এপ্রিল ১৮, ২০২৪ ১৫:৩৫ Asia/Dhaka
  • ইমাম খোমেইনি (র) ইসলামি রিপাবলিক অব ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ও পশ্চিম এশিয়ার প্রতিরোধের রূপকার

ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনি (র) (১৯০২-১৯৮৯) ও দেশটির ইসলামী বিপ্লবের রূপকার বা মহান নেতা দেখিয়ে গেছেন যে ইসলামী আইন ও ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন সমাজ-পরিচালনায় সক্ষম এবং এ জন্য নতুন নতুন পরিকল্পনা দিতেও সক্ষম। অন্য কথায় যে ইসলামী আইন ও ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন কেবল কোনো নির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়।

ইমাম খোমেইনি (র) ছিলেন সর্বোচ্চ ইসলামী আইনবিদের কর্তৃত্বাধীন ইরানের ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রবর্তক। তাঁর এই ব্যবস্থা ইরানি সমাজের সাংস্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক, মানবীয়, রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রসহ নানা ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্যে ভাস্বর। এ ছাড়াও এই ব্যবস্থা উপনিবেশবাদদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামিতার জাগরণকে সক্রিয় করতেও সক্ষম হয়েছে এবং তা বিশেষভাবে দেখা গেছে পশ্চিম এশিয়ায় লেবানন থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত অঞ্চলে যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ইমাম খোমেইনি (র) ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তাত্ত্বিক ধারণার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে এই তত্ত্বের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছেন। তিনি ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ছাড়া অন্য সব রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে এমনকি রাজতন্ত্রসহ অন্য সব রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকেই অবৈধ ঘোষণা করেন। এর আগে প্রচলিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থাগুলোর তত্ত্ব যেমন খেলাফত, নিয়মতান্ত্রিক বা সংবিধান-ভিত্তিক রাজতন্ত্র ও  ইসলামী আইনবিদের কর্তৃত্ব-ভিত্তিক রাষ্ট্রের তত্ত্বকে ইসলামিক রিপাবলিক তথা ইসলামী জনসাধারণের শাসনতন্ত্রের তত্ত্বে উন্নীত করেন। সাম্প্রতিক দুই এক শতকের অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে ইমাম খোমেনির ইসলামী আন্দোলনের পার্থক্য এখানেই। 

একজন ধর্মীয় আইনবিদ নেতার নেতৃত্বে ইরানে রাজতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থা উৎখাত করে ইসলামী জনসাধারণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছিল সমসাময়িক যুগে ইসলামী জাগরণ-ভিত্তিক আন্দোলনগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। ইমাম খোমেইনির চিন্তাধারার আরেকটি বড় তাত্ত্বিক সাফল্য হল ইসলামি রিপাবলিক ব্যবস্থার একটি সংবিধান অনুমোদন করা। ইরানের চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত শ্রেণী ছাড়াও জনগণ গণভোটের মাধ্যমে এই সংবিধানকে অনুমোদন করেছে। আধুনিক যুগের এবং স্থান বা অঞ্চলের চাহিদার সমাধানও দেখানো হয়েছে এই সংবিধান ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায়।

ইমাম খোমেইনির নানা বয়সের কয়েকটি ছবি 

 

ইরানের ইসলামী জন-রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সংবিধানে রয়েছে ইসলামী শিক্ষা ও নির্বাহী ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত রেনেসাঁ পরবর্তী যুগ হতে পরবর্তীকালের মানবজাতির অভিজ্ঞতার সমন্বয়। সংবিধানটির ভিত্তি হল ইসলামী শিক্ষা ও এর কাঠামোর ভিত্তি হল সংস্কার যুগের মানবীয় প্রজ্ঞা। শুরা বা জনগণের অংশগ্রহণের ব্যবস্থাও রয়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায়। রয়েছে রাষ্ট্রের নানা বিভাগের স্বাধীনতা বা বিভাজন। বিচার-বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ (রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে), আইন বিভাগ তথা মজলিসে শুরায়ে ইসলামী বা ইসলামী পার্লামেন্ট, অভিভাবক পরিষদ, বিশেষজ্ঞ পরিষদ, রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী পরিষদ, জাতীয় নিরাপত্তা উচ্চ-পরিষদ এবং নগর-পরিষদগুলো সংবিধানে সমহিমায় ভাস্বর। 

ইমাম খোমেইনি (র) প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জোট বা দুই প্রধান পরাশক্তির জোটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি মুসলিম বিশ্বে মার্কিন ও ইহুদিবাদী আধিপত্যকামিতা আর স্বৈরতন্ত্রের মোকাবেলায় গড়ে তুলেছিলেন মুসলিম উম্মাহর প্রতিরোধ আন্দোলন। 

ইমাম খোমেইনির নেতৃত্বে ইরানের ইসলামী বিপ্লব রাজনৈতিক ইসলাম ও ধর্মীয় রাষ্ট্র-ব্যবস্থার প্রভাব সৃষ্টি করেছে বিশ্ব-রাজনৈতিক অঙ্গনে ও মতাদর্শিক ক্ষেত্রে। 

অন্যদিকে ঘরোয়া ক্ষেত্রে জনগণকে তথা জনগণের অংশগ্রহণকে সব বিষয়ের কর্তা মনে করতেন তিনি। আর বহির্বিশ্বের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উপনিবেশবাদ-বিরোধী ও মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার সমর্থক।

ইমাম খোমেইনি ও ইমাম খামেনেয়ী 

 

ইমাম খোমেইনি (র)'র কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র-পরিচালনা বিষয়ক বক্তব্য এখানে তুলে ধরছি: 
১.ইসলামী রাষ্ট্রের তিন মূলনীতি: 
ইসলামী শাসকের মধ্যে ন্যায়বিচার, শাসক নির্বাচনে ও নিজ ভাগ্য নির্ধারণে জনগণের ভোটাধিকার এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষা বাইরের বিজাতীয়দের হস্তক্ষেপ থেকে ও মুসলমানদের বিষয়ে তাদেরকে কর্তৃত্ব করতে না দেয়া। 
২. রিপাবলিক ব্যবস্থা বা জনসাধারণতন্ত্র
ইসলামিক রিপাবলিক একদিকে রিপাবলিক অন্যান্য রিপাবলিকগুলোর মতই, কিন্তু এর আইন হচ্ছে ইসলামী আইন। 
৩. ইসলামি রিপাবলিকের দায়িত্ব: 
"ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কাজের ভিত্তি হল দেশের স্বাধীনতা এবং আমাদের জাতির স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি ও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সমস্ত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইসলামী মানদণ্ড ভিত্তিক আইন প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন। এইসব সংস্কার হতে হবে জনগণের অংশগ্রহণে। দারিদ্র নির্মূল করা ও মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন এসবের প্রধান কয়েকটি লক্ষ্যের অংশ। 
৪. সংসদের স্থান ও আইন প্রনয়ন:
 এতে জাতি তাদের প্রতিনিধি বা অভিভাবক নির্বাচন করবেন স্বাধীনভাবে এবং তারা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন।  
৫. স্বাধীন নির্বাচন ও জনগণের ইচ্ছা 
সরকারের দায়িত্ব হল স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেখানে কোনো বিশেষ শ্রেণী ও গ্রুপের শক্তি বা প্রভাব থাকবে না। 

ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবনে ইমাম খোমেনী -র. 

 

৬. পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি: 
ইসলামী সরকারের নীতি হল দেশ, সরকার ও জাতির স্বাধীনতা রক্ষা এবং জাতিগুলোর স্বাধীনতার প্রতি পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন। এক্ষেত্রে পরাশক্তি ও পরশক্তি নয় এমন দেশগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য না করা।  
৭. ফিলিস্তিন ইস্যু এবং বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ
"ইরান জাতি সব সময় হানাদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি ভাইদের সংগ্রামকে সমর্থন করেছে। আমরা সবসময় তাদের আন্দোলনকে অনুমোদন দিয়েছি এবং আমরা তাদের যথাসম্ভব সাহায্য করেছি।"
৮. মুসলিম বিশ্বের ঐক্য : 
"মুসলিম জাতিগুলো এবং ইসলামিক তথা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যের চিন্তা আমার জীবনের পরিকল্পনার শীর্ষে রয়েছে। আমি ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমি এমন ঘটনাগুলি সম্পর্কে ভীত যেগুলি মুসলিম জনগণ এবং তাদের সরকারের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে"
৯. নিপীড়িত শ্রেণী ও সামাজিক ন্যায়বিচার:

"আমি আশা করি ইসলামী রিপাবলিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে আমরা এমন এক ইসলামী ন্যায়বিচার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করব যাতে আমাদের সবার সমস্যার সমাধান হয়, কর্মচারীদের ও শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান হয়। ইসলামী জনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবশ্যই বঞ্চিতদের সহায়তা দিতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই শক্তিশালী করতে হবে। আনতে হবে আমূল পরিবর্তন।''
১০. স্বাধীনতা বা মুক্তি: 
স্বাধীনতা জনগণের। আইন তাঁদের স্বাধীনতা দিয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। ইসলাম জনগণকে স্বাধীনতা দিয়েছে। সংবিধান জনগণকে স্বাধীনতা দিয়েছে।  

পরিবারের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে ইমাম খোমেনি (র) 

 

১১. ন্যায়বিচার
ইসলাম ও এর খোদা ন্যায়বিচারক, এর নবী ন্যায়বিচারক ও নিষ্পাপ ইমামরাও ন্যায়বিচারক। তাই এর বিচারকরা ততক্ষণ নির্ভরযোগ্য যতক্ষণ ন্যায়বিচারক হবেন।
১২. মানবাধিকার 
বাক-স্বাধীনতা, নির্বাচনের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, রেডিও-টেলিভিশনের স্বাধীনতা, প্রচারের স্বাধীনতা-এসবই মানবাধিকার এবং মানুষের প্রাথমিক কিছু অধিকার। যতক্ষণ না মানুষ আধ্যাত্মিকতার উৎসের ওপর নির্ভরশীল না হবে ততক্ষণ মানুষ পরিশুদ্ধ হবে না ও মানবাধিকার রক্ষা পাবে না। 
১৩. উপনিবেশবাদ-নির্মূলকরণ 
 মুসলিম সরকারগুলোর মধ্যে বিরোধ জাতীয়তাবাদ ও পাশবিকতার যুগের ফসল। এসব সৃষ্টি করা হয়েছে জাতিগুলোকে পিছিয়ে রাখার জন্য। জাতিগুলোকে হতাশ করে রেখেছে উপনিবেশবাদীরা। যুব-প্রজন্ম জেগে উঠে জাতিগুলোকে সম্ভাব্য সব উপায়ে জাগিয়ে তুলবে বলে আশা করা যায়। 

জনগণের মধ্যে ইমাম খোমেইনি (র) 

 

১৪. মার্কিন সরকারের ষড়যন্ত্র তুলে ধরা: 
"শত কোটি  মুসলমানের অধিকারকে উপেক্ষা করা এবং তাদের ভাগ্যের উপর গুণ্ডাদের কর্তৃত্বশীল করা এবং ভুয়া ইসরাইলি সরকারকেকে মুসলমানদের অধিকার হরণের সুযোগ দেয়া এবং তাদের স্বাধীনতা হরণ ও তাদের সঙ্গে মধ্যযুগীয় নির্দয় আচরণের করা; এইগুলি এমনসব অপরাধ যা মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা করছেন। 

ক্ষমতার সুষম বণ্টন ও নিজ ভাগ্য নির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রধান ভিত্তি। জনগণের রুটি-রুজির উন্নয়ন ও তাদের স্বাধীনতা রক্ষা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাও সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। 

এভাবে ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনি (র) ও দেশটির ইসলামী বিপ্লবের রূপকার বা মহান নেতা দেখিয়ে গেছেন যে ইসলামী আইন ও ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন সমাজ-পরিচালনায় সক্ষম এবং এ জন্য নতুন নতুন পরিকল্পনা দিতেও সক্ষম। অন্য কথায় যে ইসলামী আইন ও ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন কেবল কোনো নির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। 


সূত্র: সাইয়্যেদ সালমান সাফাভি, 'ইসলামী রিপাবলিক অব ইরানের আদর্শিক দর্শন';
ইমাম খোমেনির (র) নানা বক্তব্য ও বাণীর বই সহিফায়ে ইমাম।  #

পার্সটুডে/এমএএইচ/১৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন

ট্যাগ