'ইরানের ইসলামী সরকার ব্যবস্থা পাশ্চাত্যের জন্য গাত্রদাহ'
(last modified Thu, 27 Oct 2016 12:43:16 GMT )
অক্টোবর ২৭, ২০১৬ ১৮:৪৩ Asia/Dhaka
  • ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী
    ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী

গত ১৯ অক্টোবর বুধবার ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইরানের যুব প্রজন্মের কয়েক হাজার মেধাবী ছাত্র, গবেষক ও বিশেষজ্ঞের এক সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বক্তব্য রেখেছেন।

তার ওইসব বক্তব্যের কিছু চুম্বক অংশ এখন তুলে ধরব। 

ইরানের যুব প্রজন্মের মেধাবী ছাত্র, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদেরকে আল্লাহর দেয়া মূল্যবান উপহার ও দেশের দায়িত্বশীলদের হাতে থাকা আমানত বলে মনে করেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। তাদের সুরক্ষা এবং সাহায্য-সমর্থন দেয়ার বিষয়ে এক মুহূর্তের জন্যও দায়িত্বশীলদের উদাসীন থাকা ঠিক নয় বলে তিনি মনে করেন। ইরানের  যুব প্রজন্মের মেধাবী ছাত্র, গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে  তাদের এই মহান দেশকে  উন্নত, শক্তিশালী, গৌরবান্বিত, মানব জাতির বর্তমান অচলাবস্থা দূরকারী,  মানবীয় বিষয়ে সৃষ্টিশীল নতুন বক্তব্য দানকারী ও নতুন ইসলামী সভ্যতার পতাকাবাহী দেশে পরিণত করবে বলে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী আশাবাদী। 
বক্তব্যের শুরুতে মহররম ও আশুরা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, মহররম ও আশুরা ইতিহাসের এমন এক মহা-ঘটনা যার কোনও পরিসমাপ্তি নেই। এ ঘটনা সত্য ও মিথ্যার এবং মর্যাদা ও সম্পদের দাসত্বের লড়াইয়ের এমন এক বাস্তব চিত্র যা অস্তহীন সূর্যের মত চিরকাল আলোর বন্যা ছড়িয়ে যাবে। 

বিশ্ব-ইসলামী জাগরণের বর্তমান কাণ্ডারি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইসলামী এই দেশের মেধাবী যুব প্রজন্মের উদ্দেশে বলেছেন, তোমাদের সবচেয়ে বড় ও প্রধান দায়িত্ব হল, যে প্রতিভা মহান আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন সে জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া এবং এই নেয়ামতকে উপযুক্ত খাতে যথাযথভাবে কাজে লাগানো। 
তিনি কাজার ও পাহলভি শাসনামলে  ইরানের জনগণের মধ্যে অক্ষমতার অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার কথা তুলে ধরে বলেছেন, পশ্চিমারা অন্যদের তুলনায় বস্তুগত বিজ্ঞানে বেশি অগ্রসর হওয়ায় নিজেদের ওপরের শ্রেণী বলে মনে করছে এবং অন্য জাতিগুলোর ব্যাপারে হীন ধারণা পোষণ করছে। তারা ঐতিহ্যবাহী সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী জাতিগুলোকে নিজেদের চেয়ে ছোটো মনে করে তাদের অবমাননা করছে। এমনকি পশ্চিমারা ইরানি জাতিসহ যেসব জাতির কাছ থেকে এক সময় জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখেছে সেই জাতিগুলোরও অবমাননা করেছে। নিজেদের বড় মনে করে বলেই পশ্চিমারা এশিয়ার অঞ্চলগুলোকে দূরপ্রাচ্য, নিকট প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্য বলে অভিহিত করে। অথচ এশিয়া হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও পুরনো সভ্যতাগুলোর লালন-ভূমি। মধ্যযুগেও পাশ্চাত্য যখন অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে ছিল তখন মুসলিম দেশগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক সোনালী অধ্যায় অতিক্রম করছিল। 
রেনেসাঁর পর পাশ্চাত্য চিকিৎসা, গণিত, রসায়ন ও জ্যোতির্বিদ্যাসহ নানা বিষয়ে মুসলমানদের লেখা অনেক বই অনুবাদ করে বিজ্ঞান-আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু নৌ-বিদ্যাসহ বিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়ার পরপরই পশ্চিমারা এই বিজ্ঞানকে মুসলিম দেশগুলোর ওপর তাদের উপনিবেশ চাপিয়ে দেয়ার কাজে অপব্যবহার করে এবং যুক্ত করে ইতিহাসের বহু কালো অধ্যায়। 
এক শ্রেণীর দরিদ্র মানুষ হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ বা ধনী হয়ে গেলে যেমন আত্মহারা হয়ে নিজের অতীত ভুলে নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড় ভাবতে থাকে ও নিজের সংকীর্ণ দৃষ্টির আলোকে অন্যদের বিচার করতে থাকে তেমনি পশ্চিমারা অন্য জাতিগুলোকে হীন দৃষ্টিতে বিচার করতে অভ্যস্ত। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, যখন কোনও একটি দেশকে একটি বিজাতীয় শক্তির দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বিচার করা হয় তখন দেশটির সব শক্তি আর উপায়-উপকরণ ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় ওই শক্তির সম্পদ হয়ে পড়ে।

ইরানে কাজার ও পাহলভি শাসনামলে অযোগ্য আর পরাশক্তিগুলোর ক্রীড়নক রাজতান্ত্রিক স্বৈর-সরকার থাকায় দেশটি হয়ে পড়ে বিজাতীয় শক্তিগুলোর লুটপাটের শিকার এবং বিজাতীয়দের সৃষ্ট দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, গণহত্যা ও অনগ্রসরতা হয়ে পড়ে দেশটির অবিচ্ছেদ্য অংশ। 
'ইরানিরা নিজেরা কিছু করতে সক্ষম নয়'-এই ভুল চেতনা শাসকদের পক্ষ থেকে ছড়িয়ে দেয়ার কারণেই এসব ঘটনা ঘটানো সম্ভব হয়েছিল। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ পরিস্থিতির অবসান প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ইসলামী বিপ্লব ইরানে বড় ধরনের এক পরিবর্তন ঘটায়। পরনির্ভরতার স্থলাভিষিক্ত হয় আত্ম-বিশ্বাস। আর আল্লাহও সাহায্য করেছেন ইরানিদেরকে। ইরানের ওপর দুই প্রধান পরাশক্তিসহ বহু পরাশক্তির মদদ-পুষ্ট ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সময় নানা তিক্ততা সত্ত্বেও বহু প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। ইরানের যুব সমাজ সে সময় এটা প্রমাণ করে যে খালি হাতেও পরাশক্তিগুলোর মদদ-পুষ্ট শক্তির মোকাবেলায় জয়ী হওয়া সম্ভব। ’ 

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, শত্রুরা এখন নরম যুদ্ধের মাধ্যমে ইরানি জাতির আত্ম-বিশ্বাসে চিড় ধরাতে চায়। তারা ইরানিদের মধ্যে পরনির্ভরশীলতার সেই পুরনো সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে নতুন ও সুন্দর শব্দের মোড়কে। আর তারা এ কাজে ইরানের ভেতরের এক শ্রেণীর প্রতারিত ও সরল-মনা ব্যক্তিদের ব্যবহারের চেষ্টা করছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মনে করেন, পশ্চিমারা যে গ্লোবালাইজেশান বা বিশ্বায়নের কথা বলছে তার উদ্দেশ্য হল সব জাতির ওপর কয়েকটি বড় শক্তির সংস্কৃতিকে কর্তৃত্বশীল করা। এই শক্তিগুলো বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তা-ব্যবস্থার ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। আর এটাই হচ্ছে সেই পরনির্ভরশীলতা। আয়াতুল্লাহ খামনেয়ীর মতে জাতি ও দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা জরুরি হলেও আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর ওপর নির্ভরতা মোটেই কাম্য  নয়। 

ইরানে আধ্যাত্মিকতার দিকগুলোকে আরও শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, বর্তমানে শক্তিশালী এই বিশ্বের একটি বড় দুর্যোগ হল, যেখানে শক্তি আছে সেখানে ঈমান নেই।  তিনি এ প্রসঙ্গে দুই মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বিতর্কের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, 'এ দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন প্রেসিডেন্ট হবেন .... যে দেশটির কাছে রয়েছে সবচেয়ে বেশি পরমাণু বোমা, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সম্পদ ও বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণমাধ্যমগুলো সেই দেশটির প্রেসিডেন্ট হবেন এ দুই জনের কোনও একজন। তোমরা তো দেখেছো তারা কে ও কেমন মানুষ! (তাদের পরিচিতি ও নানা কুকীর্তি! ) এর কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা না থাকা ও ঈমান না থাকা।'

ইরানকে  আরও শক্তিশালী ও আধ্যাত্মিকতায় সমৃদ্ধ করার জন্য সাহসী, শিক্ষিত, ধার্মিক, সৃষ্টিশীল, উদ্যমী, আত্মবিশ্বাসী ও  আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন প্রজন্ম তথা বিপ্লবী মানুষ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। তার মতে প্রতিভাবান যুব সমাজ হচ্ছে এমন প্রজন্মের গতি-সঞ্চারক ইঞ্জিনের সমতুল্য। তিনি ইরানের বিজ্ঞান-গবেষণা ও প্রযুক্তি আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছেন যাতে যুব প্রজন্ম হতাশ না হয়ে পড়ে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা একই প্রসঙ্গে ইরানের প্রতিভাবান যুব প্রজন্মকে সাংস্কৃতিক দিক থেকে উন্নত করা ও দেশের চাহিদা আর সমস্যাগুলোর সঙ্গে তাদের পরিচিত করার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এই লক্ষ্যে জিহাদি নানা ক্যাম্প বা কর্মশালায় প্রতিভাবান যুব সমাজকে প্রশিক্ষণ দেয়াসহ তাদের প্রতিভার সার্বিক বিকাশের জন্য কার্যকর কিছু কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেছেন, ‘বর্তমানে শয়তানি শক্তিগুলো জনগণকে দিনকে দিন আরও অজ্ঞতা আর বিভ্রান্তির গভীরে ঠেলে দিচ্ছে, আর যারাই এর বিরোধিতা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এইসব শয়তানি তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ওদের অনুযোগ হল এটা যে কেনো আমরা তাদেরকে ভালো মনে করছি না!!!?

 ইরানের সর্বোচ্চ নেতা পরমাণু সমঝোতার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের ওয়াদা লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর দিকে ইশারা করে বলেছেন, ‘আমি বার বার আমাদের কর্মকর্তাদের সতর্ক করে বলেছি, যদি আপনারা পরমাণু বিষয়ে পিছু হটেন তাহলেও মার্কিন সরকারের সঙ্গে আপনাদের সমস্যা শেষ হবে না, বরং তারা একে একে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি, ফিলিস্তিন ও লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি ইরানের সমর্থন, কথিত মানবাধিকার ইস্যু এবং সবশেষে ইরানের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার দাবি জানাবে। তারা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে ইসলামী সরকার-ব্যবস্থার অস্তিত্বকে সহ্য করতে পারবে না।’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইরানের অত্যন্ত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরে বলেছেন, ইরানের বিশেষজ্ঞ ও প্রতিভাবান যুব-সমাজকে দেশের এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। 
সবশেষে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা   হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইরানের যুব প্রজন্মের মেধাবী ছাত্র, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের সার্বিক সাফল্যের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করেন। #

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/২২

ট্যাগ