সূরা আহকাফ : আয়াত ৬-১০ (পর্ব-২)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা আহকাফের ২য় পর্ব নিয়ে আলোচনা। আরব উপত্যকায় আদ জাতির বসবাসের স্থান বালুকাময় মরুভূমি ছিল বলে এই জনপদকে আহকাফ বলা হতো। এই সূরার ২১ নম্বর আয়াতে ইনশাআল্লাহ আদ জাতির ঘটনা বর্ণনা করা হবে। এই সূরার ৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ کَانُوا لَهُمْ أَعْدَاءً وَکَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ کَافِرِینَ ﴿٦﴾
“আর যখন কিয়ামতের দিন মানুষকে একত্রিত করা হবে, তখন [তাদের উপাস্যরা] তাদের শত্রু হয়ে দাঁড়াবে এবং তাদের উপাসনাকে অস্বীকার করবে।”(৪৬:৬)
গত আসরে আমরা মুশরিকদের মূর্তিপূজা সম্পর্কে বলেছি যে, পবিত্র কুরআন এসব উপাসনাকে অসার বলে উল্লেখ করেছে। আল্লাহ বলছেন, তোমরা যদি তোমাদের সমস্যার সমাধান বা কোনো কাজে সাফল্যের জন্য এসব উপাস্যকে কিয়ামত পর্যন্তও ডাকতে থাকো তবুও তারা তোমাদের ডাকে সাড়া দেবে না এবং তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারবে না।
এরপর আজকের এই আয়াতে বলা হচ্ছে, তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে কিয়ামতের দিন এসব উপাস্য তোমাদের বিরুদ্ধে কথা বলবে। মুশরিকরা যেসব ফেরেশতা ও মানুষের উপাসনা করে তারা কিয়ামতের দিন সরাসরি তাদের শত্রুতে পরিণত হবে। উদাহরণ হিসেবে, যারা হযরত ঈসা (আ.)-এর উপাসনা করে তিনি তাদের উপাসনা অস্বীকার করবেন। আর যেসব মূর্তির পূজা করা হয় সেসব মূর্তিকেও আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন কথা বলার সুযোগ দেবেন এবং তখন এসব মূর্তি তাদের উপাসনাকারীদের ভর্ৎসনা করবে।
এই আয়াতের একটি শিক্ষণীয় দিক হলো:
১- পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া আর যারই উপাসনা করা হোক না কেন কিয়ামতের দিন সেসব উপাস্য তাদের উপাসনাকারীদের শাফায়াত করার পরিবর্তে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ দায়ের করবে।
সূরা আহকাফের ৭ ও ৮ আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَإِذَا تُتْلَى عَلَیْهِمْ آیَاتُنَا بَیِّنَاتٍ قَالَ الَّذِینَ کَفَرُوا لِلْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُمْ هَذَا سِحْرٌ مُبِینٌ ﴿٧﴾ أَمْ یَقُولُونَ افْتَرَاهُ قُلْ إِنِ افْتَرَیْتُهُ فَلا تَمْلِکُونَ لِی مِنَ اللَّهِ شَیْئًا هُوَ أَعْلَمُ بِمَا تُفِیضُونَ فِیهِ کَفَى بِهِ شَهِیدًا بَیْنِی وَبَیْنَکُمْ وَهُوَ الْغَفُورُ الرَّحِیمُ ﴿٨﴾
“আর যখন তাদের কাছে আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয় তখন যারা কুফরী করেছে তাদের কাছে সত্য আসার পর তারা বলে, এ তো সুস্পষ্ট জাদু।”(৪৬:৭)
“নাকি তারা বলে যে, সে এটা রচনা করেছে [এবং আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছে]। বলুন, যদি আমি এটা রচনা করে থাকি, তবে তোমরা আমাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না। তোমরা যে বিষয়ে আলোচনায় লিপ্ত আছ, সে সম্বন্ধে আল্লাহ সবিশেষ অবগত। আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী হিসেবে তিনিই যথেষ্ট এবং তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(৪৬:৮)
মক্কার মুশরিকরা বিশ্বনবী (সা.)-এর প্রতি যেসব অপবাদ আরোপ করত তার প্রতি ইঙ্গিত করে এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, তারা কখনো রাসূলে খোদাকে যাদুকর এবং পবিত্র কুরআনের আয়াতকে ‘মানুষকে আকৃষ্ট করার যাদুমিশ্রিত বাণী’ বলে অপবাদ দিত। তারা একদিকে মানুষের অন্তরে পবিত্র কুরআনের গভীর আকর্ষণকারী ক্ষমতাকে অস্বীকার করতে পারত না অন্যদিকে এই মহাসত্যের সামনে নতিস্বীকার করতেও প্রস্তুত ছিল না। এ কারণে তারা সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার লক্ষ্যে কুরআনের আয়াতকে যাদু বলে আখ্যায়িত করত। মুশরিকরা বলত, এসব বক্তব্য তার নিজের এবং সে এটা আল্লাহর নামে চালিয়ে দিচ্ছে। মহানবী (সা.) তাদের এসব ভ্রান্ত কথাবার্তার জবাবে বলেন, তোমরা যা বলছ তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ যেন আমার স্বরূপ উন্মোচন করে দেন যাতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে না যায়। সেক্ষেত্রে আল্লাহর শাস্তি থেকে আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
তিনি মুশরিকদের আরো বলেন, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তোমরাই আল্লাহর প্রেরিত পুরুষের বিরুদ্ধাচরণ করছ এবং মানুষের হেদায়েতের পথ বন্ধ করে দিচ্ছ। অথচ আমার নবুওয়াতের সত্যতার ব্যাপারে তোমাদের মনে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। আল্লাহ তায়ালা নিজে আমার নবুওয়াতের সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং তিনি তোমাদের অপবাদ, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচারিতাও দেখছেন। আমার জন্য এটিই যথেষ্ট।
তবে আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের সামনে খোদাদ্রোহিতা থেকে সরে এসে ঈমান আনার সুযোগ দেয়ার জন্য এখানে বলছেন: আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। তিনি তওবাকারীদের পাপ ক্ষমা করে দেন এবং তাদেরকে নিজের রহমতের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দান করেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- আল্লাহর রাসূলের নবুওয়াতের নিদর্শনগুলো সুস্পষ্ট। কিন্তু কিছু একগুঁয়ে ও উদ্ধত মানুষ ভ্রান্ত জেদের বশবর্তী হয়ে সবকিছু উপলব্ধি করার পরও নবী-রাসূলদের প্রতি ঈমান আনা থেকে বিরত থাকে।
২- এমনকি খোদাদ্রোহীরা কুরআনের অসম্ভব আকর্ষণকারী ক্ষমতা মেনে নেয়া সত্ত্বেও এই মহাগ্রন্থের বাণীকে যাদু বলে আখ্যায়িত করে।
৩- আমরা যেন নিজেদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও খেয়াল-খুশিকে আল্লাহর নামে চালিয়ে না দেই সে ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে; কারণ এর জন্য ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে।
৪- যেকোনো মানুষের জন্য এমনকি খোদাদ্রোহী জালেম, কাফের ও মুরতাদদের জন্যও তওবার দরজা সব সময় খোলা রয়েছে এবং তারা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর আশ্রয় চাইলে তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন।
সূরা আহকাফের ৯ আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
قُلْ مَا کُنْتُ بِدْعًا مِنَ الرُّسُلِ وَمَا أَدْرِی مَا یُفْعَلُ بِی وَلا بِکُمْ إِنْ أَتَّبِعُ إِلا مَا یُوحَى إِلَیَّ وَمَا أَنَا إِلا نَذِیرٌ مُبِینٌ ﴿٩﴾
“বলুন, রাসূলদের মধ্যে আমিই প্রথম নই। আর আমি জানি না, আমার ও তোমাদের সঙ্গে কী আচরণ করা হবে; আমি আমার প্রতি যা ওহী করা হয় শুধু তারই অনুসরণ করি। আর আমি তো এক স্পষ্ট সতর্ককারী মাত্ৰ।” (৪৬:৯)
এই আয়াতে মক্কার মুশরিকদের উত্তর দেয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলছেন: আপনি তাদের বলে দিন, অতীতে প্রেরিত রাসূলদের সঙ্গে আমার কোনো পার্থক্য নেই বরং আমিও তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আমি মানুষকে একত্ববাদের প্রতি আহ্বানকারী প্রথম নবী নই। আমার আগে যেসব নবী গত হয়ে গেছেন তারাও মানুষের মতো খাবার খেতেন এবং পোশাক পরতেন। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, আমার প্রতি ওহী নাজিল হয় এবং তোমাদের প্রতি হয় না। তোমাদেরকে খারাপ কাজের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আমি অদৃশ্যের যেসব খবর বলি তা আমি নিজে থেকে বলি না বরং আল্লাহ আমাকে যতটুকু ওহীর মাধ্যমে জানান ততটুকুই জানি। আমি এটাও জানি না যে, তিনি আমার সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন? একইভাবে জানি না, তিনি তোমাদের সঙ্গে কি আচরণ করবেন? কাজেই আমার কিংবা তোমাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে কোনো কিছু জানার জন্য আমার কাছে বায়না ধরো না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- হাজার হাজার বছর ধরে যত নবী-রাসূল পৃথিবীতে এসেছেন তাদের সবার লক্ষ্য এবং শিক্ষা একই ছিল। তারা সবাই তৌহিদের বাণী প্রচার করেছেন।
২- সমাজের নেতৃস্থানীয় লোকদের উচিত জনগণের সঙ্গে সততার সঙ্গে কথা বলা এবং যে বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই সে বিষয়ে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দেয়া।
সূরা আহকাফের ১০ আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
قُلْ أَرَأَیْتُمْ إِنْ کَانَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَکَفَرْتُمْ بِهِ وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِنْ بَنِی إِسْرَائِیلَ عَلَى مِثْلِهِ فَآمَنَ وَاسْتَکْبَرْتُمْ إِنَّ اللَّهَ لا یَهْدِی الْقَوْمَ الظَّالِمِینَ ﴿١٠﴾
“বলুন, যদি এ (কুরআন) আল্লাহর নিকট হতে (অবতীর্ণ) হয়ে থাকে, আর তোমরা এতে অবিশ্বাস কর, অথচ বনী ইসরাইলের একজন এর (অর্থাৎ তাওরাতের) অনুরূপ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়ে এতে বিশ্বাস স্থাপন করল, আর তোমরা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, (তাহলে তোমাদের পরিণাম কী হবে) তা ভেবে দেখেছ কি? নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।” (৪৬:১০)
প্রখ্যাত তাফসির গ্রন্থগুলোতে এসেছে, হিজায অঞ্চলের একজন বিখ্যাত ইহুদি আলেমের নাম ছিল আব্দুল্লাহ বিন সালাম। তিনি বিশ্বনবী (সা.)-এর প্রতি ঈমান এনে ঘোষণা করেন, তাওরাত ও ইঞ্জিলে যে শেষনবীর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে আপনি হচ্ছেন সেই নবী। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের সামনে সত্য স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা গ্রহণ করলেও অন্যান্য ইহুদি আলেম তা করেনি। তারা বরং এই নওমুসলিমকে ভর্ৎসনা করে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তাদের এই কুফরির মূলে ছিল ঔদ্ধত্ব ও অহংকার।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- শত্রুদের সঙ্গে আলোচনার সময় গোঁড়ামি প্রদর্শন বা জোরপূর্বক নিজের বক্তব্যে অটল না থেকে আমাদের বলা উচিত: আমি আমার বক্তব্য তুলে ধরলাম। এখন আপনারা ভেবে দেখুন। যদি আমার কথা সত্য মনে হয় তাহলে তা গ্রহণ করুন। কিন্তু সত্য উপলব্ধি করার পর যদি তা গ্রহণ না করেন তাহলে কিন্তু এর মন্দ পরিণতির জন্য আপনারাই দায়ী থাকবেন।
২- গোঁয়ার্তুমি ও অহংকারের কারণে মানুষ আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে; উদাসীনতা বা নির্বুদ্ধিতার কারণে নয়।
৩- আল্লাহ ও তাঁর কালামে পাকের বিরুদ্ধাচরণ করা মানবজাতির প্রতি মস্তবড় জুলুম।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।