আপোষ আলোচনার ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত ঘোষণার প্রভাব (দুই)
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে জেরুজালেমকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘটনায় মুসলিম বিশ্ব ক্ষোভে ফেটে পড়েছে।
ট্রাম্প এ ঘোষণা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার অসৎ উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দিয়েছেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, পৃথিবী উল্টে গেলেও ওয়াশিংটন দখলদার ইসরাইলকে পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাবে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
ট্রাম্পের এই ঘোষণার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কিত তিন পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্বে আমরা আজ সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যে এতদিন যত বিপর্যয় ঘটেছে তার বেশিরভাগেরই জন্য দায়ী আমেরিকা ও ইহুদিবাদী ইসরাইল। সমরাস্ত্র দিয়ে ইহুদিবাদীদের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রবণতা এবং এই দখলদারিত্ব থেকে মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক সংকট সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। এ অঞ্চলের কিছু তাবেদার আরব শাসকের কারণে সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদীরা দ্বিগুণ উৎসাহে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প তার বিতর্কিত ঘোষণার মাধ্যমে সেই অপকর্মকে পরিপূর্ণতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের আরো কিছু ভূখণ্ড জবরদখল করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় ৭০ বছর হলো। আর ইহুদিবাদীরা বায়তুল মুকাদ্দাস বা জেরুজালেম দখল করেছে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে। এই দীর্ঘ সময় ধরে ফিলিস্তিনিদের একাংশ বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছেন, একাংশ জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ইহুদিবাদীদের দখলদারিত্বের মধ্যে চরম বৈষম্য ও হুমকি-ধমকির মধ্যে বসবাস করছেন এবং আরেক অংশ গাজা উপত্যকায় অবরুদ্ধ অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। ট্রাম্প তার ঘোষণার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের এই দুর্দশাকে আরো বাড়িয়ে দিতে চান।
কিন্তু বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কেন এই ঘোষণা দেয়ার জন্য এই সময়টিকে বেছে নিলেন তা নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। আসলে ইহুদিবাদী ইসরাইল নিজের দখলে থাকা জেরুজালেম শহরকে ইহুদিকরণ করার জন্য বহুদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। তারা এই শহরের মূল অধিবাসী ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের ভূমিতে ইহুদি উপশহর নির্মাণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধরে আনা ইহুদিদেরকে সেখানে বসবাস করতে দিয়েছে। মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে ইহুদিদের উপাসনালয় তৈরি করেছে। এমনকি মুসলমানদের প্রথম কেবল আল-আকসা মসজিদে উগ্র ইহুদিবাদীদের অনুপ্রবেশের সুযোগ দিয়ে এই পবিত্র স্থানের অবমাননা করেছে।
আসলে ট্রাম্প জেরুজালেম সংক্রান্ত বিতর্কিত ঘোষণা দিয়ে দু’টি লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছেন। প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে, উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশকে লেলিয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে টুকরো টুকরো করতে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন এই অঞ্চলে ইসরাইলের প্রভাব বিস্তারের জন্য নতুন খেলা শুরু করা। দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, ফিলিস্তিন ও লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোকে দমন করে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে ঝামেলামুক্ত জীবন দান করা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ওয়াশিংটন দ্বিতীয় লক্ষ্যকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ট্রাম্পের বিতর্কিত ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় এক বিবৃতিতে বলেছে, “ট্রাম্প এ ঘোষণা দিয়ে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং ফিলিস্তিনি জাতির অধিকার মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন করেছেন। এখন মুসলিম উম্মাহসহ অন্যান্য স্বাধীনচেতা ও ন্যায়পরায়ণ জাতির উচিত হবে এই গভীর ও দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্র রুখে দেয়ার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়া।”
আইআরজিসি’র বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, “ট্রাম্পের এ ঘোষণা ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে হতাশ করতে পারেনি বরং ইহুদিবাদ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো আরো বেশি স্পৃহা নিয়ে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে। তাদের ক্ষোভের আগুনে একদিন ইহুদিবাদীরা জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে।”
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ইহুদিবাদী ইসরাইল সব সময় দু’টি লক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছে। প্রথম লক্ষ্যটি হলো- দখলদারিত্ব বজায় রেখে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা। কিন্তু তার সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি কারণ, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামীরা তাদের আন্দোলনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ইসরাইল একটি অবৈধ দখলদার শক্তি। ইহুদিবাদী ইসরাইল দ্বিতীয় যে লক্ষ্যটি অর্জন করতে চেয়েছে তা হলো- জেরুজালেম শহর থেকে মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান ধ্বংস করে দিয়ে এই নগরী থেকে মুসলমানদের অস্তিত্ব মুছে ফেলা।
কিন্তু ইহুদিবাদী ইসরাইল গত এক দশকে লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে চারটি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। ৩৩ দিন, ২২ দিন ও আটদিনের যুদ্ধে সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামীরা ইসরাইলের চেয়ে অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও এসব যুদ্ধে তেল আবিব পরাজিত হয়েছে। এসবের মধ্যে লেবাননের হিজবুল্লাহর কাছে দুইবার ইসরাইলের পরাজয় যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে। প্রথমবার হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ সংগ্রামের কাছে পরাজিত হয়ে ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয় ইহুদিবাদী সেনারা। ১৯৮২ সাল থেকে লেবাননের দক্ষিণ অংশ দখল করে রেখেছিল তেল আবিব। এরপর ২০০৬ সালের ৩৩ দিনের যুদ্ধে হিজবুল্লাহর কাছে প্রচণ্ড মার খায় ইহুদিবাদী সরকার। হিজবুল্লাহর এই বিজয়গুলো ২০১৪ সালে গাজার প্রতিরোধ সংগ্রামীদের ৫১ দিনের যুদ্ধে পরিপূর্ণতা পেয়েছে।
হিজবুল্লাহর এসব বিজয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিরোধ আন্দোলনের মোকাবিলায় আমেরিকা ও ইসরাইলের দুর্বল দিকগুলো আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়েছে। এই প্রতিরোধ আন্দোলনের ফলাফলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের ব্যাপারে যে ভীতি ছিল তা শুধু কমে যায়নি বরং নিঃশেষ হয়ে গেছে। প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এখন একথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, যেকোনো যুদ্ধে ইসরাইলকে সহজেই পরাজিত করা সম্ভব। ইহুদিবাদী ইসরাইলের আগ্রাসী নীতি বাস্তবায়নের পথে এ বিষয়টি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে।
দ্বিতীয়ত, এবার যেসব ফিলিস্তিনি কিশোর ও তরুণ দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের আন্দোলন দেখেনি। তারপরও তাদের রাজপথে নেমে আসা দেখে বোঝা যায়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে গেলেও ফিলিস্তিনিদের ইসরাইল বিরোধী আন্দোলন কোনোদিন বন্ধ হবে না।
ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের ইসরাইল বিরোধী এই মনোভাব ইহুদিবাদীদের পাশাপাশি তাদের পৃষ্ঠপোষক আমেরিকার পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। ঠিক এ কারণেই এই দুই শক্তি মিলে এখনই জেরুজালেমকে ইসরাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এ কাজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো একজন উগ্র ব্যক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ফিলিস্তিনি জাতি তাদের হারানো মাতৃভূমি ফিরে পাওয়ার আন্দোলন কখনোই বন্ধ করবে না এবং একদিন না একদিন তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় করে ছাড়বে।
তো বন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে ট্রাম্পের বিতর্কিত ঘোষণা সংক্রান্ত আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব। এ আলোচনার তৃতীয় ও শেষ পর্বেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/১৩