বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ এক লাখ কোটি টাকা: করণীয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা। বিশাল অংকের ঋণ খেলাপি হওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যাংকগুলোকেই দায়ী করেছে। আর খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ার ব্যর্থতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে আইনের দুর্বলতাকে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের কারণ এবং তা কমিয়ে আনতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংকিং খাতের সমস্যা চিহ্নিত এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা এবং সমাধানের বিষয় পৃথকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদ্য প্রস্তুত করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতার কারণেই খেলাপি ঋণের সমস্যা বাড়ছে। তবে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থতার জন্য প্রধানত: দায়ী আইনি দুর্বলতা। এ ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত আইনে আমূল সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মনে করছেন, দেশের আর্থিক খাতে যে নৈরাজ্য, লুটপাট চলছে- তার জন্য কেবলমাত্র আইনি সংস্কারই যথেষ্ট নয়। আইন কার্যকর করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দৃঢ়তা দেখাতে হবে। কারণ বড় বড় ঋণখেলাপীরা এখন সরকার ও ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রশ্রয়েই মোটাতাজা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন রেডিও তেহরানকে বলেন, সরিষার মধ্যে ভুত রেখে যেমন ভূত তাড়ানো সম্ভব নয় তেমনি ঋণখেলাপীদের রাজনৈতিকভাবে পৃষ্টপোষন করে আর্থিক খাতের উন্নতি সম্ভব নয়।
একই বিষয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আইনের সংস্কার দরকার; তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি শক্তিশালী করতে হবে।
ওদিকে, অর্থঋণ আদালতে চলমান মামলার কারণে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ আটকে আছে। এটি মোট খেলাপি ঋণের চেয়েও বেশি। তাই প্রতিবেদনে ২৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের মামলা ‘ফাস্ট ট্র্যাকের’ (অগ্রাধিকার তালিকায়) অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংক কম্পানি আইনও সংশোধনের কথা বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ গ্রহীতা নির্বাচনে দুর্বলতা, ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানতের অপর্যাপ্ততা, অতিমূল্যায়ন, ঝুঁকি বিশ্লেষণে দুর্বলতা, এক ব্যাংক কর্তৃক অন্য ব্যাংকের খারাপ ঋণ অধিগ্রহণ, চলতি মূলধনের পরিমাণ নির্ধারণ না করা, একাধিক ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্নভাবে প্ররোচিত হয়ে ঋণ প্রদান, শাখা পর্যায়ে ঋণ প্রদানের দুর্বলতা, ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের সুবিধার অসৎ ব্যবহার খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ।
এসব সমস্যা সমাধানে মনিটরিং বাড়ানো, পর্যবেক্ষক দলের পরিমাণ বৃদ্ধি, ভালো ঋণগ্রহীতাদের প্রণোদনা, ভালো ব্যাংককে পুরস্কৃত করা, খারাপ ব্যাংকের পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, পারফরম্যান্স মূল্যায়ন, ঋণদানে ঝুঁকি না নেওয়া, কেওয়াইসি (নো ইউর কাস্টমার) ভালোভাবে যাচাই করাসহ নানা সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে এসব কিছু ছাপিয়ে খেলাপি ঋণের অর্থ উদ্ধারে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, দেশের মোট খেলাপি ঋণের চেয়েও বেশি পরিমাণ অর্থ আটকে আছে অর্থঋণ আদালতে। দেশের ৬৪ জেলায় অর্থঋণ আদালতে ৫৭ হাজার ৪১৬টি মামলা চলমান রয়েছে। এসব মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ এক লাখ ১০ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। বড় ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালতে রিট করে স্থগিতাদেশ নিয়ে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিচ্ছেন। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব রিট মামলার সংখ্যা পাঁচ হাজার ৩৭৬টি। জড়িত অর্থের পরিমাণ ৫২ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা।
এ বিষয়গুলো উল্লেখ করে অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের ওপর জোর দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।এ ছাড়া্, অর্থঋণ মামলার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী আদেশ বা রিট মামলা দায়ের করা, আদালত কর্তৃক সুদ মওকুফের পক্ষে রায় দেওয়া- এসব বিষয়েও আইন সংস্কারের পক্ষে সুপারিশ করা হয়েছে।
এ প্রতিবেদনে, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করেই ঋণখেলাপির মৃত্যু হলে তার দায় উত্তরাধিকারকেই নিতে হবে বলে মত দিয়েছে মন্ত্রণালয়। অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর ৩৪(২) ধারা মতে, ঋণগ্রহীতার মৃত্যুর কারণে তার দায়দায়িত্ব পারিবারিক উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী ওয়ারিশদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। মন্ত্রণালয় বলছে, যেহেতু উত্তরাধিকারীগন ঋণখেলাপির সম্পদ ভোগ করবে, তাই ঋণরর দায়ও তাদের নিতে হবে। এ জন্য এ সংক্রান্ত আইনের সংশ্রিষ্ট ধারাটি সংশোধন করে “উত্তরাধিকাররা ঋণগ্রহীতার দায় নেবেন” এমনটি উল্লেখ করার কথা বলেছে মন্ত্রণালয়।#
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/১৮