মন্দ ঋণ দিয়ে ২৪টি পদ্মা সেতু বা ১৪টি মেট্রোরেল করা যেত
শ্বেতপত্রের প্রতিবেদন: ১৫ বছরে পাচার হয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা
বাংলাদেশের বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
শ্বেতপত্র কমিটি বলেছে, বিগত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে যে মন্দ ঋণ তৈরি হয়েছে, তা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল বা ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেত বলে জানিয়েছে শ্বেতপত্র কমিটি। তারা বলেছে, গত ১৫ বছরে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংক খাত। মন্দ ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ আকাশ ছুঁয়েছে। দেশের ব্যাংক খাত কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে ঢুকে গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল (ক্রীড়নক), আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন।

রোববার(১ নভেম্বর) অর্থনীতি নিয়ে তৈরি শ্বেতপত্র প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। ওই প্রতিবেদনে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের টাকা পাচারের আনুমানিক এই চিত্র তুলে ধরা হয়। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি রিপোর্টস (জিএফআইআরএস) এবং কিছু নির্দিষ্ট পূর্বানুমানের ভিত্তিতে টাকা পাচারের হিসাব করেছে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে অর্থ পাচার বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। টাকা পাচারের বিষয়টিকে অর্থনীতিতে ক্ষতিকর ‘টিউমার’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে এই প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, বিগত সরকারের আমলে অর্থনীতি ও সম্পদের বড় অংশ এই ক্ষতিকর টিউমার চুষে নেয়।
কোথায় কীভাবে টাকা পাচার হয়
দেশ থেকে কারা, কীভাবে, কোথায় টাকা পাচার হয়েছে—সেই চিত্র তুলে ধরে শ্বেতপত্রে বলা হয়, টাকা পাচারের জন্য দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের ক্রীড়নক, আমলাদের মধ্যে একধরনের অনৈতিক চক্র গড়ে ওঠে। ঘুষ-দুর্নীতি, আর্থিক অপরাধ, মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে বাণিজ্য, ব্যাংক থেকে চুরি করা টাকা, খেলাপি ঋণের অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেখানো, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, কর ফাঁকি—এসব কর্মকাণ্ডের অর্থ পাচার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ করের অভয়ারণ্য নামে পরিচিত ছোট ছোট দেশে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে। মূলত বাড়ি কিনে এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করে টাকা পাচার করা হয়।
এস আলমের পাচারের সুবিধার্থে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপানো হয়েছিল: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব
এদিকে, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, পতিত স্বৈরাচারী সরকার তাদের পতনের কিছুদিন আগে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছিল এস আলম গ্রুপকে পাচারে সাহায্য করার জন্য।

রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। শফিকুল আলম বলেন, 'স্বৈরাচার পতনের ছয় মাস আগে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছিল। আমাদের গভর্নর বলেছেন যে, ওই পুরো ৬০ হাজার টাকা ছাপানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল এস আলমকে পাচারে সাহায্য করা।'
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকার তারল্য-সহায়তার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এই টাকা কিছু ব্যাংককে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য ছাপানো হচ্ছে। এটা অনেকটা চৌবাচ্চার পানির মতো। একদিক থেকে আসবে, অন্যদিক থেকে বেরিয়ে যাবে। এটা মার্কেটে অতিরিক্ত টাকা হিসেবে থাকবে না। বিধি মেনেই এটা করা হয়েছে।'
শফিকুল আলম আরও বলেন, 'গত ১৫ বছরে যা হয়েছে তার ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহির ব্যবস্থা করা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে। এটার বিচার তো হবেই। আর যারা মহাচুরি করেছে, তার তো অবশ্যই বিচার হবে। কেউ ছাড় পাবে না।'
'আমরা এভিডেন্স সংগ্রহ করে মামলা করব, কিছু ক্ষেত্রে হচ্ছেও। দুর্নীতি দমন কমিশন দ্রুত এই কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাবে। ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে,' যোগ করেন তিনি।
প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, 'কর্ণফুলি টানেল করা হয়েছে, কিন্তু সেখান দিয়ে কেউ যাচ্ছে না। এই পুরোটা করা হয়েছে সাইফুজ্জামানের নির্বাচনী এলাকায় যাওয়ার জন্য। সেখানে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে প্রাসাদ করা হয়েছে। জনগণের টাকায় এসব করা হয়েছে। এই চুরিটা আমাদের সামনে হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'টাকা নিয়ে চলে গেল, কিন্তু এটা আনাটা অনেক প্রক্রিয়ার বিষয়। লিগ্যাল বিষয় আছে, টাকাটা ট্রেস করতে হয় যে কোথায় আছে, এগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। আমরা সেটা করছি এবং তাদের পরামর্শ নিচ্ছি যে কীভাবে টাকাটা ফেরত আনা যায়।#
পার্সটুডে/জিএআর/২