খুচরা বাজারে ডলারের দাম ১০২ টাকা
অস্থিরতা বাড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে: সমগ্রিক অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে-সাইফুল হক
বিশ্বব্যাপী কোভিড আক্রান্ত অর্থনীতির সাথে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে নানা সংকটের মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অতিমূল্যের প্রভাব ইতিমধ্যেই আমাদের আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ডলারের উর্ধ্বমূখী ধারা সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গত এক বছরে ডলারের দর বেড়েছে ১৬ শতাংশ। আর চাঙা ডলারের প্রভাবে বিপদে পড়েছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি সামাল দিতে দফায় দফায় টাকার মান কমাচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যে বাংলাদেশ ব্যাংক–নির্ধারিত টাকায় ডলার কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। খোলাবাজারে গতকাল মঙ্গলবার ডলারের মূল্য ছিল ১০২ টাকা।
ডলারের দর বেড়ে যাওয়া মানেই আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি। বাংলাদেশকে বিশ্ববাজার থেকে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, সার, গমসহ প্রায় সব ধরনের পণ্য বেশি দামে আমদানি করতে হচ্ছে। আর এর মাধ্যমেই এখন মূল্যস্ফীতিও আমদানি হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতির কারণে বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়, কষ্টে আছে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। সামনে আসছে বাজেট। এই বাজেটে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর কথাও বলছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে বাম রাজনৈতিক জোটের সমন্বয়ক অর্থনীতির ছাত্র সাইফুল হক রেডিও তেহরানকে বলেন, দেশের সমগ্রিক অর্থনীতি একটা বিপর্যয়ের সন্মুখীন । এ অবস্থায় আসন্ন বাজেট ঘোষণার আগে সরকারকে কিছু নীতিগত এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে হবে। দুর্নীতি অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে ।
বাণিজ্য ঘাটতি
আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এতে আমদানির পরিমাণ যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে এর ব্যয়। ফলে রপ্তানি আয় বাড়লেও সে তুলনায় আমদানি ব্যয় এতটাই বেড়েছে যে বাণিজ্য ঘাটতি হয়ে গেছে বিশাল।
অন্যদিকে করোনার সময় প্রবাসী আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশে ছিল বরাবরই ভালো প্রবৃদ্ধি। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই এই আয় নিম্নগামী। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বৈদেশিক প্রায় সব ক্ষেত্রেই আয় কমে গেছে, অথচ বেড়েছে ব্যয়। এতে চলতি হিসেবে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে। ভারসাম্যহীনতা আছে সামগ্রিক লেনদেনেও। বাণিজ্য ঘাটতিতেও তৈরি হচ্ছে নতুন রেকর্ড।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী,গত জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৪৪ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। আমদানি ব্যয়ের এই পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে আমদানি ব্যয় দাঁড়াবে ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি ডলারে। আমদানি ব্যয়ের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে দ্রুত।
২০২১ সালের ৩০ জুন দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ৪ হাজার ৬৩৯ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আর এখন সেটি কমে হয়েছে ৪ হাজার ৩৪৩ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এই রিজার্ভ এখন আর সাত মাসের আমদানির মূল্যের জন্য যথেষ্ট নয়।
বিশিষ্ট অর্থনিতীবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, ঢাকার একটিবহুল প্রাচারিত দৈনিকে আজ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে অর্থনীতির অশনি সংকেত দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, দেশের রপ্তানি আয় কোভিড-পরবর্তী সময়ে চাঙা হয়ে উঠলেও তা আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আবার রেমিট্যান্স আয় না বেড়ে বরং কমেছে। এর ফলে বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আগামী মধ্য-মেয়াদি সময়ে মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধের পরিমাণও দ্রুত বাড়বে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাজারে ছেড়ে ডলারের মূল্য কমিয়ে রাখা সমীচীন বা সম্ভব নয়। আর ডলারের দাম বাড়াটা অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতিতে ঘৃতাহুতি দেওয়ার মতো হতে পারে।
তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার ওপর মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব লাঘব করার আগাম প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। প্রশ্ন হলো এ জন্য বাজেটে যথেষ্ট বরাদ্দ রাখার সুযোগ কতখানি আছে। আবার সারের ওপরও বড় অঙ্কের ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আপাতত নতুন প্রকল্প হাতে না নিয়ে আপৎকালীন অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য বাজেটে সাধ্যমতো বরাদ্দ রাখা সমীচীন হবে।#
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/গাজী আবদুর রশীদ/১৮