মার্চ ৩১, ২০২৪ ১৬:২৯ Asia/Dhaka
  •  আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী(আ.)'র শোকাবহ শাহাদাত

এই দিনে পৃথিবী হারিয়েছিল বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ও শ্রেষ্ঠ অনুসারীকে, হারিয়েছিল বিশ্বনবীর জ্ঞান-নগরীর মহাতোরণকে, হারিয়েছিল রাসূল (সা.)'র পর সবচেয়ে দয়ালু ও উদার আত্মার অধিকারী মানুষ এবং হেদায়েতের উজ্জ্বলতম প্রদীপকে। সেদিন মুসলিম বিশ্ব তার অত্যন্ত দুঃসময়ে হারিয়েছিল সাধনা ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতার সর্বোত্তম আদর্শকে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মহানবীর নিজ হাতে গড়ে তোলা ইসলামের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও সবচেয়ে আপোষহীন নেতাকে।

কিন্তু অকাল-মৃত্যু সত্ত্বে আমীরুল মু'মিনীন হযরত আলীর শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের স্বর্গীয় আলোকোজ্জ্বল প্রভা যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পরতে পরতে আদর্শ মুমিনের কর্মতৎপরতার গভীরে অতুলনীয় ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে। সেই আমীরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে সবার প্রতি আমরা জানাচ্ছি অশেষ সমবেদনা।  

আলী (আ.) ছিলেন যুবকদের জন্য বীরত্ব ও সাহসিকতার আদর্শ, সরকার-প্রধানদের জন্য ন্যায়বিচারের আদর্শ, ইবাদত, খোদাপ্রেম ও ভারসাম্যপূর্ণ অনাড়ম্বর জীবনের জন্য সব মুমিন মুসলমানের জন্যই আদর্শ। তাঁর মুক্তিকামীতা বিশ্বের সব মুক্তিকামীর আদর্শ এবং প্রজ্ঞাময় বক্তব্য ও চিরস্মরণীয় উপদেশগুলো আলেম, বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের জন্য আদর্শ।

আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব নদী-দখলকারী শত্রুরা যার বাহিনীর জন্য নদীর পানি ব্যবহার নিষিদ্ধ করলে সেই  শত্রুদের পরাজিত করার পরও তিনি ওই নদীর পানি  কোনো শত্রুর জন্য নিষিদ্ধ করেননি। জালিমদের বিরুদ্ধে আলী (আ.) সবচেয়ে কঠোর হলেও তিনি ব্যক্তিগত ক্রোধের বশে নয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাদের ওপর আঘাত হানতেন। সিফফিনের যুদ্ধের প্রাক্কালে উভয়পক্ষের লোকক্ষয় এড়ানো ও বিদ্রোহীদের সুপথে আনার জন্য তিনি এত বেশী অপেক্ষার নীতি গ্রহণ করেছিলেন যে, সে সময় শত্রুরা এ প্রচারণা চালিয়েছিল যে মহাবীর আলী (আ.) মৃত্যুকে ভয় পান!  অথচ শিশুর কাছে মাতৃস্তন যতটা প্রিয় শাহাদত ছিল আলীর কাছে তার চেয়েও বেশি প্রিয়।

হযরত আলী (আ.) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, মুসার সাথে হারুনের যে সম্পর্ক তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক, শুধু পার্থক্য হল হারুন (আ.) নবী ছিলেন, তুমি নবী নও। রাসূল (সা.) বলেছেন, "আমি জ্ঞানের নগরী, আলী তার দরজা, যে কেউ আমার জ্ঞানের মহানগরীতে প্রবেশ করতে চায় তাকে এ দরজা দিয়েই আসতে হবে"।

মহানবী (সা:) আরো বলেছেন:হে আম্মার! যদি দেখ সমস্ত মানুষ একদিকে চলে গেছে, কিন্তু আলী চলে গেছে অন্য দিকে, তবুও আলীকে অনুসরণ কর, কারণ, সে তোমাকে ধ্বংসের দিকে নেবে না। বিশ্বনবী (সা:) আরো বলেছেন: *আমি আলী থেকে,আর আলী আমার থেকে,যা কিছু আলীকে কষ্ট দেয়,তা আমাকে কষ্ট দেয়,আর যা কিছু আমাকে কষ্ট দেয় তা আল্লাহকে কষ্ট দেয়।* হে আলী! ঈমানদার কখনও তোমার শত্রু হবে না এবং মোনাফেকরা কখনও তোমাকে ভালবাসবে না। অনেক সাহাবী এ হাদিসের ভিত্তিতেই মোনাফেকদের সনাক্ত করতেন।

মহানবী (সা) আলী সম্পর্কে আরও বলেছেন, আল্লাহকে ভালভাবে চেনেন শুধু আমি আর আলী। আর আলীকেও পুরোপুরি চেনেন শুধু আল্লাহ আর আমিকুরআন ও সত্য সব সময় আলীর সঙ্গে থাকবে বলে মহানবী উল্লেখ করেছেন। মহানবী আরও বলেছেন, আমার পরে সাহাবিদের মধ্যে কেবল আলীই কুরআনের মর্যাদা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করবে।

ওয়াশিংটন আরভিং বলেছেন,"সব ধরনের নীচতা ও কৃত্রিমতা বা মিথ্যার বিরুদ্ধে আলী (আ.)'র ছিল মহত সমালোচনা এবং আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রীক সব ধরনের কূটচাল থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন।"ঐতিহাসিক মাসুদির মতে,রাসূল (সা.)'র চরিত্রের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল যার ছিল তিনি হলেন আলী (আ.)।

শাহাদত-প্রেমিক আলী(আ.) যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত,তাঁর সঙ্গীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত,সবাই কাঁদছে,চারিদিকে ক্রন্দনের শব্দ,কিন্তু আলী (আ.)-এর মুখ হাস্যোজ্জ্বল। তিনি বলছেন,“আল্লাহর শপথ! আমার জন্য এর চেয়ে উত্তম কি হতে পারে যে, ইবাদতরত অবস্থায় শহীদ হব?” হযরত আলী (আঃ) নিজেকে সব সময় জনগণের সেবক বলে মনে করতেন এবং সব সময় অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। দ্বিতীয় খলিফা বলেছেন,আলী ইবনে আবি তালিবের মতো আরেকজনকে জন্ম দেয়ার ক্ষমতা নারীকুলের কারো নেই,আলী না থাকলে ওমর ধ্বংস হয়ে যেত। জীরার ইবনে হামজা তাঁর প্রিয় নেতার গুণাবলী তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলেন,

"আলীর ব্যক্তিত্ব ছিল সীমাহীন,তিনি ক্ষমতায় ছিলেন দোর্দণ্ড,তাঁর বক্তব্য ছিল সিদ্ধান্তমূলক, তাঁর বিচার ছিল ন্যায়ভিত্তিক,সব বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল,তাঁর প্রতিটি আচরণে প্রজ্ঞা প্রকাশিত হত। ..তিনি ধার্মিকদের খুব সম্মান করতেন ও অভাবগ্রস্তের প্রতি ছিলেন খুবই দয়ালু । … তিনি দুনিয়া ও এর চাকচিক্যকে ঘৃণা করতেন। আমি আলী ইবনে আবি তালিবকে গভীর রাতে বহুবার মসজিদে দেখেছি যে তিনি নিজ দাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে এমনভাবে আর্তনাদ করতেন যেন সাপে কামড় খাওয়া মানুষ এবং শোকাহত লোকের মতো রোদন করে বলতেন, হে দুনিয়া, ওহে দুনিয়া, আমার কাছ থেকে দূর হও! আমাকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো না!" 

কোনো একটি বর্ণনার মূল বক্তব্য থেকে জানা যায় হযরত আলীর শাহাদাতের কিছুক্ষণ আগে পরিবারের শোকাহত সদস্য ও প্রিয়জনদের বলছিলেন, আমি যা দেখছি তোমরাও যদি তা দেখতে তাহলে কাঁদতে না! আমি দেখতে পাচ্ছি নবী-রাসুলবৃন্দ আমাকে সম্বর্ধনা জানাতে সারি দিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আমার পাশেই বসে আছেন রাসুলে পাক (সা)! তিনি বলছেন, আলী শিগগিরই, চলে এসো! আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি!.... 

হযরত আলী (আঃ)' বলেছেন, 'বাহ্যিক অলংকার ও পোশাক-পরিচ্ছদ সৌন্দর্য নয়, সৌন্দর্য হল-জ্ঞান ও সভ্যতা। যার পিতা-মাতা মারা গেছে সে এতীম নয়, প্রকৃত এতীম সে যার মধ্যে জ্ঞান ও বিবেক নেই।' মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ যিনি আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন এমন এক মহামানব।#

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ