সূরা আহকাফ : আয়াত ১৫-১৮ (পর্ব-৪)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা আহকাফের ৪নং পর্ব নিয়ে আলোচনা। আরব উপত্যকায় আদ জাতির বসবাসের স্থান বালুকাময় মরুভূমি ছিল বলে এই জনপদকে আহকাফ বলা হতো। এই সূরার ২১ নম্বর আয়াতে ইনশাআল্লাহ আদ জাতির ঘটনা বর্ণনা করা হবে। আজ আমরা এই সূরার ১৫ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ১৫ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهًا وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلَاثُونَ شَهْرًا حَتَّى إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِينَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي إِنِّي تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ﴿۱۵﴾
“আর আমি মানুষকে তার মাতা-পিতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করে কষ্টের সাথে এবং প্রসব করে কষ্টের সাথে, তাকে গৰ্ভে ধারণ করতেও তার স্তন্য ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস। অবশেষে যখন সে পূর্ণ শক্তিপ্রাপ্ত হয় এবং চল্লিশ বছরে উপনীত হয়, তখন সে বলে, হে আমার রব! আপনি আমাকে সামর্থ্য দিন, যাতে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, আমার প্রতি ও আমার পিতা-মাতার প্রতি আপনি যে অনুগ্রহ করেছেন, তার জন্য এবং যাতে আমি এমন সৎকাজ করতে পারি যা আপনি পছন্দ করেন, আর আমার জন্য আমার সন্তান-সন্ততিদেরকে সংশোধন করে দিন, নিশ্চয় আমি আপনারই অভিমুখী হলাম এবং নিশ্চয় আমি আত্মসমর্পনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।” (৪৬:১৫)
পারিবারিক বন্ধনের প্রতি ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। বিয়ে করে সংসার গঠন, পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা ও সম্মানজনক ব্যবহার, সঠিক উপায়ে সন্তান প্রতিপালন, শান্তিপূর্ণভাবে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি এবং অতি জরুরি প্রয়োজনে তালাক দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব বিধান পবিত্র কুরআনে দেয়া হয়েছে।
এই আয়াত শুরু হয়েছে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সব মানুষকে সম্মোধন করে। এখানে সন্তান প্রতিপালনে পিতা-মাতার ভূমিকা বিশেষ করে মায়ের সীমাহীন কষ্টের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যাতে সন্তান তার পিতামাতার অনুগত থাকে ও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
দুঃখজনকভাবে বর্তমান পৃথিবী এতবেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে যে, বিবাহ করে পরিবার গঠনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। আবার যারা বিয়ে করছে তারাও একটি বা দু’টি সন্তান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকছে। এরইমধ্যে উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে এবং বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ইসলামের বিধান অনুযায়ী, ৪০ বছর বয়সে একজন মানুষের শারিরীক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্ণতা অর্জিত হয়। স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী এই বয়সি একজন মানুষের স্ত্রী ও সন্তানাদি থাকে। কিন্তু নিজের সন্তান থাকার অর্থ এই নয় যে, সে পিতামাতার প্রতি কর্তব্য ত্যাগ করবে বরং এ সময়ে পিতামাতার প্রতি তার আরো বেশি সদাচারণ করা উচিত।
সাধারণ দানের চেয়ে সদাচারণ অনেক বেশি অর্থবহ। এমন অনেক বাবা-মা আছেন যাদের অর্থসম্পদের প্রয়োজন নেই কিন্তু তারা সন্তানদের পক্ষ থেকে ভালোবাসা ও আন্তরিক ব্যবহারের পিয়াসী থাকেন। এ বয়সে তাদের শারিরীক অক্ষমতা চলে আসে এবং অনেক সময় ঘনিষ্ঠভাবে তাদের সেবা-সুস্রসা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এসব করতে গিয়ে আবার স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করা যাবে না। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের নেক সন্তান হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করতে হবে।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- সব বয়সেই পিতামাতার সঙ্গে সদয় আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। এক মুহূর্তের জন্যও এই দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা যাবে না।
২- সন্তানদের যদিও বাবা-মা উভয়েরই সেবা করতে হবে কিন্তু গুরুত্বের দিক দিয়ে মায়ের অধিকার এ কারণে বেশী যে, তিনি সন্তানের জন্য বেশী কষ্ট স্বীকার করেন।
৩- সন্তানকে গর্ভধারণ থেকে শুরু করে তাকে দুগ্ধদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে সন্তানের কাছে মায়ের বিশেষ গুরুত্ব তুলে ধরেছেন আল্লাহ তায়ালা।
৪- সন্তানদের প্রতিপালনে আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার পাশাপাশি পিতামাতার সেবা ও তাদের জন্য দোয়া করার কথা আল্লাহ তায়ালাই মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
সূরা আহকাফের ১৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
أُولَئِكَ الَّذِينَ نَتَقَبَّلُ عَنْهُمْ أَحْسَنَ مَا عَمِلُوا وَنَتَجَاوَزُ عَنْ سَيِّئَاتِهِمْ فِي أَصْحَابِ الْجَنَّةِ وَعْدَ الصِّدْقِ الَّذِي كَانُوا يُوعَدُونَ ﴿۱۶﴾
“আমি এদেরই সর্বোৎকৃষ্ট কর্মগুলো গ্রহণ করে থাকি এবং তাদের মন্দ কর্মগুলো ক্ষমা করে দিই, তারা জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত। এদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা সত্য প্রমাণিত হবে।” (৪৬:১৬)
এই আয়াতে আগের আয়াতের দিকনির্দেশনা পালনকারীদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে: তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করবেন এবং তিনি প্রতিশ্রুতি পালনে অটল। তবে জান্নাতে প্রবেশের শর্ত গুনাহের অপত্রিতা থেকে মুক্ত হওয়া। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নেক বান্দাদের গুনাহ আগে ক্ষমা করে দেবেন। পক্ষান্তরে তাদের নেক কাজগুলো সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় কবুল করে নেবেন। বান্দার প্রতি আল্লাহর একটি বড় দয়া হচ্ছে তিনি একটি নেক কাজের জন্য বহুগুণ পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- ইবাদত ও নেক আমল করতে হবে একনিষ্ঠার সঙ্গে সর্বোত্তম পন্থায়। তাহলেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
২- আল্লাহর ক্ষমা ও নেক আমল কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত পিতামাতার সঙ্গে সদাচারণ।
৩- যে কেউ মায়ের সেবা করবে সে জান্নাতের দরজা নিজের জন্য উন্মুক্ত রাখতে সক্ষম হবে।
সূরা আহকাফের ১৭ ও ১৮ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَالَّذِي قَالَ لِوَالِدَيْهِ أُفٍّ لَكُمَا أَتَعِدَانِنِي أَنْ أُخْرَجَ وَقَدْ خَلَتِ الْقُرُونُ مِنْ قَبْلِي وَهُمَا يَسْتَغِيثَانِ اللَّهَ وَيْلَكَ آمِنْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَيَقُولُ مَا هَذَا إِلَّا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ ﴿۱۷﴾ أُولَئِكَ الَّذِينَ حَقَّ عَلَيْهِمُ الْقَوْلُ فِي أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِمْ مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ إِنَّهُمْ كَانُوا خَاسِرِينَ ﴿۱۸﴾
“আর যে তার মাতা-পিতাকে বলে, আফসোস তোমাদের জন্য তোমরা কি আমাকে এ প্রতিশ্রুতি দাও যে, আমাকে [মৃত্যুর পর কবর থেকে] পুনরুত্থিত করা হবে অথচ আমার আগে বহু প্ৰজন্ম গত হয়েছে? [এবং আর কখনও জীবিত হয়নি?] তখন তার মাতা-পিতা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে [এবং তাদের সন্তানকে] বলে, দুর্ভোগ তোমার জন্য! তুমি ঈমান আনো, নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। তখন সে বলে, এ [প্রতিশ্রুতি] তো অতীত কালের উপকথা ছাড়া কিছুই নয়।”(৪৬:১৭)
“তাদের পূর্বে যে জিন ও মানবজাতি গত হয়ে গেছে, তাদের মতো এদের প্রতিও আল্লাহর আজাবের নির্দেশ অবধারিত হয়েছে। নিশ্চয় এরা ছিল ক্ষতিগ্রস্ত।” (৪৬:১৮)
কোনো কোনো পরিবারে এমন দুষ্ট প্রকৃতির কিছু সন্তান থাকে যারা তাদের পিতামাতার মনোকষ্টের কারণ হয়। তারা তাদের মুখের কথা দিয়ে পিতামাতাকে কষ্ট দেয়। এ ধরনের সন্তান যে শুধু পিতামাতার সঙ্গে সদাচারণ করে না তাই নয় বরং তাদের দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করতেও অস্বীকার করে। তারা পিতামাতার ধর্মীয় বিশ্বাসকে উপহাস করে এবং আল্লাহর রাসূলের দেয়া প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।
নিঃসন্দেহে এ ধরনের সন্তানদের পরিণতি হবে অতীত জাতিগুলোর জালিম ও পাপাচারি ব্যক্তিদের মতো। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মুসলিম পরিবারের কোনো কোনো সন্তান বখাটে হয়ে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় পিতামাতা যেন তাদেরকে প্রত্যাখ্যান না করে বা অভিশাপ না দেয়। বরং তারা যেন সন্তানের সুপথে ফিরে আসার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন এবং ওই সন্তানকে দাওয়াত দেয়ার কাজ চালিয়ে যান।
২- সন্তানকে দ্বীনের পথে রাখার জন্য পিতামাতাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে; যদি সে চেষ্টায় সাফল্য পাওয়া নাও যায়।
৩- যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালকে অস্বীকার করে সে তার পিতামাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে পারে না। সে পিতামাতাকে কষ্ট দেয় ও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।