আগস্ট ০১, ২০২১ ২১:১৬ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা পরিবারের সদস্যদের ওপর বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জীবনের ওপর আধুনিক নানা প্রযুক্তির ও বিশেষ করে টেলিভিশনের ভূমিকা সম্পর্কে কথা বলেছিলাম।

আমরা বলেছিলাম বর্তমান যুগে নতুন নতুন গণমাধ্যম ছাড়া আমাদের অবসর সময়গুলো কাটানো সম্ভব হচ্ছে না এবং এক্ষেত্রে টেলিভিশন, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের রয়েছে বিশেষ অবস্থান। স্যাটেলাইট টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও কম্পিউটার গেম থেকে পুরোপুরি দূরে থাকা বর্তমান যুগে প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে কম্পিউটার গেমের গ্রাহক ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে।  বিনোদন হিসেবেও এইসব গেম সবচেয়ে দর্শক-নন্দিত বিনোদনের স্থান করে নিয়েছে। ফলে দৌড়-ঝাঁপমূলক খেলাধুলা ও শরীর-চর্চা বর্তমান যুগের শিশু-কিশোরদের মধ্যে গুরুত্ব ব্যাপক মাত্রায় হারিয়ে ফেলেছে।

একটা সময় ছিল যখন শিশু-কিশোররা মাটি বা অন্য কোনো আঠালো কিছু মাধ্যম ব্যবহার করে নানা ধরনের খেলনা বা পুতুল ইত্যাদি বানিয়ে তাদের সৃষ্টিশীল দক্ষতা বৃদ্ধির চর্চা করত। এখন এর জায়গা করে নিয়েছে নানা ধরনের মোবাইল বা ট্যাবলেট-এর মাধ্যমে দৃশ্যমান নানা ধরনের কম্পিউটার গেম । বাবা-মা বা অভিভাবকরাও শিশু-কিশোরদের স্মার্ট ফোন বা ট্যাবলেট কিনে দিতে বাধ্য হচ্ছেন এইসব নতুন খেলার আনন্দ উপভোগের ও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দিতে।  এ যুগের শিশু-কিশোররা এখন দৌড়-ঝাঁপ বা শরীর-চর্চা কিংবা হস্তশিল্প নির্মাণ-ভিত্তিক খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ দেখায় না।  বরং কম্পিউটার বা ভিডিও-গেমের দিকেই তাদের আগ্রহ বেশি। ফলে গত চার দশকেরও কম সময়ের মধ্যে ভিডিও-গেম নির্মাণ এখন বড় ধরনের বৈশ্বিক লাভজনক ব্যবসার মাধ্যম হয়ে পড়েছে।

কম্পিউটার বা ভিডিও-গেমের ব্যাপক জনপ্রিয়তার ক'টি কারণ হল: এসবে রয়েছে খেলার নানা ধরনের নিয়মের মধ্যে ইচ্ছামত বিভিন্ন নিয়ম বেছে নেয়ার ব্যবস্থা ও এইসব নিয়মের ব্যাখ্যাগুলো বোঝার ব্যবস্থা, কাল্পনিক বীর নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ ও এমনকি নায়কের সক্ষমতার পরীক্ষায় নম্বর দেয়ারও ব্যবস্থার মত আকর্ষণীয় নানা দিক!

কম্পিউটার-ভিত্তিক এইসব গেম শিশু-কিশোরদের নানা ধরনের জ্ঞান দিচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তারা ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতিসহ অন্য অনেক বিষয়ে বিশেষ চিন্তাধারা ও তথ্যের মুখোমুখি হচ্ছে। অন্য কথায় শিশুদের মন-মগজকে বিশেষ কিছু দিকে অথবা মতবাদে আকৃষ্ট করার বা মগজ ধোলাই করার ব্যবস্থাও রয়েছে এইসব ভিডিও গেমে।

এটা ঠিক যে অপরাজনৈতিক নানা লক্ষ্যসহ ভিডিও গেম-মাধ্যমকে যেমন নানা অশুভ লক্ষ্যে ব্যবহার করা যায় তেমনি নানা শুভ লক্ষ্যেও এই মাধ্যমকে ব্যবহার করা সম্ভব।  এই মাধ্যম  চিত্রাঙ্কনসহ গণিত, সাধারণ জ্ঞান ও অন্য অনেক কিছু শেখানোর এক ভালো মাধ্যমও বটে। এমনকি ভিডিও গেমের মাধ্যমে নানা রোগের চিকিৎসারও সহায়তা হতে পারে এবং এই মাধ্যম বিনোদনেরও এক উৎকৃষ্ট মাধ্যম।

কিন্তু ভিডিও গেম বা কম্পিউটার গেমের নানা ক্ষতিকর দিকের কথাও ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। যেমন, এইসব গেম শিশুদের শরীর ও মনের জন্য নানা ধরনের ক্ষতি বয়ে আনে। ভিডিও গেমের আসক্তি শিশুদের কল্পনা-প্রিয়, অবাস্তবতাবাদী, ঘরকুনো, একাকীত্ব-প্রিয়, আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিকও করে তুলতে পারে। যারা খুব বেশি এ ধরনের খেলায় মেতে থাকে তারা বাস্তবতার জগত সম্পর্কে এবং পারিপার্শ্বিক সমাজ  সম্পর্কেও অসচেতন হয়ে পড়ে এবং এসব বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্বও তারা অনুভব করে না। শারীরিক দিক থেকেও মুটিয়ে পড়ে নানা ধরনের রোগের শিকার হয় এ ধরনের খেলায় আসক্ত শিশু-কিশোররা।

ভিডিও-গেম নির্মাতারা শিশু-কিশোরদেরকে দুঃসাহসিক অভিযানের মজা দিতে এইসব খেলার মধ্যে সহিংসতা ও বিচিত্র ধরনের অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার করছেন। ফলে শিশু-কিশোররা এইসব গেমের প্রভাবে হয়ে উঠছে সহিংস ও হিংস্র। বারবার সহিংসতার ও নিষ্ঠুরতার দৃশ্য দেখতে দেখতে শিশু-কিশোরদের অনেকেরই মনে এসব বিষয় স্বাভাবিক হয়ে পড়ে। ভিডিও গেমের ভেতরে তারা বহু মানুষকে হত্যার ভার্চুয়াল অভিজ্ঞতা অর্জন করে।

কোনো কোনো ভিডিও-গেম এমনই যে সেখানে যত বেশি হত্যাযজ্ঞ করা যায় ততই বেশি পয়েন্ট পেয়ে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায় খেলোয়াড়! সহিংসতার দৃশ্য দেখতে দেখতে শিশু কিশোররা মনে করে সহিংসতাই নানা সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে ভালো পন্থা! ফলে এই শিশু কিশোররাই বড় হয়ে যদি নানা অপরাধ ও সহিংস অপকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে ভিডিও গেমের সুদূরপ্রসারী প্রভাবে তাহলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাঝে মধ্যে যেসব সশস্ত্র হামলা ও হত্যাযজ্ঞ হয়ে থাকে সেসব গণমাধ্যমের সহিংস দৃশ্যেরই, বিশেষ করে ভিডিও গেমগুলোর সহিংস দৃশ্যগুলোর অন্যতম প্রভাব।

শিল্প-বিপ্লবোত্তর যুগে নানা ধরনের প্রযুক্তি ও মাধ্যম পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বাড়িয়ে দিয়েছে। সন্তানরা এখন ভিডিও গেম, ইন্টারনেট ও এ জাতীয় নানা বিষয়ে মশগুল হয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে অতীতের তুলনায় কম যোগাযোগ রাখছে! ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে পারিবারিক বন্ধন।

তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাবা-মা ও অভিভাবকদের উচিত শিশু-কিশোররা যে ধরনের খেলাধুলাতেই মশগুল থাকুক না কেন তারাও যেন অল্প সময়ের জন্য হলেও তাদের সেই সময়কার সঙ্গী হন। ভিডিও গেম একসঙ্গে দেখতে গিয়ে তারা যেন এসব গেমের নানা দোষত্রুটিও তুলে ধরেন এবং এ বিষয়ে মত বিনিময় করেন শিশু-কিশোর সন্তানদের সঙ্গে। প্রয়োজনে এইসব গেইমের ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে বাবা মা ও অভিভাবককে।

অতীতের খেলাধুলায় যেমন শিশ-কিশোরদের শরীর চর্চাও হয়ে যেত এবং পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্ব জোরদার হত বর্তমান যুগের ভিডিও গেইম বা কম্পিউটার গেইম ঠিক এর বিপরীত। এখন শিশু ও কিশোররা একা একাই খেলে ট্যাবলেট, মোবাইল বা ল্যাপটপে। ফলে এ ধরনের শিশু-কিশোররা হয়ে উঠতে পারে হতাশাবাদী। ভিডিও প্রযুক্তির এ ধরনের খেলায় পারস্পরিক যোগাযোগ ও  সামনাসামনি দেখার ব্যবস্থা না থাকায়  তাদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের চেতনাও গড়ে উঠতে পারে না।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাস দেখা দেওয়ায় ও স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরাসরি খোলা না থাকায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে ভিডিও গেইমের আসক্তি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।  তাই তাদের ওপর অভিভাবকদের নজরদারি জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ