সূরা আহকাফ : আয়াত ২৪-২৮ (পর্ব-৬)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা আহকাফের ৬ নং পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ২৪ থেকে ২৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ২৪ ও ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَلَمَّا رَأَوْهُ عَارِضًا مُسْتَقْبِلَ أَوْدِيَتِهِمْ قَالُوا هَذَا عَارِضٌ مُمْطِرُنَا بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُمْ بِهِ رِيحٌ فِيهَا عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴿۲۴﴾ تُدَمِّرُ كُلَّ شَيْءٍ بِأَمْرِ رَبِّهَا فَأَصْبَحُوا لَا يُرَى إِلَّا مَسَاكِنُهُمْ كَذَلِكَ نَجْزِي الْقَوْمَ الْمُجْرِمِينَ ﴿۲۵﴾
“অতঃপর যখন তারা তাদের উপত্যকার দিকে মেঘমালা আসতে দেখল তখন তারা বলল, ‘এ মেঘমালা আমাদেরকে বৃষ্টি দেবে’। (হূদ বলল, না। ) বরং এটি হচ্ছে সেই শাস্তি যা তোমরা ত্বরান্বিত করতে চেয়েছিলে। এ এক ঘুর্ণিঝড়, যাতে যন্ত্রণাদায়ক আযাব রয়েছে’।” (৪৬:২৪)
“এটা [এমন এক ঘুর্ণিঝড় যা] তার রবের নির্দেশে সব কিছু ধ্বংস করে দেবে। অতঃপর তাদের পরিণাম এই হলো যে, তাদের বসতিগুলো ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। এভাবে আমরা অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি।”(৪৬:২৫)
আদ জাতি গোয়ার্তুমি ও দম্ভের কারণে তাদের নবী হযরত হুদ (আ.)-এর দাওয়াতের বাণী প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলে, আমরা কিছুতেই আমাদের পূর্বপুরুষদের পথ থেকে সরে যাব না। তুমি যদি পারো তাহলে যে আজাবের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ তা নাজিল করে দেখাও। এভাবে নবীর দাওয়াতের বাণী পেয়েও যখন আদ জাতি তা প্রত্যাখ্যান করল তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের বসতির দিকে প্রচণ্ড ঘুর্ণিবায়ু পাঠালেন যা ঘন কালো মেঘ বহন করছিল। আদ জাতি আকাশে কালো মেঘ দেখে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল: তাদের জন রহমতের বৃষ্টিধারা আসছে। কিন্তু তাদের ধারনা মিথ্যা প্রমাণ করে প্রচণ্ড ঘুর্ণিঝড় সৃষ্টি হলো এবং তাদের বসতভিটা ছাড়া আর সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল।
সূরা হাক্কা’র ৭ নম্বর আয়াত অনুযায়ী, এই ঘুর্ণিঝড় সাত রাত ও আট দিন ধরে চলে এবং দাম্ভিক ও গোনাহগার আদ জাতিকে আল্লাহ তায়ালা সমূলে ধ্বংস করে দেন। ওই জাতির একটি লোকও প্রাণে বাঁচতে পারেনি। এই ঘটনা বর্ণনা করে সকল অপরাধী ও দাম্ভিক সম্প্রদায় এবং একগুঁয়ে কাফেরদের এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, আদ জাতির মতো অপরাধ করলে তাদের পরিণতিও এর চেয়ে ভালো হবে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মহাসত্য আল্লাহর সঙ্গে আড়ি দিলে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। অতীত জাতিগুলোর পরিণতি থেকে আমাদের এই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
২- বাতাস ও মেঘমালাসহ এ ধরনের প্রাকৃতিক বিষয়গুলো যেমন আল্লাহর দয়া ও রহমতস্বরূপ তেমনি এই বিষয়গুলোই তাঁর ক্রোধ ও আজাবের নিদর্শন হতে পারে।
সূরা আহকাফের ২৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَلَقَدْ مَكَّنَّاهُمْ فِيمَا إِنْ مَكَّنَّاكُمْ فِيهِ وَجَعَلْنَا لَهُمْ سَمْعًا وَأَبْصَارًا وَأَفْئِدَةً فَمَا أَغْنَى عَنْهُمْ سَمْعُهُمْ وَلَا أَبْصَارُهُمْ وَلَا أَفْئِدَتُهُمْ مِنْ شَيْءٍ إِذْ كَانُوا يَجْحَدُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَحَاقَ بِهِمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ ﴿۲۶﴾
“আর অবশ্যই আমি তাদেরকে [অর্থাৎ আদ জাতিকে] যে অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছিলাম তোমাদেরকে [অর্থাৎ মক্কাবাসীকে] সে নেয়ামত দেইনি; আর আমি তাদেরকে দিয়েছিলাম কান, চোখ ও অন্তর; কিন্তু তাদের কান, চোখ ও অন্তর তাদের কোন কাজে আসেনি; কারণ, তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করছিল। আর যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত, [অবশেষে] তা-ই তাদেরকে পরিবেষ্টন করল।”(৪৬:২৬)
এক সময় মক্কা নগরীর কাছেই ছিল আদ জাতির আবাসস্থল এবং মক্কাবাসী চলাচল করার সময় ওই জাতির ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেত। এ কারণে মহানবী (সা.)-এর দাওয়াতের বাণী প্রত্যাখ্যানকারী মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশ করে এই আয়াতে বলা হচ্ছে: আদ জাতির মানুষ দৈহিক শক্তি ও ধনসম্পদের দিক দিয়ে তোমাদের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এসব সম্পদ তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারেনি। শুধুমাত্র আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করে তাঁর ইবাদত করতে রাজি হলেই তারা বাঁচতে পারত। দেখার জন্য তাদের চোখ ছিল, শোনার জন্য কান ছিল এবং উপলব্ধি করার জন্য অন্তর ছিল। কিন্তু যা দেখার, শোনার ও উপলব্ধি করার জন্য তাদেরকে এসব দেয়া হয়েছিল তারা সেই মহাসত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। তারা ভেবেছিল শারিরীক শক্তি ও ধনসম্পদ দিয়ে তারা যেকোনো শাস্তি মোকাবিলা করতে পারবে। এজন্য তারা তাদের নবী হযরত হুদের দাওয়াতের বাণীকে উপহাস করেছিল।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- ক্ষমতা ও ধন-সম্পদ মানুষের রক্ষাকবচ নয়। বরং চোখ, কান ও অন্তর দিয়ে আল্লাহকে চেনা এবং তাঁর আনুগত্য করার মধ্যেই রয়েছে মুক্তি ও সৌভাগ্যের চাবিকাঠি।
২- আল্লাহর আয়াত ও নবী-রাসূলদের সতর্কবাণীকে উপহাস করলে পার্থিব জীবনেই আল্লাহর ক্রোধের শিকার হতে হয়।
সূরা আহকাফের ২৭ থেকে ২৮ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَلَقَدْ أَهْلَكْنَا مَا حَوْلَكُمْ مِنَ الْقُرَى وَصَرَّفْنَا الْآيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ﴿۲۷﴾ فَلَوْلَا نَصَرَهُمُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ قُرْبَانًا آلِهَةً بَلْ ضَلُّوا عَنْهُمْ وَذَلِكَ إِفْكُهُمْ وَمَا كَانُوا يَفْتَرُونَ ﴿۲۸﴾
“নিঃসন্দেহে আমি ধ্বংস করেছিলাম তোমাদের চারপাশের জনপদসমূহকে এবং আমি তাদের সামনে বিভিন্নভাবে আমার নিদর্শনাবলী তুলে ধরেছিলাম, যাতে তারা [সৎপথে] ফিরে আসে।”(৪৬:২৭)
“অতঃপর, তারা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিল, তারা তাদেরকে সাহায্য করল না কেন? বরং তাদের উপাস্যগুলো তাদের কাছ থেকে উধাও হয়ে গেল। আর এই হল তাদের মিথ্যা ও অলীক উদ্ভাবনের পরিণাম।”(৪৬:২৮)
এই আয়াতে বলা হচ্ছে, শুধু আদ জাতি নয়, মক্কার চারপাশে আরো বহু জাতি ছিল যাদেরকে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করার অপরাধে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আরব উপত্যকার উত্তর অংশে সামুদ জাতি এবং দক্ষিণ অংশে সাবা জাতির কথা উল্লেখ করা যায়। আল্লাহ বলছেন, এসব জাতির উপলব্ধি করার ক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সামনে আমার নিদর্শনাবলী তুলে ধরেছিলাম যাতে তারা তাদের শিরক ও মূর্তিপূজা চালিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো অজুহাত তুলে ধরতে না পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাদের কাল্পনিক উপাস্যগুলোকে নিজেদের মুক্তি ও সৌভাগ্যের মাধ্যম মনে করে সেগুলোর উপাসনা করতে থাকে। কিন্তু আল্লাহর আজাব এসে গেলে সেসব উপাস্য ওইসব জাতিকে রক্ষা করা তো দূরের কথা নিজেদের অস্তিত্বই রক্ষা করতে পারেনি। মহা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ওইসব জাতি ও তাদের সব উপাস্য ও মূর্তি ধ্বংস হয়ে যায়।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দু’টি বিষয় হচ্ছে:
১- মানুষের হেদায়েত প্রাপ্তি ও আল্লাহকে চেনার উপকরণ প্রকৃতিতেই দিয়ে রেখেছেন মহান আল্লাহ। কাজেই বিভ্রান্তির বেড়াজাল ছিন্ন করে মহাসত্য চেনার সিদ্ধান্ত মানুষকেই গ্রহণ করতে হবে।
২- বেদআত, খোরাফাত ও অলীক কল্পনার কারণে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এমন কিছুর উপাসনা করে যেগুলোর সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।