ইয়েমেনি শিশুদের কাছে সৌদি সরকারের পরাজয়, লজ্জিত বিশ্ব বিবেক
(last modified Sun, 31 Jul 2016 13:24:00 GMT )
জুলাই ৩১, ২০১৬ ১৯:২৪ Asia/Dhaka

ইয়েমেনে সৌদি আরবের নির্বিচার বিমান হামলা ও বোমা বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। এসব হামলায় নিহত হচ্ছে ইয়েমেনের বেসামরিক নাগরিক এবং বিশেষ করে শিশু ও নারী। ধ্বংস হচ্ছে ইয়েমেনের স্কুল, শিক্ষাকেন্দ্র ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রসহ নানা ধরনের বেসামরিক স্থাপনা।  

এদিকে সম্প্রতি ইয়েমেনের শিশুরা জাতিসংঘের জন্য অর্থ সংগ্রহের এক অভিযান শুরু করেছে। ইয়েমেনের নিষ্পাপ শিশুদের হত্যার কারণে সৌদি সরকারের নাম শিশু-ঘাতক সরকারগুলোর তালিকাভুক্ত করা হলে এই বিশ্বসংস্থায় অর্থ-সহায়তা বন্ধ করা হবে বলে সৌদি সরকার যে হুমকি দিয়েছে তার জবাবে ইয়েমেনি শিশুরা এই পদক্ষেপ নিয়েছে।

সামাজিক নানা গণমাধ্যমে পাঠানো ছবিতে দেখা গেছে ইয়েমেনের শিশুরা জাতিসংঘের একটি বড় পতাকার মধ্যে ধাতব মুদ্রা ও কাগুজে নোট রাখছে। রাজধানী সানা’র জাতিসংঘ কার্যালয়ের কাছে এই কর্মসূচি শুরু করেছে তারা। এই কর্মসূচিতে শরিক হয়েছেন সানার মেয়র।

জাতিসংঘের জন্য ইয়েমেনি শিশুদের অর্থ সংগ্রহের ঘটনা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের হাতে শিশু হত্যার যেসব ঘটনা ও সংখ্যা তুলে ধরা হয়েছে সে বিষয়ে ওই জোট ও জাতিসংঘ যৌথভাবে পর্যালোচনা করবে- এমন একটি সাম্প্রতিক প্রস্তাব অনিচ্ছা সত্ত্বে মেনে নিতে বাধ্য হন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন।

‘শিশু ও সামরিক সংঘাত’ বিষয়ক ওই প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে সৌদি সরকারকে শিশু-ঘাতক সরকারগুলোর তালিকাভুক্ত করেছিল জাতিসংঘ। কিন্তু সৌদি সরকার ও তার মিত্রদের প্রবল চাপ এবং বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রমে চাঁদা বন্ধ করে দেয়ার হুমকির মুখে বান কি মুন ওই কালো-তালিকা থেকে সৌদি সরকারের নাম সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান। ‘অযৌক্তিক চাপের মুখে’ রিয়াদকে আপাতত সাময়িকভাবে ওই তালিকা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে বান কি মুন স্বীকার করেছেন!

বান কি মুনের ওই বক্তব্য থেকে বোঝা যায় জাতিসংঘের স্বাধীনতা ও মেরুদণ্ড বলতে কিছুই নেই। এ রকম ‘অযৌক্তিক চাপের’  কারণেই জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের গাজাবাসীর ওপর ইসরাইলের নির্মম ও পাশবিক অবরোধ তুলে নিতে পারছে না। ওই অবরোধ চলছে প্রায় দশ বছর ধরে। এ সময়ে চিকিৎসার অভাবে বিদেশে যেতে না পারায় মারা গেছে বহু ফিলিস্তিনি। এ ছাড়াও ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মুরব্বিদের অযৌক্তিক চাপের কারণেই গাজায় বেসামরিক স্থাপনাগুলোতে ইসরাইলের পাশবিক বিমান হামলায় নিহত ব্যক্তিদের পক্ষেও কিছু করতে পারেনি জাতিসংঘ । এসব হামলায় শহীদ হয়েছে শত শত শিশু ও নারী। জাতিসংঘ যদি সত্যিকার অর্থে জাতিগুলোর জনমতের প্রতিনিধিত্ব করতো তাহলে ইরাকে ও আফগানিস্তানে অন্যায় আগ্রাসন এবং গণহত্যার জন্য বিচার করা হত মার্কিন শাসকদের। জাতিসংঘের মহাসচিব যদি স্বাধীনচেতা ও মেরুদণ্ড-সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হতেন তাহলে যুদ্ধ-অপরাধের দায়ে ইসরাইলি শাসকদেরকে বিচারের মুখোমুখি করার অন্তত দাবি তুলতে পারতেন।

ফিরে আসছি ইয়েমেনে শিশু ও নারীসহ বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সৌদি গণহত্যা অব্যাহত থাকা ও এ বিষয়ে জাতিসংঘে ঠুঁটো-জগন্নাথ বা প্রায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন প্রসঙ্গে।  বান কি মুনের সাহসহীনতার লজ্জা ঢাকতে বা কাপুরুষোচিত পিছুটানের প্রতিবাদে ইয়েমেনের শিশুরা অর্থ সংগ্রহের যে প্রতীকী পদক্ষেপ নিল তাতে যে কেবল সৌদি সরকারই নৈতিক দিক থেকে পরাজিত হল তা নয় এতে বিশ্ব-বিবেকও হার মানল আরব বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইয়েমেনের শিশুদের কাছে।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়েছিল গত এক বছরে ইয়েমেনের যুদ্ধে নিহত ৭৮৫ শিশুর ৬০ শতাংশেরই মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল সৌদি সরকার।

সম্প্রতি ইয়েমেনের এক শিশু জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের কাছে লেখা মর্মস্পর্শী এক চিঠিতে সৌদি হুমকির মোকাবেলায় তাকে সাহস যোগানোর চেষ্টা করেছে।  ওই শিশু লিখেছে, ‘সৌদি আরবকে ভয় পাবেন না। কারণ, ইয়েমেনে গণহত্যা চালাচ্ছে সৌদি আরব জাতিসংঘ নয়। ... আমি আমার নাম লিখছি না। কারণ, সৌদি আরব আমাকে হত্যা করবে। আর আমি মৃত্যু পছন্দ করি না।... আমার বন্ধুরা ও আরও অনেকে জাতিসংঘের জরুরি শিশু-তহবিল বা ইউনিসেফের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে রাজি হয়েছে। কারণ, সৌদি আরব বলেছে, তারা ইউনিসেফকে অর্থ সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দেবে।’

ইয়েমেনের ওই শিশু আরো লিখেছে, ‘যখন আমি বড় হব ও শেষ করব আমার লেখাপড়া তখন আমি জাতিসংঘের মহাসচিব হব। আর সে সময় আমি সৌদি সরকারের বিচার করব। কারণ এই সরকার আমার বন্ধু আহমাদকে হত্যা করেছে। আহমাদ স্কুলের শ্রেণী কক্ষে আমার পাশেই বসেছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব হয়ে সৌদি সরকারের বিচারের সময় এই সরকার যদি আমাকে হুমকিও দেয় তবুও আমি তখন সৌদি সরকারকে ভয় পাব না, কারণ আমি হব বীর।’

সৌদি সরকার গত বছরের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে ইয়েমেনে হামলা শুরু করে। গণজাগরণের মুখে ইয়েমেনের সংসদে পদত্যাগকারী ও পলাতক সাবেক প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য এই হামলা শুরু করে রাজতান্ত্রিক সৌদি সরকার। রিয়াদের ক্রীড়নক এই হাদিকে সমর্থন দিচ্ছে মার্কিন সরকার, ইসরাইল ও তাদের আঞ্চলিক সেবাদাসতুল্য আরব সরকারগুলা। সৌদি-নেতৃত্বাধীন এই সরকারগুলোর জোট বাহিনীর নির্বিচার হামলায় কয়েক হাজার শিশু ও নারীসহ প্রায় সাড়ে নয় হাজার ইয়েমেনি নিহত হয়েছে। আর আহত হয়েছে দেশটির অন্তত ১৬ হাজার নাগরিক।

উল্লেখ্য, বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত শিশু-ঘাতক সরকার ইহুদিবাদী ইসরাইলের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘের মেরুদণ্ডহীনতা ও আপোসকামীতা প্রবাদ-তুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।  জাতিসংঘের ওপর পাশ্চাত্যের একচেটিয়া খবরদারির কারণে  বর্ণবাদী ও দখলদার ইসরাইল হয়েছে  জাতিসংঘের আইনি কমিটির সভাপতি! এর আগে অর্থের জোরে সৌদি সরকার হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটির সভাপতি!  তাই এ দুই সরকারই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নানা প্রতিবেদনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই চলেছে! #

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/৩১