ইসলামী সভ্যতার নয়া নকীব ইমাম খোমেনী (রহ.)
‘ইসলামী সভ্যতার নয়া নকীব ইমাম খোমেনী (র)’ শীর্ষক আলোচনা। ইসলামী সভ্যতার পুননির্মাণের নকীব ও হাজার বছরের সেরা বিশ্ব-কাঁপানো ইসলামী বিপ্লবের মহানায়ক মরহুম ইমাম খোমেনীর মৃত্যু বার্ষিকীতে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।
রক্ত ও ঘৃণার মাঝে ইরান মুহ্যমান/ অথচ আকাশে তখনও নেই জিবরাইলের ডানা/ আসে না খোদার বার্তাবাহক শান্তির নব নবী/নবীরা আসে না তবুও খোমেইনে একদিন কাঁপে মাটি / নীল আসমানে কেঁপে ওঠে ঝড় মানুষের মুনাজাতে...গাছেরা দোলায় সবুজ পতাকা নুরের তাজাল্লীতে/ হাজেরার কোলে এ কোন শিশু এমন মোহন রূপ/ পিতা মুস্তফা শোনে সেই মুখে শাহাদাৎ উথলায়/ এতো শিশু নয় হাজেরার কোলে নতুন ইসমাইল/ যেন বনি ইসরাইলের মধ্যে এলেন মুসা ... মুহূর্তে গনগন করে দেশ-রাহবর ওই এলো/ টগবগ করে ফুটে ওঠে দেশ-রাহবার ওই এলো/ শত যন্ত্রণা ফুল হয়ে ফোটে –রাহবার ওই এলো... ইমাম তুমি তাকালে সামনে জালিমের জিন্দান/ভেঙ্গে খান খান নমরুদ, আর ফেরাউন ভূপাতিত/ইমাম তুমি দু'হাত বাড়ালে ওমনি ফুটলো গোলাপ/বারুদে বারুদে জাগালে দারুণ জীবনের অঙ্কুর/ ইনসানিয়াত তোমার গর্বে পৃথিবীর পথে পথে/ ফেরি করে আজ নতুন শরাব স্বপ্নের কলরব/ সাম্য শান্তি মৈত্রীর বরাভয়/...ইমাম তোমার আলখেল্লায় আবেহায়াতের ছায়া / দু'চোখে তোমার মুহাম্মদের প্রেম/যুদ্ধ ও প্রেমে মহিমান্বিত আলীর জুলফিকার/আলবুর্জের শিখরের চেয়েও মস্তক যার উঁচু ... ইমাম তোমার কণ্ঠে আমার মুহাম্মাদের নাম। (আবদুল হাই শিকদার)

ইমাম খোমেনী (র.) আধুনিক যুগে প্রথমবারের মত ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমা বিশ্ব-ব্যবস্থা আর সংস্কৃতির আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্ব-রাজনীতি ও বিশ্ব-ব্যবস্থার ভিতকে কাঁপিয়ে তোলেন বার বার। খোদাবিমুখ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কথিত পরাশক্তিগুলোর আধিপত্যকে অবজ্ঞা করে তিনি ইসলামকে তুলে ধরেছেন সমসাময়িক যুগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং শক্তি হিসেবে। তাঁর নেতৃত্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গালে ইরানি জাতির প্রবল চপেটাঘাত ইবলিসি শক্তিগুলোর একাধিপত্যকে নড়বড়ে করে দেয়। বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে ইসলামী শক্তির এমন প্রবল উত্থান আর কখনও ঘটেনি। প্রাচ্যও নয় পাশ্চাত্যও নয় ইসলামই শ্রেষ্ঠ -বর্তমান যুগে এমন ধারণার বলিষ্ঠ নজির হয়ে দেখা দেয় ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বাধীন ইরান।
" ইসলাম ধর্ম মেনেই স্বাধীনতা অর্জন" ছিল ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বৈশ্বিক বার্তা। অথচ সমাজবাদী ও লিবারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার কর্তৃত্বাধীন আধুনিক বিশ্বে ধর্মীয় আইন-ভিত্তিক সমাজ-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ছিল অকল্পনীয়। ইমাম খোমেনী (র.) ছিলেন প্রজ্ঞাবান, প্রবল আত্মবিশ্বাসী ও অকুতোভয়। এ ছিল এই বিপ্লবের এক বিরল সৌভাগ্য। নবী-বংশের রক্তধারী এই ইমাম সময়ের গতি-প্রকৃতি বুঝতেন। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা, গভীর দরদ ও আকুতি ইসলামী জাগরণকে করেছে বেগবান। তাঁর নেতৃত্বের কারণেই ইরানি জাতি পরাশক্তিগুলোর প্রভাব এবং অবসাদ ও হতাশার মত শয়তানী শক্তিগুলোকে দুর করতে সক্ষম হয়। ইমাম ছিলেন দ্বিধাহীন ও নিঃশঙ্ক আত্মত্যাগের প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইরানি জনগণের ওপর তিনি ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে জোর করে চাপিয়ে দেননি যদিও তাদের অবিসম্বাদিত নেতা হিসেবে তিনি তা করতে পারতেন। তিনি গণভোটের আশ্রয় নিয়ে জনগণের সম্মতির ভিত্তিতেই ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হন যা হাজার বছরের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
ইমাম খোমেনী (র.)’র ব্যাপক দূরদৃষ্টি ও ইস্পাত-কঠিন খোদায়ী সংকল্প তাঁকে দিয়েছে কিংবদন্তীতুল্য জনপ্রিয়তা। তিনি খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলামের চেতনায় জাগিয়ে তুলেছিলেন ইরানের আলেম সমাজ ও জনগণকে। ইমামের খোদাভীতি ও একনিষ্ঠতাও ছিল বিশ্বনবী (সা.)’র নুরানি আদর্শের প্রতিফলন। ফলে তাঁর দিক-নির্দেশনার সুবাদে ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার প্রেরণায় ইরানি জাতি এতটা উজ্জীবিত হয়েছিল যে তাদের সব স্তরে, বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে জিহাদ ও শাহাদতের সংস্কৃতির বিস্ময়কর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। আর এ বিষয়টি বিশ্ববাসীকে অভিভূত করেছে।
ইমাম খোমেনী (রহ.) এমন একটি ঐতিহ্যের ধারার সফল পরিপূর্ণতাদানকারী যে ধারার আলোকে ইরানের আলেম, জনগণ এবং এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও মুজতাহিদ ফকিহদের আনুগত্য করতেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক হামিদ আলগার বলেছেন: "আয়াতুল্লাহ খোমেনী মানবাদর্শের এক মূর্ত প্রতীক। তিনি কেবল নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক যোগ্যতার এক অপূর্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে ইরানে এরূপ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন। … রাজনৈতিক বিপ্লব পরিচালনায় তার অতুলনীয় ভূমিকা তার পণ্ডিত, দার্শনিক ও আধ্যাত্মবাদী পরিচিতিকেও ছাড়িয়ে গেছে।...১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি দেশে ফিরে আসলেও কোনো সম্পদ, দল গঠন ও গেরিলা যুদ্ধ ও বিদেশী সাহায্য ছাড়াই তিনি ইসলামী আন্দোলনের তর্কাতীত নেতৃত্বে সমাসীন হন। "

মরহুম ইমাম খোমেনীর ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তি। ন্যায়ের প্রশ্নে তিনি কখনও আপোষ করতেন না। অনেকেই যখন ইমাম খোমেনীকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করার তখন তিনি তাদের এই উপদেশে কান দেননি। তাদের যুক্তি ছিল এটা যে যখন বিশ্বের বৃহত্তম অনারব সুন্নি রাষ্ট্র তুরস্ক ও বিশ্বের বৃহত্তম আরব রাষ্ট্র মিশরও দখলদার বর্ণবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে তখন আমরা কেন ইরানকে বিপদাপন্ন করব? কিন্তু ইমাম তাদের এ পরামর্শে কান না দিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। .. আর এটাই হল ইসলামের আপোষহীন ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি। আর এমন মহান ব্যক্তি আসলেই ইসলাম ও মুসলমানের জন্য এক মহা-ঐশী উপহার।
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)'র নেতৃত্বে সংঘটিত মহান কারবালা বিপ্লবের অনন্য আত্মত্যাগের দর্শন ও শিক্ষার পুনরুজ্জীবন ইমাম খোমেনীর সাফল্যের আরেকটি বড় কারণ। ইমাম খোমেনী (র.) নারীসহ সব শ্রেণীর মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সা.)’র আদর্শকে তুলে ধরতেন। ইমাম খোমেনী (র.) ছিলেন অনাড়ম্বর জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। বিশ্বের বড় বড় দেশের নেতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা ইমামের বাসভবনের অতি সাধারণ অবস্থা দেখে বিস্মিত হতেন।
বিশ্ব ইতিহাসের গতি পরিবর্তনকারী এক অসাধারণ, বরেণ্য ও শক্তিশালী নেতা হওয়া সত্ত্বেও ইমাম খোমেনি ছিলেন সদালাপী, অত্যন্ত বিনয়ী ও নিরহংকার। তিনি বলতেন, আমি জনগণের একজন সেবক মাত্র, আমাকে নেতা না বলে সেবক বলাই ভাল হবে।
আল্লাহর প্রতি ইমাম খোমেনী (র.)'র সুগভীর নির্ভরতা থেকে উদ্ভূত তাঁর নানা বক্তব্য এবং এই গভীর আস্থার ফলে সৃষ্ট তাঁর সদা-প্রশান্ত চিত্ত পরিদর্শকদের মুগ্ধ করত। তাই বাহ্যিক দৃষ্টিতে ইমামের অনেক কথা খুব সাধারণ মনে হলেও শ্রোতাদের মধ্যে তা গভীর প্রভাব ফেলত।
ইমাম খোমেনীর ডাকে সাড়া দিয়েই ইরানি জাতি ৮ বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষার এক অনন্য নজির গড়ে তোলে যা ইরানকে দিয়েছে অনন্য বিজয়, মর্যাদা এবং সামরিক স্বনির্ভরতা ও সাম্রাজ্যবাদীদের বুকে কাঁপন-ধরানো জিহাদের অমর গৌরব।
ইমাম খোমেনী (র) সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম জাতিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে সব সময় সক্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক যুগে ইসলামী ঐক্যের প্রধান রূপকার। মুসলিম বিশ্বের প্রধান সংকট সমাধানের লক্ষ্যে তথা মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসাকে পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি প্রবর্তন করেন বিশ্ব-কুদস দিবস যা পালন করা হয় প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবারে। তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়ে উঠেছে ইসরাইল বিরোধী অদম্য বিজয়ী শক্তি লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনের ইসলামী জিহাদ ও হামাস। ইহুদিবাদী ইসরাইলের মোকাবেলায় এইসব সংগ্রামী দলের গত কয়েক দশকের ও সাম্প্রতিক সাফল্য ইমাম খোমেনীর আদর্শিক অনুপ্রেরণার কাছে ঋণী । শহীদ সুলায়মানি তাঁরই আদর্শের অন্যতম ফসল।
পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা)’র প্রতি অবমাননাকারী কুখ্যাত মুরতাদ সালমান রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ঐতিহাসিক ফতোয়া দিয়ে ইমাম খোমেনী (র) পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ক্রুসেডের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন। বিশ্বনবীর (সা) সুন্নত অনুসরণ করেই ইমাম তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভের কাছে ইসলামের দাওয়াত পাঠিয়েছিলেন এবং সমাজতন্ত্র জাদুঘরে স্থান পাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ইমামের ওই ভবিষ্যদ্বাণী কয়েক বছরের মধ্যেই সফল হয়েছিল। মার্কিন সরকারই যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শয়তান ইমাম খোমেনিই তা বিশ্ববাসীর কাছে সবার আগে তুলে ধরেছিলেন। এই শয়তানও যে অপরাজেয় নয় বরং তাগুতি শক্তি ও শয়তানের পতন যে অনিবার্য ইমাম খোমেনি সংগ্রামী মুসলমানদের মধ্যে এই ধারণাকে একনিষ্ঠ বিশ্বাসে পরিণত করতে চেয়েছিলেন যে বিশ্বাস বাস্তব হয়ে ওঠার পদধ্বনি এখন আরও স্পষ্ট।
মরহুম ইমাম খোমেনীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে আবারও গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।#
পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/০৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।