অক্টোবর ১৫, ২০২১ ২১:১০ Asia/Dhaka

করোনা পরবর্তী নিদ্রাহীনতাসহ বেশ কিছু জটিল পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কবীরুল হাসান রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনাটি তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন আশরাফুর রহমান। আর উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

শ্রোতাবন্ধুরাস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথা'র আজকের আসরে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদআপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, করোনাভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত রোগীর ৮০ শতাংশেরও বেশি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু কারও কারও কোভিডের উপসর্গ ও জটিলতা দীর্ঘদিন থেকে যায়। অনেকে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত ভুগতে পারেন। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘লং কোভিড সিনড্রোম' বলা হচ্ছে। গবেষকরা বলেছেন যে, আক্রান্ত রোগীর শরীরের এমন কোনো অঙ্গ নেই যেখানে করোনা ভাইরাস তার ধ্বংসলীলা চালায় না। তাই সুস্থ হওয়ার পরও সব ভোগান্তির অবসান হয় না।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! করোনা পরবর্তী সমস্যা বা জটিলতাসমূহ এবং সেগুলো দূর করতে করণীয় সম্পর্কে আমরা কথা বলেছি ঢাকার মহাখালীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কবীরুল হাসান বিন রকীবের সঙ্গে। আজ শুনুন দুই পর্বের অনুষ্ঠানটির দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।

গাজী আবদুর রশীদ: ডা. কবীরুল হাসান, দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার শুরুতে যে বিষয়টি জানতে চাইব- সেটি হচ্ছে কোভিড পরবর্তী সময়ে নিদ্রাহীনতা থেকে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি কী উপায়ে স্বাভাবিক জীবনে আসতে পারে?

ডা. কবীরুল হাসান: কোভিড পরবর্তী সময়ে নিদ্রাহীনতা একটি বড় সমস্যা। এসময় সবাইকে নিয়মিত সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। ক্লান্তি লাগলে বিশ্রাম নিতে হবে। দিনে না ঘুমানোই শ্রেয়। ধূমপান পরিহার করতে হবে। সন্ধ্যার পর চা এবং কফি খাওয়া উচিত নয়। পারতপক্ষে শোয়ার ঘর শুধুমাত্র ঘুমানোর কাজে ব্যবহার করা উচিত। রাত জেগে টিভি কিংবা কম্পিউটার দেখা উচিত নয়। রাতে কেবলমাত্র ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। পনের বিশ মিনিটের চেষ্টায় যদি ঘুম না আসে সেক্ষেত্রে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়া উচিত। নিয়মিত হাঁটা এবং ব্যায়াম করা ঘুমানোর জন্য সহায়ক। স্লিপিং পিলের প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রেডিও তেহরান: ডা. কবীরুল হাসান, আক্রান্ত রোগী কোভিড পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিসে ভুগতে থাকলে কিংবা কোন রোগীর ডায়াবেটিসের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিতভাবে উঠানামা করতে থাকলে কি করা উচিত হবে?

ডা. কবীরুল হাসান: আক্রান্ত রোগী কোভিড পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিসে ভুগতে থাকলে কিংবা কোনো রোগীর ডায়াবেটিসের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিতভাবে উঠানামা করতে থাকলে সতর্কতা জরুরি। এসময় যারা আগে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন করোনা পরবর্তী সময়ে তাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। আবার অনেকের আগে ডায়াবেটিস ছিল না কিন্তু করোনাকালে ব্যবহৃত ওষুধ কিংবা স্টরয়েড বা ভাইরাসের প্রভাবে ডায়াবেটিস ও রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নতুন করে বেড়ে যেতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সমস্যা সাময়িক। কিছুদিন পর এটি এমনিতেই স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে যদি সময়ের সঙ্গে রক্তের গ্লুকোচের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না আসে সেক্ষেত্রে দরকার হয় বাড়তি সতর্কতার। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে অতিরিক্ত ইনস্যুলিন দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। সতর্ক থাকতে হবে যাতে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা খুব কম কিংবা খুব বেশি না হয়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গেলে অর্থাৎ হাইপোগ্লাইসোমিয়ার উপসর্গ দেখা দিলে পনের গ্রাম পরিমাণ তরল শর্করা  পর্যন্ত গ্লুকোজ, মধু, লজেন্স বা জুস খাওয়া যেতে পারে। খাওয়ার পনের মিনিট পর রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কোনো ওষুধ খাওয়া উচিত নয় কিংবা ইনস্যুলিন নেয়া উচিত নয়।

গাজী আবদুর রশীদ: ডা. কবীরুল হাসান, অসহনীয় শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টায় কী ধরনের খাবার বা প্রতিষেধক গ্রহণ করা যায়?

ডা. কবীরুল হাসান: কোভিড পরবর্তী সময়ে অসহনীয় শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে কিছু খাবার ও কিছু জরুরি টিপস সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে। এসময় পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। খাবার হতে হবে হালকা এবং সহজপাচ্য। অতিরিক্ত চিনি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। সঠিক ও সুষম খাবার খেতে হবে। প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খেতে হবে। মাঝে মাঝে খিঁচুড়ি খাওয়া যেতে পারে। খাদ্য তালিকায় আমিষ ও শর্করার পাশাপাশি টাটকা শাক-সবজি ও ফলমূল রাখতে হবে। প্রতিদিনের রুটিং এ কিছু জরুরি টিপস অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন- হালকা ব্যয়াম দিয়ে ফিটনেস চর্চা শুরু করা, ধীরে হাঁটা, শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম ও মেডিটেশন, প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ মিনিট সূর্যের আলোতে সময় কাটানো। প্রতিরাতে তাড়াতাড়ি ঘুমুতে যাওয়া এবং কমপক্ষে সাত থেকে আট ঘন্টা ঘুমানো।

রেডিও তেহরান: অনেক রোগীর ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা Lung Infection না থাকলেও দীর্ঘ মেয়াদি হয় সেক্ষেত্রে কি দুশ্চিন্তার কোনো কারণ আছে?

ডা. কবীরুল হাসান: অনেক রোগীর লাং ইনফেকশন না থাকলেও শ্বাস প্রশ্বাসের জটিতা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। তাঁদের জন্য অবশ্যই সতর্কতার দরকার আছে। চীনের ইউহান শহরে প্রথম ছড়ায় করোনা ভাইরাস। সেখানে গবেষণা করে দেখা গিয়েছে লক্ষণহীন আক্রান্ত ফুসফুসের টিস্যুতে ক্ষত রয়েছে। কোভিড ১৯ ছাড়াও একাধিক কারণে এমনটি হতে পারে। শ্বাসকষ্ট কিংবা নিউমোনিয়ায় ভুগছেন না এমন উপসর্গহীন কোভিড রোগীর ফুসফুসে এ ধরণের ক্ষত চিন্তার কারণ বটে। ফুসফুসে ইনফেকশন না থাকা সত্ত্বেও অনেকে শ্বাসকষ্টে ভুগতে পারেন। হাঁপিয়ে যেতে পারেন অনেকে অল্পতেই। এরপেছনে ফুসফুসের পেছনে  ছোট ছোট রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধা একটি কারণ হিসেবে পরিগণিত করা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামের পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রেডিও তেহরান: ডা.কবীরুল হাসান সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইছি, একজন মানুষ কতটা সচেতন হলে কিংবা কিভাবে চললে কোভিডে আক্রান্ত হলেও দ্রুত সুস্থ জীবনে ফিরতে পারে?

ডা. কবীরুল হাসান: একজন মানুষ কতটা সচেতন হলে কিংবা কিভাবে চললে কোভিডে আক্রান্ত হলেও দ্রুত সুস্থ জীবনে ফিরতে কিছু করণীয় মেনে চলতে হবে। যেমন প্রতিদিন সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল জাতীয় খাবার স্বাস্থের জন্য উপকারী। টাটকা শাক শবজি ও ফলমূল খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। ধূমপান পরিহার করতে হবে। কফি না খাওয়াই শ্রেয়। মোবাইল ফোনের আসক্তি কমাতে হবে। প্রতিদিন সঠিক সময় ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে। প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা ও ব্যায়ামের চেষ্টা করতে হবে।  

তো ডা. কবীরুল হাসান, কোভিড জটিলতা নিয়ে দুই পর্বের আলোচনায় আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ডা. কবীরুল হাসান: আপনাদেরকে এবং রেডিও তেহরানের অগণিত শ্রোতাকেও আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।

গাজী আবদুর রশীদ: শ্রোতাবন্ধুরা, স্বাস্থ্যকথার আজকের আসর থেকে বিদায় নেয়ার আগে আপনাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি,  করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আপনারা সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, মাস্ক পরুন, হাত সেনিটাইজড করুন, পুষ্টিকর খাবার খান, ব্যায়াম করুন এবং কোভিড পরবর্তী জটিলতা থেকে মুক্ত থাকতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন- তাহলে আপনারা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। সবাই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন ও নিরাপদে থাকুন।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/ ১৫

ট্যাগ