'এনআরসি থেকে যাদের বাদ দেয়া হয়েছে তাঁরা কেউ আকাশ থেকে পড়েননি'
(last modified Sun, 27 Oct 2019 14:59:45 GMT )
অক্টোবর ২৭, ২০১৯ ২০:৫৯ Asia/Dhaka

ভারতে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসিতে যাদেরকে নাগরিকত্বহীন করার চেষ্টা হচ্ছে তাঁরা কেউ আসমান থেকে পড়েননি বলে মন্তব্য করেছেন সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মাদ কামরুজ্জামান। আজ (রোববার) রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।

মুহাম্মাদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘এনআরসি নিয়ে যাদেরকে আজ দেশান্তরিত বা বেনাগরিক করার চেষ্টা হচ্ছে এই মানুষগুলোতো আসমান থেকে পড়েনি কিংবা মাটি ভেদ করে মাটি ফুঁড়েও ওঠেনি! এরা অবিভক্ত ভারতের সন্তান। রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ বাড়ানোর জন্য, সরকারের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য তাঁরা আমাদের অবিভক্ত বাংলার মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। এজন্য দায়ী তো রাষ্ট্রনেতারা! যারা  কাঁটাতার দিয়েছে, প্রশাসনকে পরিচালনা করছেন তাঁরা দায়ী। সাধারণ মানুষ কেন এজন্য ভুক্তভোগী হবে এবং এর মাশুল গুণতে হবে? সাধারণ মানুষের উপরে কখনওই এনআরসি করে হোক কিংবা কোনোভাবেই হোক, কোনও নাগরিককে অবিভক্ত ভারতের যেখানেই বাস করুক না কেন, বিগত দিনে একাধিক চুক্তি হয়েছে সেই সব চুক্তিকে সম্মান জানিয়ে কোনও ভারতবাসীকেই যে ধর্মেরই হোক না কেন কাউকে বেনাগরিক করা ঠিক নয়।’   

রেডিও তেহরান :  পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি কার্যকর হলে তা কতখানি আশঙ্কার কারণ হতে পারে?  

কামরুজ্জামান : দেশের সরকার যখন জনস্বার্থবিরোধী এবং দেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কর্মসূচি নেয় তখন বুঝতে হবে যে শাসক আত্মঘাতি রাস্তায় হাঁটছে। আমাদের দেশে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কাঠামো আছে, সেই কাঠামোকে মুছে দিয়ে যেভাবে বিজেপি ও শাসকগোষ্ঠী এক মেরুকরণ করতে চাচ্ছে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক! সেই সাম্প্রদায়িক খেলা খেলতে গিয়ে অসমে মুসলিমদের বেনাগরিক করে দিয়ে ওখানকার যারা হিন্দু ভাইয়েরা আছেন তাঁদের নাগরিকত্ব দেয়ার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি বিজেপিরাই দিয়েছিল। আজকে সেটা বিজেপির কাছে বুমেরাং হয়েছে! মুসলিমরা এদেশের ভূমিপুত্র। দেশভাগ হওয়ার পরে তাঁরা পূর্ব-পাকিস্তান বা পশ্চিম-পাকিস্তানে যায়নি। ভারতবর্ষকেই নিজেদের মাতৃভূমি বলে সমস্ত চ্যালেঞ্জ নিয়েও তাঁরা এখানে থেকে গিয়েছে। ফলে এনআরসিতে তাঁদের নাম উঠবে এটা স্বাভাবিক। কিছু মানুষের নাম ওঠেনি এটা দারিদ্রতার কারণে। স্বল্পশিক্ষার কারণে তাঁরা ভাবেননি যে স্বাধীনতার ৭০ বছর পরে গিয়ে তাঁদের পূর্বপুরুষরা এদেশের নাগরিক ছিলেন তার প্রমাণ দিতে হবে। কিন্তু আজকে সরকার সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি নিয়ে এসেছে। সেজন্য দারিদ্রতা ও অশিক্ষার কারণে কিছু মুসলিম যারা এখানকার স্থায়ী নাগরিক তাঁদের নাম ওঠেনি। বাকি হিন্দু ভাইরা দেশভাগ হওয়ার কারণে দেশান্তরিত হয়ে এদেশে এসেছেন। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি ছিল, নেহরু-লিয়াকত চুক্তি ছিল। ফলে সেই চুক্তি অনুযায়ী হিন্দু ভাইরা এখানে নাগরিকত্ব পাবেন তা স্বাভাবিক। তাঁরা নাগরিকত্ব পান সেটা আমরা মুসলিমরাও চাই। কেননা প্রতিবেশী বিপদে পড়বে, প্রতিবেশী হিন্দু ভাইরা বেনাগরিক হবেন, তাঁদের সম্পত্তি থাকবে না, তাঁদের সন্তান সন্ততিদের স্থায়ী বাসস্থান থাকবে না এটা ঠিক নয়। হিন্দু বলে তাঁরা একটা সময়ে এখানে  উদ্বাস্তু হয়ে এসেছেন। এখন আবার হিন্দু ভাইরা উদ্বাস্তু হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাবেন- এগুলো অত্যন্ত অমানবিক!  একজন মুসলিম হিসেবে এই অমানবিকতাকে আমরা পছন্দ করি না, সমর্থন করি না। সেজন্য আমরা চাই এনআরসি হোক কিন্তু এনআরসিকে হাতিয়ার করে সরকার ক্ষমতায় আসবে, সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও মেরুকরণ তৈরি করবে এটা কাম্য নয়। মুসলিমদের সুযোগ বুঝে বেইনসাফ করা হবে, তাঁদেরকে ষড়যন্ত্র করে এনআরসি থেকে নাম বাদ দেয়া হবে সরকারের এই প্রচেষ্টাকে আমরা কোনোভাবেই মেনে নেবো না, বরদাস্ত করব না। সেজন্য আমরা চাই সরকার সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করুক। ধর্ম নিয়ে যে খেলতে শুরু করেছে, কখনও ৩৭০ ধারা, কখনও অযোধ্যায় জোর করে রাম মন্দির মানানোর চেষ্টা, কখনও গণপিটুনি, কখনও এনআরসি –এসব খেলা বাদ দিয়ে দেশে যে আজ অর্থনৈতিক মন্দা এসেছে, সেই অর্থনৈতিক মন্দা কাটানোর জন্য চেষ্টা করুক।’

(বামে) আবদুল হাকিম এবং (ডানে) মুহাম্মদ কামরুজ্জামান

রেডিও তেহরান : বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে যেসব অমুসলিমরা এসেছেন তাঁদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া এবং ওই সব দেশ থেকে যেসব মুসলিমরা এসেছেন তাঁদেরকে বিতাড়িত করার চেষ্টা হচ্ছে এটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

কামরুজ্জামান : স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে এসে এবারই প্রথম ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে পার্লামেন্টে কোনও বিল আসছে। মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ডের অনুমতি বা পরামর্শের বাইরে গিয়ে সরকার কখনও পার্লামেন্টে বিল পাস করা হয়নি। কিন্তু এবারই দেখা গেল তালাকের মতো মুসলিমদের একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়ে মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে। যে মন্ত্রিসভায় একজনমাত্র নামধারী মুসলিম আছেন! ভারতের মতো একটা দেশ যেখানে পৃথিবীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া ছাড়া সবচেয়ে বেশি মুসলিম বাস করে ভারতে। সেই ভারতের মুসলিমদের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তাঁদেরকে বাদ দিয়ে! এ থেকেই স্পষ্ট যে, মোদি সরকার মুসলিমদের দমনপীড়ন নীতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। আইনি পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তাঁরা দমন করতে চাচ্ছে, এটা অত্যন্ত হিটলারি পদক্ষেপ, স্বৈরাচারী পদক্ষেপ। আমরা এসবের তীব্র বিরোধিতা করেছি। নাগরিকত্ব বিলও তাঁরা একইভাবে নিয়ে আসতে চাচ্ছে। যদি তাঁরা বলেন যে, ধর্মীয় কারণে যারা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ বা প্রতিবেশী দেশ থেকে এখানে আসছেন, তাহলে তো আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে বাঙালি তাঁরা, কেবলমাত্র মুসলিম হওয়ার কারণে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতে এসেছে। তাদেরও নাগরিকত্ব দিতে হয়। ভারতের এমন সংস্কৃতি আছে যে, সব সময় শরণার্থী বা বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে আমাদের দেশ দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনিদের সঙ্কট নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রনেতারা ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা কিন্তু ইসরাইলের পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে, ভারতের যে বৈদেশিক নীতি, ভারতের যে অতিথিপরায়ন নীতি আছে, আজকে মোদি সরকার কেবলমাত্র ধর্মীয় কারণে সেই পরম্পরাকে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে ভারতের ১২৫ কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এবং আমার বিশ্বাস যে একটা ‘আলো’ আসছে। সেই আলোতেই নরেন্দ্র মোদি যে ‘অন্ধকার যুগ’ ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন খুব তাড়াতাড়ি আমরা তার পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারব।’#      

 

পার্সটুডে/এমএএইচ/এআর/২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ