সূরা আহকাফ : আয়াত ১-৫ (পর্ব-১)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা আহকাফের ১ম পর্ব নিয়ে আলোচনা। আরব উপত্যকায় আদ জাতির বসবাসের স্থান বালুকাময় মরুভূমি ছিল বলে এই জনপদকে আহকাফ বলা হতো। এই সূরার ২১ নম্বর আয়াতে ইনশাআল্লাহ আদ জাতির ঘটনা বর্ণনা করা হবে। এই সূরার ১ থেকে ৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِیم
حم ﴿١﴾ تَنْزِیلُ الْکِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِیزِ الْحَکِیمِ ﴿٢﴾ مَا خَلَقْنَا السَّمَاوَاتِ وَالأرْضَ وَمَا بَیْنَهُمَا إِلا بِالْحَقِّ وَأَجَلٍ مُسَمًّى وَالَّذِینَ کَفَرُوا عَمَّا أُنْذِرُوا مُعْرِضُونَ ﴿٣﴾
“হা-মিম।”(৪৬:১)
“এ কিতাব পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ।” (৪৬:২)
“আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং উভয়ের মধ্যস্থিত সব কিছুই আমি যথাযথভাবে নির্দিষ্টকালের জন্য সৃষ্টি করেছি; কিন্তু অবিশ্বাসীরা তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে, তা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”(৪৬:২)
পবিত্র কুরআনের আরো ২৮টি সূরার মতো এই সূরাও হুরুফে মুকাত্তায়াত দিয়ে শুরু হয়েছে এবং অন্য সূরাগুলির মতো এখানেও এই হুরুফের পর পবিত্র কুরআনের মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ যেন বলতে চেয়েছেন, তোমাদের কাছে এই যে আলিফ-বা হরফগুলো রয়েছে সেগুলো দিয়েই এই মহাগ্রন্থ রচনা করেছি। অথচ তোমাদের কাছেও এই ‘আলিফ-বা-তা-সা’ হরফ থাকা সত্ত্বেও তোমরা এর যেকোনো একটি আয়াতের সমান আয়াত রচনা করতে সক্ষম নও। আর এটি হচ্ছে এই কিতাবের সবচেয়ে বড় মুজিযা।
পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে এই কিতাব নাজিল হওয়ার কথা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে এই আসমানি কিতাবের গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হচ্ছে: এর দিকনির্দেশনা মেনে চললে মানুষেরও মর্যাদা ও শক্তিমত্তা বৃদ্ধি পাবে। কারণ, এই গ্রন্থের শিক্ষাগুলো মহাজ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে সাজানো হয়েছে এবং এখানে কোনো ভ্রান্ত কথাবার্তা নেই।
শুধু এই কিতাব নয় সেইসঙ্গে গোটা বিশ্বজগত যথার্থভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে সুনির্দিষ্টি কর্মপরিকল্পনার ভিত্তিতে ও নির্ধারিত কালের জন্য। আর এই জগতে প্রত্যেক জড় ও জীব পদার্থের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। নিঃসন্দেহে এই কিতাবে যেমন সত্যের পরিপন্থি কোনো শব্দ নেই তেমনি গোটা সৃষ্টিজগতে এমন কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে না যা অনর্থক সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকূলের মধ্যে রয়েছে বিস্ময়কর ভারসাম্য। তবে এই বিশ্বজগতের যেমন একটি শুরু ছিল তেমনি এর নির্ধারিত সমাপ্তিকালও রয়েছে। শেষ হয়ে যাওয়ার সেই কাল সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জ্ঞান রাখেন এবং সেদিন আসা মাত্র কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং বিশ্বজগত ধ্বংস হয়ে যাবে।
অবশ্য যারা আল্লাহর অস্তিত্ব ও রাসূলের নবুওয়াতে বিশ্বাস করে না তারা যেমন পবিত্র কুরআন ও সৃষ্টিজগত থেকে শিক্ষা নেয় না তেমনি তারা কোনোরকম সতর্কবাণীতেও কান দেয় না। তারা সত্য থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায় বলে তাদের কপালে হেদায়েত জোটে না।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- কুরআন হচ্ছে আল্লাহর বাণী যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তরে নাজিল হয়েছে এবং তাঁর পবিত্র মুখে প্রথমবার উচ্চারিত হয়েছে।
২- বিশ্বপ্রকৃতি ও শরিয়তের বিধান উভয়ই সত্য ও প্রজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে। কারণ, দু’টিই মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন।
৩- আসমানসমূহ ও জমিন এবং এর মধ্যবর্তী কোনোকিছু হঠাৎ করে বা দৈবচয়নের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়নি। এসব সৃষ্টির পেছনে রয়েছে মহাজ্ঞান ও প্রজ্ঞার কারুকার্য।
৪- বিশ্বজগতের সবকিছু আল্লাহর নির্দেশ মেনে পরিচালিত হচ্ছে। একমাত্র মানুষকে কর্মের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে সে সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে বিভ্রান্তির অতলে হারিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।
সূরা আহকাফের ৪ ও ৫ আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
قُلْ أَرَأَیْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَرُونِی مَاذَا خَلَقُوا مِنَ الأرْضِ أَمْ لَهُمْ شِرْکٌ فِی السَّمَاوَاتِ اِئْتُونِی بِکِتَابٍ مِنْ قَبْلِ هَذَا أَوْ أَثَارَةٍ مِنْ عِلْمٍ إِنْ کُنْتُمْ صَادِقِینَ ﴿٤﴾ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ یَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لا یَسْتَجِیبُ لَهُ إِلَى یَوْمِ الْقِیَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ ﴿٥﴾
“বলুন, ‘তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক, তাদেরকে দেখছ কি? তারা পৃথিবীতে কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও অথবা আকাশমন্ডলী [সৃষ্টিতে] তাদের কোন অংশীদারিত্ব আছে কি? [কুরআনের] পূর্ববর্তী কোন কিতাব অথবা [পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া] কোনো জ্ঞান থাকলে তা তোমরা আমার নিকট উপস্থিত কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।”(৪৬:৪)
“সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে, যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা কিয়ামত দিবস পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না? আর তারা তাদের ডাক সম্পর্কেও অবহিত নয়।”(৪৬:৫)
এখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশে এই কথা বলার আদেশ দিচ্ছেন যে: তোমরা যেসব মূর্তির উপাসনা করো এই বিশ্বজগত সৃষ্টি বা পরিচালনায় তাদের কি কোনো ভূমিকা আছে? তোমরা যখন একথা স্বীকার করছ যে, আসমানসমূহ, জমিন, চন্দ্র, সূর্য ও তারকারাজি সবই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তাহলে কেন মূর্তির উপাসনা করছ? কেন তোমরা নিজেদের সমস্যার সমাধানের জন্য বুদ্ধিহীন ও নিষ্প্রাণ এসব মূর্তির কাছে ধর্না দিচ্ছ?
তোমাদের কাছে কি কুরআন নাজিলের আগে এমন কোনো কিতাব এসেছে যাতে মূর্তিপূজা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে? অথবা কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি কি এমন কোনো জ্ঞান তোমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যার ভিত্তিতে তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করছ?
এসব প্রশ্নের যখন কোনো উত্তর তোমাদের কাছে নেই তখন তোমরা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে মূর্তিপূজা করে যাচ্ছ।
পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: তোমরা কোনো ঐশী কিতাব বা প্রমাণিত জ্ঞান ছাড়াই এমন সময় মূর্তিসহ অন্যান্য উপাস্যের পূজা করছ যখন তোমরা জানো যে, এসব মূর্তি তোমাদের কোনো কথার জবাব দেয় না এবং তোমাদের কোনো চাহিদাও পূরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে তোমরা ভ্রান্ত পথের অনুসরণ করছ এবং কঠিনভাবে বিভ্রান্ত হয়ে গেছ। তোমরা যাদেরকে ডাকছ তারা নিজেরাও জানে না যে, তোমরা তাদেরকে ডাকাডাকি করছ।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- আল্লাহ প্রদর্শিত পথ ছাড়া অন্য যেকোনো পথে রয়েছে ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি।
২- কখনো কখনো খোদাদ্রোহীদের প্রতি সুচিন্তিত কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিতে হবে যাতে তারা সেগুলোর জবাব দিতে গিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হতে বাধ্য হয় এবং নিজেদের ভ্রান্ত পথ অনুসরণের বিষয়টি বুঝতে পারে।
৩- শুধু ইট-কাঠ-পাথরের মূর্তিই নয় বরং জ্ঞানী ও ক্ষমতাধর মানুষের পক্ষেও অপরের সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। কাজেই আমরা যেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোনো ক্ষমতাধর মানুষকেও উপাস্য হিসেবে গ্রহণ না করি।
৪- আমরা যেকোনো কাজ করি তার যেন বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানগত ভিত্তি থাকে অথবা আল্লাহ তায়ালার কালামে পাকের মাধ্যমে অনুমোদিত হয়।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।