জুন ১৫, ২০২১ ১৯:৩১ Asia/Dhaka

ইরানি যোদ্ধারা ফাও দ্বীপ দখল করার ফলে ইরাকের সাদ্দাম সরকার এতটা অপমানিত হয় যে, এটি পুনরুদ্ধারের জন্য সব রকম উপায় অবলম্বন করে।

এমনকি ইরানি যোদ্ধাদের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করতেও দ্বিধা করেনি ইরাক সরকার। ইরাক-ইরান আট বছরের যুদ্ধে যখনই ইরাকি সেনারা ইরানের পদাতিক বাহিনীর অগ্রাভিযান প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে তখনই তারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের কাপুরুষতা দেখিয়েছে।  ইরানি যোদ্ধারা আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে খোররামশাহর মুক্ত করার পর থেকে প্রায় প্রতিটি অভিযানেই এই কাপুরুষোচিত কাজ করেছে বাগদাদ। ওয়ালফাজর-৮ অভিযানের প্রায় তিন বছর আগে ইরাকের ‘হাজী ইমরান’ সেনা ঘাঁটিতে ইরান যখন ওয়ালফাজর-২ অভিযান চালায় তখন ইরাকি বাহিনী প্রথম রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে। অবশ্য সেটি ছিল অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ের এবং সেখানে শুধু মাস্টার্ড গ্যাস প্রয়োগ করা হয়েছিল।

ওয়ালফাজর-৪ অভিযাানে ইরাকি বাহিনীর রাসায়নিক হামলার পরিধি বেড়ে যায়। খায়বার অভিযানের প্রথম কয়েক সপ্তাহে ইরানি যোদ্ধাদের ওপর ব্যাপকভাবে মাস্টার্ড গ্যাস প্রয়োগ করে ইরাকিরা। তবে এসব রাসায়নিক বোমার বিস্ফোরণ ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকার কারণে বেশিরভাগ বোমা বিস্ফোরিত হয়নি। কয়েক সপ্তাহ পর একই অভিযানে ইরাকি বাহিনী সীমিত আকারে নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ করে যার ফলে প্রায় ৮০০ ইরানি যোদ্ধা আহত হন; তবে এর ফলে খুব বেশি যোদ্ধা মারা পড়েননি। এর কয়েক সপ্তাহ পর ইরাকি বাহিনী ইরানি যোদ্ধাদের ওপর সাফোকেটিং গ্যাস প্রয়োগ করে; তবে এতে আহত যোদ্ধাদের সংখ্যা মাস্টার্ড গ্যাসে আহত যোদ্ধাদের চেয়ে কম ছিল।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, তখন পর্যন্ত ইরাকি বাহিনী ইরানি যোদ্ধাদের উপর সব ধরনের রাসায়নিক গ্যাস একসঙ্গে প্রয়োগ করেনি। বদর অভিযানে প্রথমে তারা নার্ভ গ্যাস এবং পরে সায়ানাইড গ্যাস প্রয়োগ করে এবং শেষে এই দুই গ্যাসের বোমা দিয়ে একসঙ্গে হামলা চালায়। এবারের হামলায় ব্যাপক হারে ইরানি যোদ্ধা নিহত হন। দুই গ্যাসের সংমিশ্রণ শ্বাসনালী দিয়ে প্রবেশের কারণে অন্তত ২০০ ইরানি যোদ্ধা কোমায় চলে যান যাদেরকে তড়িৎ চিকিৎসা না দিলে তাদের অধিকাংশই শহীদ হয়ে যেতেন।

কিন্তু ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে ইরানের কাছে শোচনীয় পরাজয় বরণ করার পর সাদ্দাম বাহিনী দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় ইরানি যোদ্ধাদের ওপর রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগ করে। এর ফলে ব্যাপক সংখ্যক ইরানি যোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। ইরাকি বিমান বাহিনীর ১৪ থেকে ১৮টি যুদ্ধবিমান একসঙ্গে উড়ে এসে ইরানি যোদ্ধাদের ওপর রাসায়নিক বোমা নিক্ষেপ করত। এর পরপরই যুদ্ধবিমানের এরকম আরো একটি স্কোয়াড্রন এসে একইভাবে হামলা চালাত। এর ফলে অল্প কিছু সময়ের মধ্যে গোটা এলাকা রাসায়নিক গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে যেত। এসব যুদ্ধবিমানের প্রত্যেকটিতে করে ২৫০ কেজি ওজনের ছয়টি অথবা ৫০০ কেজি ওজনের চারটি রাসায়নিক বোমা বহন করা হতো।

ইরানি যোদ্ধাদের ওপর দুই বার রাসায়নিক হামলায় অংশগ্রহণকারী একজন ইরাকি পাইলট ইরানের হাতে বন্দি হওয়ার পর তার কাছে থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। ওই পাইলট জানান, ইরাকিরা রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে এবং এসবের প্রয়োগ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়ে ইরাকি সেনাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এসব রাসায়নিক অস্ত্রের বেশিরভাগ বিদেশি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে ইরাকেই উৎপাদন করা হতো। ইরাকের তৎকালীন সাদ্দাম সরকার আট বছরের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সময় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে। তবে ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে এসব গ্যাসের সবগুলো একসঙ্গে প্রয়োগ করা হয়।

এসবের মধ্যে মাস্টার্ড গ্যাস প্রয়োগের ফলে মানবদেহের ত্বক গভীরভাবে পুড়ে বড় বড় ফোস্কা পড়ে যায়। নার্ভ গ্যাস প্রয়োগের ফলে মানুষের শ্বাসকষ্ট হয় এবং অতিরিক্ত গ্যাস শ্বাসনালীতে চলে গেলে মানুষের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। সায়ানাইড গ্যাসের ক্ষতি এর চেয়েও ভয়াবহ হয়। ইরাকি বাহিনীর এর বাইরেও নাম না জানা আরো নানা ধরনের নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করে। এর ফলে ইরানি যোদ্ধারা এমনভাবে আহত হন যে, তাদেরকে সুস্থ করে তোলার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বহু ইরানি যোদ্ধা রাসায়নিক গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে দশকের পর দশক ধরে মৃতপ্রায় জীবনযাপন করেন। এসব যোদ্ধার শরীরের রক্তের সঙ্গে রাসায়নিক গ্যাস মিশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

ইরাকি সেনারা একসঙ্গে সবগুলো রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগ করত বলে একজন ইরানি যোদ্ধার দেহে মাস্টার্ড, নার্ভ ও সায়ানাইড- এই সবগুলো গ্যাসের আঘাত প্রত্যক্ষ করা যেত। ইরাকি সেনারা যখন রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগ করত তখন ফাও দ্বীপের খেজুরের বাগানসহ অন্যান্য গাছপালা পুড়ে যেত এবং এসব গাছের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এসব গ্যাসের বিষক্রিয়া থেকে যেত। মৃদুমন্দ বাতাসে সে বিষক্রিয়া চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু রাসায়নিক গ্যাসের বিষক্রিয়া যাতে শেষ হয়ে না যায় সেজন্য ইরাকি বাহিনী প্রতিদিন ইরানি যোদ্ধাদের অবস্থানে রাসায়নিক বোমাবর্ষণ অব্যাহত রাখত। যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি রাসায়নিক হামলার কাজে ইরাকিরা হেলিকপ্টারও ব্যবহার করেছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ইরাকি সেনারা ফাও দ্বীপ ও এর পাশপাশের গোটা এলাকায় রাসায়নিক বোমা হামলা চালালেও যেসব এলাকায় খেজুরের বাগান ছিল সেসব এলাকায় তারা এর কার্যকারিতা ও সফলতা বেশি পেয়েছে। এভাবে ইরাকি বাহিনী খুব কম সময়ের মধ্যে ইরানি যোদ্ধাদেরকে কাবু করে তাদেরকে আহত করে পিছু হটতে বাধ্য করতে পেরেছে। ফাও দ্বীপে চালানো অভিযানে স্বাভাবিক অস্ত্রের আঘাতে আহত ও রাসায়নিক অস্ত্রের প্রভাবে আহত যোদ্ধাদের সংখ্যা তুলে ধরলে এই নিষিদ্ধ অস্ত্রের কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। ওয়ালফাজর-৮ অভিযানের শুরু থেকে ফাও দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা পর্যন্ত ১৩ হাজার আহত ইরানি যোদ্ধাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে আনতে হয়েছে। অথচ মাত্র তিনদিনের রাসায়নিক বোমাবর্ষণের ফলে নয় হাজারের বেশি ইরানি যোদ্ধা আহত হয়েছেন।

ইরাকি বাহিনী এভাবে ফাও উপত্যকা পুনরুদ্ধারের জন্য টানা আড়াই মাস বা ৭৫ দিন ধরে ইরানি যোদ্ধাদের ওপর রাসায়নিক অস্ত্রসহ কামান ও মর্টারের গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। কিন্তু জীবন বাজি রেখে লড়াই করা ইরানি যোদ্ধারা এতকিছুর পরও তাদের অবস্থানে অটল থাকেন। ফলে এক পর্যায়ে ইরাকি সেনারা ফাও দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের আশা ছেড়ে দিয়ে সেখানে হামলা বন্ধ করে দেয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ