ভারতে কৃষকদের করুণ মৃত্যু
উত্তর প্রদেশে বেওয়ারিশ পশুর হাত থেকে ফসল বাঁচাতে প্রাণ হারাচ্ছে কৃষক
ভারতে বিজেপিশাসিত উত্তর প্রদেশে প্রচণ্ড ঠান্ডায় বেওয়ারিশ গবাদি পশুর হাত থেকে ফসল বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন কৃষকরা।
২০১৯ সালের ২০তম পশুশুমারি অনুসারে উত্তর প্রদেশে ১১.৮ লাখ বেওয়ারিশ গবাদি পশু রয়েছে। কিন্তু উত্তর প্রদেশ সরকারের পশুপালন বিভাগ ২০২২ সালের জুনে বেওয়ারিশ পশুর প্রকৃত সংখ্যা জানতে একটি জরিপ চালায়। ওই জরিপ অনুসারে রাজ্যটিতে মোট ১১ লাখ ১৩ হাজার ৩৫টি বেওয়ারিশ পশু রয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে উত্তর প্রদেশে প্রচুর পরিমাণে বেওয়ারিশ পশু রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আজ (বৃহস্পতিবার) রেডিও তেহরানের শ্রোতা আনন্দ মোহন বাইন বলেন, ‘উত্তর প্রদেশে আমার যেসব বন্ধু-বান্ধব আছে তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি যতটুকু জেনেছি, কিছু কিছু ব্যাপার আছে যে, কিছু সিদ্ধান্ত আমরা এমন নিই, যার ফলে সাধারণ মানুষের অনেক ক্ষতি হয়। আপনারা ভালো বুঝবেন যে কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রাত জেগে পাহারা দেওয়া তাদের পক্ষে এমন একটা সমস্যায় দাঁড়িয়ে গেছে, প্রচণ্ড শীত। কিছু বিষয় আমরা সবাই জানি। কিন্তু জানা সত্ত্বেও সঠিক ব্যবস্থা যাদের নেওয়ার কথা, তারা কিন্তু সঠিক ব্যবস্থা নেয় না। তার ফলে সাধারণ মানুষের এই ভোগান্তি।’
আনন্দ মোহন বাইন বাবু আরও বলেন, ‘রাজনীতির কিছু ব্যাপার, কীভাবে ভোট পাওয়া যাবে, এই মূল মন্ত্র নিয়ে যারা কাজ করে তার ফলে সমস্যা। আমার অনেকেই পরিচিত আছেন, তারা যে কথাগুলো বলে, সত্যিই খুব মর্মান্তিক ব্যাপার! আপনি ফসল লাগালেন, ফসল লাগানোর পরে আপনি পাহারা দিচ্ছেন, তার পর এই যে এত গবাদি পশু যেভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের কেউ দেখার নেই। যেখানে গরুগুলো থাকবে, সেই বিষয়ে যেসব প্রস্তাব হয়েছিল সেগুলো ঠিকমতো কিছুই হয়নি। এরফলে সাধারণ মানুষেরই সমস্যা। আপনি, আমি, আমরা সবাই জানি যে কেন এই অবস্থাগুলো হচ্ছে। কিন্তু অনেক সময়ে কী হয়, অনেক ব্যাপারে প্রতিবাদ করাটাও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়’ বলে মন্তব্য করেন আনন্দ মোহন বাইন।
উত্তর প্রদেশের পশুপালন দফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গবাদি পশু উন্নয়ন), ড. রাজেশ কুমার বলেন, উত্তরপ্রদেশে ৬ হাজার ৭২৩টি গোশালা রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৯.৫৮ লাখ বেওয়ারিশ পশু সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর বাইরে প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার বেওয়ারিশ পশুকে মুখ্যমন্ত্রীর গরু সংক্রান্ত প্রকল্পের অধীনে জনগণকে দেওয়া হয়েছে। একজন ব্যক্তি যদি একটি বেওয়ারিশ পশুর যত্ন নেন, তাহলে তিনি দৈনিক ৩০ টাকা পান।
এ ধরণের পশুদের জন্য এত চেষ্টা করা সত্ত্বেও উত্তর প্রদেশের গ্রামে গ্রামে বিপথগামী পশুদের এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এসব পশুর হাত থেকে ফসল বাঁচাতে কৃষকরা দিনরাত তাদের ক্ষেত পাহারা দিচ্ছেন। প্রত্যেকটি খামারে ভারা এবং কুঁড়েঘর দেখা যায়। বর্তমানে ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকায় কৃষকদের সমস্যা আরও বেড়েছে। শীতের রাতে তাপমাত্রার পারদ নেমে গেলে ফসল রক্ষা করতে মাঠে রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা।
উন্নাও জেলার দেবরাকালা গ্রামের নানহা লোধিও (৪৯) বাধ্য হয়ে মাঠে গিয়েছিলেন, তার ঠান্ডা লেগেছিল এবং তিনি মাঠেই মারা যান। নানহা লোধিই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তিনি স্ত্রী, ৪ মেয়ে ও ১৩ বছরের এক ছেলে রেখে গেছেন, যাদের কাছে বেঁচে থাকার জন্য মাত্র আধা বিঘা জমি রয়েছে।
নানহা লোধির ভাগ্নে নীরজ কুমার (২৯) বলেন, আমরা তাকে বলতাম ঠান্ডায় খামারে না যেতে। কিন্তু সে বলত যে সে ক্ষেতে না গেলে, পশুরা পুরো ফসল নষ্ট করে দেবে, তাহলে সে পরিবারকে কী খাওয়াবে? কিন্তু এখন জীবনই হারিয়ে গেল।’ কৃষক নানহা লোধির মৃত্যুর বিষয়ে উন্নাও সদরের এসডিএম নূপুর গোয়েল বলেন, ‘শৈত্য প্রবাহের কারণে কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিহতের পরিবারকে চার লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর কৃষক দুর্ঘটনা প্রকল্পে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
নানহা লোধির মতো, ঝাঁসি জেলার পিপ্রোখার গ্রামের কৃষক রাজু ব্রারও (৪৫) বেওয়ারিশ পশুদের হাত থেকে ফসল বাঁচাতে মাঠে গিয়েছিলেন, এবং সেখানে তিনি ঠান্ডার কারণে মারা যান। রাজু ৭০ বছর বয়সী মা, ১৭ ও ১৫ বছর বয়সী দুই মেয়ে এবং ১২ ও ১০ বছর বয়সী দুই ছেলে রেখে গেছেন। এ ছাড়া মহাজনের ঋণও প্রায় ৩ লাখ, যা এখন শোধ করতে হবে রাজুর পরিবারকে।
একইভাবে মারা গেছেন চন্দ্রভান প্যাটেল (৫৯)। তিনি উত্তর প্রদেশের উন্নাওয়ের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ক্ষেতে ফসল পাহারা দিতে গিয়ে বেওয়ারিশ গবাদি পশুর আক্রমণে মারা গেছেন। পশুদের হাত থেকে ফসল বাঁচাতে ৪ জানুয়ারি রাতে ফসলের ক্ষেতে গিয়েছিলেন চন্দ্রভান প্যাটেল। এখানে বেওয়ারিশ পশু তাকে আক্রমণ করে। মাঠের কাঁটাতারে জড়িয়ে পড়ে চন্দ্রভানের পা ভেঙে যায়। শীতের রাতে আহত অবস্থায় খামারে পড়ে থেকে তিনি মারা যান। পরিবারের লোকজন তার মৃত্যুর জন্য বেওয়ারিশ পশুদের দায়ী করেছেন।
বেওয়ারিশ গবাদি পশুরা উত্তর প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। গ্রামাঞ্চল থেকে এ ধরনের ঘটনা সামনে আসার অন্যতম কারণ হল উত্তর প্রদেশের একটি বড় অংশ গ্রামাঞ্চলে বাস করে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে উত্তর প্রদেশে জনসংখ্যা হল ১৯.৯ কোটি এবং এর ৭৭.৭৩ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায় বাস করে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও এমন খবর আসছে যে কৃষকরা বেওয়ারিশ পশুদের ঘিরে ধরে সরকারি অফিস ও ভবনে বেঁধে রাখছেন। এমনই খবর এসেছে মীরাট, উন্নাও, আমরোহা, বারাবাঙ্কিসহ আরও অনেক জেলা থেকে। আমরোহায় সরকারী স্কুলে বেওয়ারিশ পশুদের তালাবদ্ধ করার জন্য কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই উত্তর প্রদেশের উন্নাওতে একটি নির্বাচনী সভায় বলেছিলেন, ‘বেওয়ারিশ পশুদের কারণে উত্তর প্রদেশের কৃষকরা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা আমরা গুরুত্বের সাথে দেখছি। আমরা উপায় খুঁজে পেয়েছি। ১০ মার্চ আদর্শ আচরণবিধির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে, একটি নতুন সরকার গঠিত হবে। এর পরে, আমরা যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে সেই সমস্ত নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব।’ কিন্তু রাজ্যটিতে নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর ১০ মাসেরও বেশি সময় হয়ে গেলেও এখনও সেখানে বেওয়ারিশ পশুজনিত সমস্যা একই রয়েছে বলে জানা গেছে।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/জিএআর/১৯