভাটা হয় এবং যে নদী স্থানভেদে আধা কিলোমিটার থেকে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত প্রশস্ত- সে নদী পার হয়ে এত বড় একটি অভিযান চালানো ছিল ইরানি যোদ্ধাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।  খরস্রোতা এই নদীর পানিপ্রবাহ একই সময়ে নদীর তীরের কাছে একরকম এবং নদীর মাঝখানে এক এক জায়গায় এক এক রকম। এমন একটি নদীর উপর দ্রুততম সময়ের মধ্যে অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করে সৈন্য ও ভারী সামরিক সরঞ্জাম পার করে ওপারে নেয়ার পরিকল্পনা করা সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে যখন নদীর ওপারে শত্রুসেনাদের উপস্থিতি থাকার জোর আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় গভীর সামরিক প্রজ্ঞা ও সৃজনশীল মেধা ছাড়া এমন অভিযানের পরিকল্পনা করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ইরানি সেনা কমান্ডাররা সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এই দুঃসাহসিক অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন।

খায়বার অভিযানের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সাহায্যে অস্থায়ী সেতুর সব উপকরণ আগে থেকেই তৈরি করে রাখা হয়। আমরা আগেও বলেছি, ইরানের অভিযানগুলোর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল শত্রু বাহিনীকে চমকে দেয়া। এ কারণে যেকোনো বড় অভিযানে শত্রুসেনাকে ধোঁকা দেয়ার জন্য একাধিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হতো।  এসব পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় ইরাকিদের গোয়েন্দা তৎপরতা এবং তাদের প্রতি ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা বিরোধী সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীর সহযোগিতার কথাও মাথায় রাখতে হতো। ঘটনাক্রমে ওয়ালফাজর-৮ অভিযানের আগ মুহূর্তে ইরাকি বাহিনী ফাও উপত্যকায় এমনভাবে নিজের বাহিনীকে ঢেলে সাজায় যা দেখে বোঝা যায়, তারা ইরানের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জানতে পারেনি। তারা এ সময় তাদের আর্টিলারি বিভাগের বিপুল সামরিক সরঞ্জাম আরভান্দ নদীর তীর থেকে দজলা নদীর পূর্ব প্রান্তে সরিয়ে নেয়।

শেষ পর্যন্ত ওয়ালফাজর-৮ অভিযানের জন্য ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র পূর্ণ শক্তি এবং স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর অন্তত ২০ হাজার যোদ্ধাকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আইআরজিসি ও সেনাবাহিনীর সবগুলো কামান ইউনিট, ক্ষেপণাস্ত্র, সেনাবাহিনীর ছয় ডিভিশন সেনা, অসংখ্য হেলিকপ্টার ও জঙ্গিবিমানকে পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় রাখা হয়। তখন পর্যন্ত এত বিপুল সৈন্য ও সামরিক সম্ভার আর কোনো অভিযানে ব্যবহার করা হয়নি। আট বছরব্যাপী ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইরানের ভূমি থেকে আগ্রাসী সেনাদের বিতাড়ন করার জন্য বহু অভিযান চালানো হয়। কখনো কখনো ইরাকি বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য সেদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যুদ্ধ করেন ইরানি যোদ্ধারা।

সামরিক পরিকল্পনা এবং সেনা সংখ্যা ও ব্যাপ্তির দিক দিয়ে ইরাকের অভ্যন্তরে ইরানের পক্ষ থেকে চালানো সবচেয়ে বড় অভিযান ছিল ফাও উপত্যকা দখলের এই অভিযান। ইরাকের অভ্যন্তরে এর আগেও ইরান যেসব অভিযান চালিয়েছিল তার উদ্দেশ্য দেশটি দখল করা ছিল না বরং ইরাকি শাসক সাদ্দামকে ইরানের ওপর আগ্রাসন চালানোর ব্যাপারে অনুতপ্ত করার লক্ষ্যে সেসব অভিযান চালানো হয়েছিল। সেইসঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করার ব্যাপারে ইরানের দাবি বাগদাদকে মানতে বাধ্য করাও ছিল তেহরানের অন্যতম উদ্দেশ্য। ইরানের সামরিক অভিযানগুলোর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল ইরাক যাতে আর কোনোদিন ইরানের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস না দেখায় সে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।