হযরত আলী (আ.): বিশ্বনবীর (সা.) হাতে গড়া শ্রেষ্ঠ মানব
(last modified Sat, 31 Mar 2018 05:40:51 GMT )
মার্চ ৩১, ২০১৮ ১১:৪০ Asia/Dhaka
  • হযরত আলী (আ.): বিশ্বনবীর (সা.) হাতে গড়া শ্রেষ্ঠ মানব

আমিরুল মু'মিনীন হযরত আলী (আঃ)’র শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের স্বর্গীয় আলোকোজ্জ্বল প্রভা যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পরতে পরতে আদর্শ মুমিনের কর্মতৎপরতার গভীরে অতুলনীয় ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে।

এই মহাপুরুষের পবিত্র জন্মদিনে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত বিশেষ করে হযরত আলী (আ)'র নুরানি সত্তার শানে পেশ করছি অশেষ দরুদ ও সালাম। হযরত  আলী (আ) জন্ম নিয়েছিলেন পবিত্র কাবা ঘরে হিজরতের তেইশ বছর আগে ১৩ ই রজব এবং শাহাদত বরণ করেছিলেন কুফার পবিত্র মসজিদের মেহরাবে হিজরি ৪০ সনের একুশে রমজানে।

আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র মহত ও সুন্দর ব্যক্তিত্ব এত বিশাল বিস্তৃত ও এত বিচিত্রময় যে একজন মানুষের পক্ষে তাঁর সব বৈশিষ্ট্য ও পরিধি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করাও সম্ভব নয়। মানুষ কল্পনার ফানুস উড়াতে পারবে কিন্তু এর কিনারার নাগালও পাবে না।  

মানুষের মনে উত্তেজনা ও প্রভাব সৃষ্টিতে  আমিরুল মু' মিনিন আলী (আ.)'র সুবিশাল ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব ইতিহাসে দখল করে আছে অনন্য ও শীর্ষস্থানীয় অবস্থান। বিশ্বনবী (সা.)'র পর এ ব্যাপারে তিনি সত্যিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে তথা হিজরি সপ্তম শতকে মুহাম্মাদ ইবনে শাহরাসুব আল-মাজান্দারানি নামের একজন মুসলিম পণ্ডিত ছিলেন। তার লাইব্রেরিতে " মানাকিব" বা "মহত গুণাবলী' শীর্ষক এক হাজার বই ছিল। আর এসবগুলোই ছিল হযরত আলী (আ.)'র মহত গুণাবলী সম্পর্কে লিখা। এ থেকেই বোঝা যায় আলী (আ.)'র ব্যক্তিত্ব ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় কত অগণিত অসংখ্য মানুষকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে।  

মহান আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এ জন্য যে তিনি মানব জাতিকে হযরত আলী (আ.)'র মত একজন মহামানব উপহার দিয়েছেন।

ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট সূফী সাধক ও চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা খাজা মুঈনউদ্দিন চিশতি (র.) বলেছেন, সমুদ্রকে যেমন ঘটিতে ধারণ করা অসম্ভব তেমনি বর্ণনার মাধ্যমে আলী (আ.)'র গুণাবলী তুলে ধরাও অসম্ভব।

হযরত আলী (আ.)'র চরিত্রে আমরা দেখতে পাই একজন দার্শনিকের বৈশিষ্ট্য, একজন বিপ্লবী নেতার বৈশিষ্ট্য, একজন সূফী শায়খের বৈশিষ্ট্য এবং নবী-রাসূলদের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ থাকে তারও অনেক বৈশিষ্ট্য। 

ইমাম বা খলিফা হওয়ার আগেও হযরত আলী (আ.) সবার সঙ্গে ন্যায় আচরণ করতেন। হযরত আলী (আ.) নিজে একজন সুশৃঙ্খল ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। মনুষ্যত্বের প্রতিটি সদগুণের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। তাঁর মন ছিল গভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং তা ছিল করুণায় ভরপুর ও স্নেহরাশিতে টইটম্বুর। দৈহিক, আধ্যাত্মিক ও মানসিক সব দিক থেকেই তিনি ছিলেন পূর্ণত্বের অধিকারী। রাতে যখন তিনি আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হতেন তখন আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকত না। আবার দিনে ছিলেন জনগণের মাঝে কর্মমুখর। দিনের বেলায় জনগণ তাঁর দয়া ও সততায় মুগ্ধ হতেন আর তাঁর উপদেশ, পরামর্শ ও জ্ঞানপূর্ণ কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। অন্যদিকে রাতে আকাশের তারকারাজি দেখত হযরত আলী (আ.) কিভাবে আল্লাহর ইবাদতে অশ্রু বিসর্জন করছেন আর আকাশ তাঁর প্রেমপূর্ণ মুনাজাত শুনত।

হযরত আলী (আ.) একাধারে একজন জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ, রহস্যবাদী ব্যক্তি,সমাজের নেতা, আত্মসত্তা বিসর্জনকারী ব্যক্তি, মুজাহিদ, বিচারক, শ্রমিক,একজন বাগ্মী ও লেখক। তাঁর সব আকর্ষণীয় গুণ নিয়ে তিনি ছিলেন পূর্ণতার সব অর্থেই একজন পূর্ণাঙ্গ মানব।

 বিশ্বনবী (সা.)'র একটি হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আলী(আ.)-কে পুরোপুরি বা পরিপূর্ণভাবে চেনেন কেবল আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.) এবং আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.)-কে ভালভাবে চেনেন কেবল আলী (আ.)।

 হযরত আলী (আঃ) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (সা:) বলেছেন, মুসার সাথে হারুনের যে সম্পর্ক তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক,  শুধু পার্থক্য হল হারুন (আঃ) নবী ছিলেন, তুমি নবী নও।

আলী (আ.) এমন এক নাম যার নাম উচ্চারণ ও যার বরকতময় জীবনের আলোচনা মানুষের ঈমানকে তাজা করে দেয়। রাসূল (সা.) বলতেন, আলীর দিকে তাকানোও ইবাদত।        

হযরত আলী (আ.)'র আকাশ-ছোঁয়া বীরত্ব ও মহত্ত্ব কেবল মুসলিম কবি,সাহিত্যিক বা মনীষীদেরই প্রভাবিত করেনি, অমুসলিম পণ্ডিতরাও তার সুবিশাল ব্যক্তিত্বের ব্যাপকতায় অভিভূত ও হতবাক হয়েছেন। তাঁর মহত্ত্ব ও উদারতার প্রশংসা করে আর ডি ওসবোর্ন বলেছেন, আলী (আ.) ছিলেন মুসলমানদের ইতিহাসের সর্বোত্তম আত্মার অধিকারী সর্বোত্তম ব্যক্তি।

ওয়াশিংটন আরভিং বলেছেন, "সব ধরনের নীচতা ও কৃত্রিমতা বা মিথ্যার বিরুদ্ধে আলী (আ.)'র ছিল মহত সমালোচনা এবং আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিক সব ধরনের কূটচাল থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন।"

ঐতিহাসিক মাসুদির মতে, রাসূল (সা.)'র চরিত্রের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল যার ছিল তিনি হলেন আলী (আ.)।

আমীরুল মুমিনীন আলী সম্পর্কে মাওলানা রুমী লিখেছেন,

 “সাহসিকতায় তুমি ছিলে খোদার সিংহ তা জানি

পৌরুষত্বে আর বদান্যতায় কি তুমি তা জানেন শুধুই অন্তর্যামী।”

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের অতুলনীয় ও শ্রেষ্ঠ বীরযোদ্ধা। আল্লাহর সিংহ বা আসাদুল্লাহ ছিল তাঁর উপাধি। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:)’র জীবদ্দশায় প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে বিজয়ের তিনিই ছিলেন প্রধান স্থপতি। তাই বলা হয়, হযরত আলী (আঃ)’র তরবারি জুলফিক্বার ছাড়া ইসলামের কোনো বিজয়ই অর্জিত হতো না। বিশ্বনবী-সা: নিজেই তাঁকে এই দ্বিধারী তরবারি উপহার দিয়েছিলেন। বদর,ওহোদ, খন্দক, খায়বারসহ অনেক যুদ্ধের কিংবদন্তীতুল্য বীর আলী (আঃ) অনেকবার নিজ জীবন বাজি রেখে রাসূল (সা:)’র জীবন রক্ষা করেছিলেন। জিহাদের ময়দানে তাঁর উপস্থিতিই শত্রু-সেনার মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতো।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)ছিলেন মজলুমের বন্ধু, অত্যাচারীর ত্রাস, মহানবী (সা:)’র জ্ঞান-নগরীর তোরণ, এতীম ও অনাথের সেবক, শ্রেষ্ঠ আবেদ, সাধকদের আদর্শ এবং একইসাথে সৎ-নেতৃত্ব, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের প্রতীক। তিনি ছিলেন সর্বযুগের সেরা নারী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (সা:)’র স্বামী।

 আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)’র মাধ্যমেই রক্ষিত হয়েছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:)’র পবিত্র বংশধারা বা তাঁর পবিত্র আহলে বাইত যাঁদের অনুসরণ ছাড়া মুসলমানদের মুক্তি ও হেদায়েত সম্ভব নয় বলে বিশ্বনবী (সা.) জোর তাগিদ দিয়ে গেছেন। ইমাম আলী (আঃ)ই  বেহেশতী যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হুসাইনের (আ) পিতা।  মুসলিম উম্মাহর সর্বশেষ ইমাম তথা উম্মতের ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদী আঃ’ও (মহান আল্লাহ তাঁর পুনরাবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন) তাঁরই বংশধর।

ইসলামের ইতিহাসের দ্বিতীয় খলিফা আলী (আ.)'র পরামর্শ ও জ্ঞানগত সহযোগিতার কাছে নিজের ঋণ স্বীকার করে বলেছেন,"আলী ইবনে আবি তালিবের মত আরেকজনকে গর্ভে ধারণ ও প্রসব করার ক্ষমতা নারীকুলের কারো নেই। আলী না থাকলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত।"

 বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) বলেছেন, আমি জ্ঞানের নগরী, আর আলী তার দরজা। হযরত আলী (আঃ) নিজেও বলেছেন, পবিত্র কোরআনের এমন কোনো আয়াত নেই যার শানে নজুল, ব্যাখ্যা বা তাৎপর্য সম্পর্কে আমি রাসূল (সা:)’র সাথে আলোচনা করি নি। পবিত্র কোরআনের তাফসীর, ফেক্বাহ,হাদিস ও কালাম শাস্ত্রসহ ইসলামের এমন কোনো শাস্ত্র নেই যে বিষয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন না।

সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও কৌশলপূর্ণ নিখুঁত বিচারের জন্য হযরত আলী (আঃ)কে রাসূল (সা:)’র পর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক বলা যেতে পারে। হযরত আলী (আঃ)কে আরবি ব্যাকরণের জনকও বলা হয়। কবিতা ও ভাষণসহ তাঁর চিঠিগুলো আরবি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ এবং কালোত্তীর্ণ সম্পদ।

ইবনে আব্বাস রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন: আলী আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী এবং বিচারকার্যে সর্বোত্তম।

হযরত আলী (আ.) ছিলেন এমন একজন পূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ যার মধ্যে সবগুলো মানবিক মূল্যবোধ সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করেছে

ইবাদতরত অবস্থায় তাঁর শরীর থেকে তীর খুলে ফেলা হয়েছে, অথচ তিনি এমনভাবে আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট ও ইবাদতে নিমগ্ন যে অনুভবও করেননি। ইবাদতের মেহরাবে তিনি এতটা ক্রন্দনশীল যার নজীর কেউ দেখেনি। আবার দিনের বেলায় আলী(আ.) যেন ভিন্ন কোন মানুষ। সঙ্গীদের সাথে যখন বসেন তখন হাসি মুখ, খোলা-মেলা তাঁর আচরণ। তাঁর চেহারা সব সময় হাস্যোজ্জ্বল। 

সহনশীলতা ও ধৈর্যের ক্ষেত্রে  তিনি  ছিলেন যেমন সর্বোচ্চ পর্যায়ের তেমনি সাহসিকতার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে। রক্তপাতের ক্ষেত্রে যেখানে কোন নিকৃষ্ট ব্যক্তির রক্ত ঝরাতে হবে সেখানে তিনি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা, আবার ইবাদতের ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী।

আলী (আ.) ছিলেন নিঃস্ব ও সম্পদহীন, অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। দানশীল ছিলেন বলেই সম্পদ তাঁর হাতে গচ্ছিত থাকত না।  

রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমন মানুষের মুক্তির জন্য লালায়িত ছিলেন ও চাইতেন মানুষের সব দুঃখ-কষ্ট দূর করে তাকে মুক্তি দিতে তেমনি আলী (আ.)ও ছিলেন প্রকৃত মানব-প্রেমিক ।

আসলে আলী (আ.) ছিলেন সব ধরণের মানবিক মূল্যবোধের ময়দানে বিজয়ী বীর। মানবতার সবগুলো ময়দানেই তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ তথা আদর্শ ও পরিপূর্ণ মহামানব।

সবশেষে  হযরত আলী (আঃ)’র জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে আবারও শুভেচ্ছা জানিয়ে এ মহাপুরুষের কয়েকটি অমর ও অমূল্য বাণী তুলে ধরছিঃ

-‘নিশ্চয় আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে অনন্তর বলতে শুনেছি যে, কোন উম্মতই সম্মান ও মর্যাদার পবিত্র স্থানে পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের ক্ষমতাশীলদের হাত থেকে দুর্বলদের অধিকার আদায় করবে কোন দ্বিধা ও শঙ্কা ছাড়াই।।’ (নাহজুল বালাগাহ্, পত্র নং ৫৩)

-প্রকৃত জীবন হচ্ছে মৃত্যুবরণের মাধ্যমে জয়ী হওয়া। আর প্রকৃত মৃত্যু হলো বেঁচে থেকেও নিকৃষ্ট ব্যক্তির অধীনে থাকা।

-জেনে রাখ, নিশ্চয়ই দারিদ্র্য একটি বড় বিপদ এবং দারিদ্র্য হতে মন্দ শারীরিক অসুস্থতা আর শারীরিক অসুস্থতা হতে খারাপ ও কঠিন হলো অন্তরের অসুস্থতা।”

- প্রত্যেক বক্তব্য বা কথা যাতে আল্লাহর স্মরণ নেই তা হল অর্থহীনতা বা অন্তঃসারশূন্যতা, আর যে নীরবতার মধ্যে আল্লাহ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই তা হচ্ছে উদাসীনতা বা মনোযোগহীনতা এবং যে চিন্তার মধ্যে আল্লাহর প্রতি দৃষ্টি নেই তা হচ্ছে অনর্থক সময় নষ্ট করা।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/৩১

ট্যাগ