ইরান-ইরাক যুদ্ধ: প্রেক্ষাপট ও ফলাফল
ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামকে দিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংঘটিত সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম।বিশ্বের ২৬টি দেশের সরকার এ যুদ্ধে ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
মার্কিন চিন্তাবিদ জেমস বিলের মতে, ইরান-ইরাক যুদ্ধের মূল কারণ ছিল পারস্য উপসাগরের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এই স্বপ্নটি দেখত সাদ্দাম। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের ফলে মার্কিন সরকারের সেবাদাস ও স্বৈরতান্ত্রিক রাজা শাহের পতন ঘটলে সাদ্দাম ইরান-বিদ্বেষী নীতি গ্রহণ করে।
সাদ্দাম তার দৃষ্টিতে এটা বুঝতে পারে যে, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকার নিয়োজিত পুলিশ বা লাঠিয়াল হিসেবে যেই পদে আসীন ছিল ইরানের রাজা সেই পদটি খালি হয়ে গেছে। তাই সে নিজেই এই খালি পদটি দখল করতে পারে। তবে এ জন্য ইরাকের পাশে পানির বা সমুদ্রের যথেষ্ট সীমানা থাকা দরকার এবং এ জন্য পারস্য উপসাগরের ওপরও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাদ্দাম দাবি করে যে ইরান ও ইরাকের সীমান্ত বিরোধ নিরসনের জন্য ১৯৭৫ সালে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে বাগদাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জার্মানির ইশ্পিগেল ম্যাগাজিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সাদ্দাম বলে যে, ১৯৭৫ সালের সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বাগদাদ প্রতারিত হয়েছিল। এ সময় ইরাক সরকারের কর্মকর্তারাও এটা মনে করত যে, ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান দুর্বল হয়ে গেছে, তাই এ সময় ইরানে হামলা চালানো হলে পারস্য উপসাগরের ওপর তেহরানের যে আধিপত্য রয়েছে তার অবসান ঘটবে এবং একই সময়ে দক্ষিণ ইরাকের শিয়া ও উত্তর ইরাকের কুর্দিদের সঙ্গে সমস্যা সমাধানের নতুন পথও তাদের সামনে তুলে ধরা সম্ভব হবে। এ অবস্থায় ১৯৮০ সালের জুন মাসে তৎকালীন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেজনস্কি ও সাদ্দাম ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপারে এক সমঝোতায় উপনীত হয়।
এ সম্পর্কে ফরাসি দৈনিক ফিগারো লিখেছে: ইরাকিরা দাবি করছে যে, ব্রেজনস্কি তাদের সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ অবস্থায় ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় তৎকালীন ইরাকি প্রতিরক্ষামন্ত্রী খেইরাল্লাহ ইরানে সরাসরি হামলা করার কথা ঘোষণা করে।

ইরাকি সেনারা আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে ইরানে ঢুকে পড়ে এবং সর্বোচ্চ সামরিক শক্তি নিয়ে হামলা চালায়। সেদিনই শেষ বেলার দিকে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কুর্ট ওয়ার্ল্ডহাইম বাগদাদ ও তেহরানকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের বিরোধ মিমাংশার পরামর্শ দেন।
পরের দিন ইরাকি সেনারা পশ্চিম ও দক্ষিণ ইরানের এক বিশাল অঞ্চল দখল করার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। অনানুষ্ঠানিক এক আলোচনার পর প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা লঙ্ঘন ও জাতিসংঘের আইন লঙ্ঘনের জন্য এবং ইরানের ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালানোর জন্য ইরাকের নিন্দা করা হয়নি। এমনকি ইরাকি সেনাদেরকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানায় ফিরিয়ে নেয়ার কথাও বলা হয়নি ওই বিবৃতিতে। কেবল এটাই বলা হয় যে, উভয়পক্ষ যেন সামরিক পদক্ষেপসহ এমন সব পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকে যা চলমান বিপজ্জনক পরিস্থিতিকে আরো শোচনীয় করতে পারে।
ইরানের ওপর ইরাকি হামলা অব্যাহত ও তীব্রতর হওয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯৮০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ বিষয়ে তার প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবে বল-প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে ও বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি করতে উভয় দেশের প্রতি আহ্বান জানায়। বাগদাদ এই প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেনে নেয়ার কথা জানায়। কিন্তু ইরান ইরাকের পক্ষ থেকে বার বার আলজিয়ার্স চুক্তি লঙ্ঘন ও তেহরানের ধৈর্যধারণকে দুর্বলতা হিসেবে ধরে নিয়ে বাগদাদের পক্ষ থেকে এর অপব্যবহার করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে। ইরানের মাটিতে যতক্ষণ পর্যন্ত ইরাকি সেনাদের আগ্রাসী তৎপরতা চলতে থাকবে ততক্ষণ জাতিসংঘের ওই প্রস্তাব তেহরান মেনে নেবে না বলে জানিয়ে দেয়।
ইরানের দৃষ্টিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে জানালেও কে এই যুদ্ধ শুরু করেছে তা নির্ধারণ ও ঘোষণা করেনি এবং কে আগ্রাসী ও কে আগ্রাসনের শিকার –এ তিনটি মৌলিক বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করেনি। তাই ইরান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু ইরানের এই প্রতিবাদের জবাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আরো কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। আর এইসব প্রস্তাবেও ওই তিনটি মৌলিক প্রশ্ন উপেক্ষিতই থেকে যায়।

ইরাকের সাদ্দাম সরকার ইরানে তার সামরিক আগ্রাসনকে নির্লজ্জের মত প্রতিরক্ষার পদক্ষেপ বলে প্রচারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু তেহরান তার মাটিতে ইরাকি হামলাকে আগ্রাসন হিসেবে উল্লেখ করে এই আগ্রাসনের মোকাবেলায় প্রতিরক্ষার পদক্ষেপ নেয়াকে তার বৈধ অধিকার বলে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে এবং এমনকি ইরাকের ভেতরেও এ ধরনের প্রতিরক্ষামূলক তৎপরতা চালানোর অধিকার রাখে বলে জানিয়ে দেয়। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইরানের এই অধিকারের ব্যাপারে দীর্ঘ ২২ মাস পর্যন্ত নীরব থাকে। আর এ সময়ের ভেতরে আন্তর্জাতিক সমাজের নীরবতার সুযোগে সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন ইরাক ইসলামী ইরানের বিশাল ভূখণ্ডের মধ্যে তার জবরদখল পাকাপোক্ত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ধীরে ধীরে ইরানি মুজাহিদরা প্রতিরোধ যুদ্ধে সাফল্য পেতে থাকে এবং এক পর্যায়ে দক্ষিণ ইরানের খুররম শহরকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। আর এই বিশাল সাফল্য যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং তা রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরও ব্যাপক প্রভাবে ফেলেছে।
খুররম শহরকে মুক্ত করার ঘটনা ইরানের অবস্থানকে ইরাকের চেয়ে শক্তিশালী করে দেয়। ফলে আগ্রাসী সাদ্দাম সরকার মারাত্মক সংকটের শিকার হয়। ইরাকের জনগণ ও বাথ পার্টির মধ্যে সাদ্দামের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় আরব রাজা-বাদশাহরা সাদ্দাম সরকারের কাছে তাদের অর্থ সহায়তার ঢল কিছুকালের জন্য বন্ধ করে দেয়।
১৯৮২ সালের দিকে ইরাকের অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। এ অবস্থায় ইরাকের সাদ্দাম সরকারের পতন ঘটতে পারে এবং সেখানে ইরানের মতই একটি বিপ্লবী সরকার গঠিত হতে পারে বলে মার্কিন সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ে। ফলে মার্কিন সরকার ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ইরানকে অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সামগ্রী সংগ্রহে বাধা দিতে থাকে।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান তার একজন বিশেষ প্রতিনিধিকে দেশে দেশে পাঠান যাতে তারা ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেয়। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এটা জানিয়ে দেয় যে, তেহরান যুদ্ধ-বিরতি ও বাগদাদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব না মানা পর্যন্ত ওয়াশিংটনের এই পররাষ্ট্রনীতি বহাল থাকবে।
মার্কিন সরকারের ইঙ্গিতেই যে সাদ্দাম ইসলামী ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন শুরু করেছিল গত পর্বের আলোচনায় আমরা সে সম্পর্কিত কিছু তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেছিলাম। সাদ্দাম ও আমেরিকাসহ তার গড-ফাদাররা ভেবেছিল যে ইসলামী বিপ্লবের ফলে ইরানের প্রচলিত সরকারি সশস্ত্র বাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায় দেশটি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং এর ফলে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়া খুবই সহজ হবে। সাদ্দামের সমর্থক পরাশক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রিত জাতিসংঘসহ ইরানের মাটিতে সাদ্দাম বাহিনীর আগ্রাসনের কোনো নিন্দা জানায়নি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। কিন্তু ইরান যখন প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং কথিত সাদ্দাম-সেনাদের নাগপাশ থেকে খুররম শহর মুক্ত করার মত অকল্পনীয় বিজয় অর্জনের পাশাপাশি সাদ্দাম-বাহিনীকে নানা রণাঙ্গনে ব্যাপক মাত্রায় বিপর্যস্ত করতে থাকে তখনই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মার্কিন ইঙ্গিতে যুদ্ধ-বিরতি ও শান্তির কথা বলতে থাকে। কিন্তু ইরান স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে কে আগ্রাসন শুরু করেছে এবং কে আগ্রাসনের শিকার তা উল্লেখ না করা পর্যন্ত ও আগ্রাসীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা না পর্যন্ত ইরানের পবিত্র প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে। এ অবস্থায় মার্কিন সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের ওপর অস্ত্র-নিষেধাজ্ঞাসহ নানা নিষেধাজ্ঞা জোরদারের প্রচেষ্টা শুরু করে।

সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন ইরাক এমন সময় যুদ্ধ শুরু করে যখন তার অস্ত্রাগারগুলো ছিল অস্ত্রে পরিপূর্ণ। কিন্তু ইরাকের কাছে অস্ত্র-শস্ত্রের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খুচরা যন্ত্রাংশ ছিল না। যুদ্ধের প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এ ধরনের যন্ত্রাংশের একটা খুব সামান্য অংশ বাগদাদকে সরবরাহ করতো। কিন্তু যুদ্ধের প্রথম দিকে ইরাকের পরাজয় স্পষ্ট হয়ে উঠলে ১৯৮২ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আবারও বাগদাদের প্রধান সামরিক মিত্রে পরিণত হয়। ৮২ সালের আগ পর্যন্ত ইরাককে অস্ত্র-শস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতো উত্তর কোরিয়া, মিশর, চীন ও ইয়োগোস্লাভিয়ার মত কয়েকটি দেশ। কুয়েতের দৈনিক আলকাবুস এ প্রসঙ্গে লিখেছে: "সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরাকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর জন্য এক আকাশ সেতু খুলে দেয়। গর্বাচভ কোনো কোনো আরব সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাদের এ নিশ্চয়তা দেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ইরাককে পরাজিত হতে দেবে না। "
একই সময়ে ফ্রান্সের কাছ থেকে এক্সোজেট মিসাইলসহ বিপুল অস্ত্র কেনা হয় ইরাকের জন্য। ফ্রান্স তার নির্মিত 'এফ-ওয়ান মিরাজ' জঙ্গি বিমান উৎপাদন শেষ হওয়ার আগেই দেশটির জাহাজ-বিধ্বংসী সুপার স্ট্যান্ডার্ড ৫টি জঙ্গি বিমান ইরাককে দেয় যাতে তেল-ট্যাংকারের যুদ্ধে ও ইরানের তেলসমৃদ্ধ খার্গ দ্বীপে হামলা চালানোর কাজে সেগুলো ব্যবহার করা যায়।
মার্কিন গবেষক অ্যালেন ফ্রেডম্যান এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: ইরাককে অস্ত্র সরবরাহ প্রায় প্রতি দিন অব্যাহত ছিল। ফ্রান্সে অবস্হিত ন্যাটোর একটি ঘাঁটি থেকে ইরাকের অ্যান্টোনভ বিমানগুলোতে অস্ত্র ভরা হত। ওই ঘাঁটি যেন ইরাকেরই বিমান ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ওই বিমানগুলো প্রতি দিন এ বিমান ঘাঁটিতে আসতো এবং ফরাসি ক্ষেপণাস্ত্র, ক্লাস্টার বোমা, ফিউজ ও রাডারের যন্ত্রাংশ ইরাকে নিয়ে আসত। ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ১৯৮৬ সালে এক সমীক্ষায় জানায়, 'যদি ইরাকে (অস্ত্র) সাহায্য পাঠানো তিন সপ্তাহের জন্য বন্ধ রাখা হয় তাহলে দেশটি পরাজিত হবে।'
পরবর্তীকালে ইরাকের ইরান বিষয়ক গোপন সামরিক গোয়েন্দা তথ্য সংরক্ষণ বিভাগের প্রধান ওয়াফিক আস সামরায়ি সাদ্দামের প্রতি ফ্রান্সের সহায়তার তিক্ত সত্য তুলে ধরে বলেছেন: ইরাকে ফ্রান্সের সাহায্য এতো জোরদার হয় যে ফরাসি প্রতিনিধি বাগদাদ সফরে এসে তৎকালীন ইরাকি প্রতিরক্ষামন্ত্রী আদনান খেইরাল্লাহ'র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ওই সাক্ষাতে খেইরাল্লাহকে বলেন, 'ফ্রান্স ইরাককে একটি পরমাণু বোমা দেয়ার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। যুদ্ধ থামাতে ইরানকে বাধ্য করার জন্য এই বোমা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিক্ষেপ করা যাবে। আমি (ওয়াফিক আস সামরায়ি) ফরাসি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর স্বাক্ষরিত ও সাদ্দামের কাছে পাঠানো এই প্রতিবেদন ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত একটি বিশেষ বাক্সে সংরক্ষণ করেছিলাম।'
ইরান-ইরাক যুদ্ধ ছিল এমন এক যুদ্ধ যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর প্রথমবারের মত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই প্রধান পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে তেহরানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এ ছাড়াও পাশ্চাত্যের সব সরকার ও আরব শাসকরাও সাদ্দামের সহযোগী হয়েছিল।
ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের যুদ্ধকে আক্রমণাত্মক পর্যায়ে জোরদার করতে যেসব চালিকাশক্তি সহায়তা করেছিল তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বা প্রভাবশালী চালিকাশক্তিটি হল অর্থনৈতিক সাহায্য। দীর্ঘ যুদ্ধের কারণে ইরাকের তেল রফতানির পরিমাণ কমে গিয়েছিল এবং এ অবস্থায় অস্ত্র-শস্ত্র কেনার জন্য বিপুল অর্থের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছিল সাদ্দামের ইরাক। এ সময় সাদ্দামের সহযোগী শক্তিগুলো তাকে বিপুল অংকের অর্থ ঋণ দিয়েছিল এবং এমনকি অফেরতযোগ্য অর্থ সহায়তায় দিয়েছে বিপুল মাত্রায়। বলা হয় পারস্য উপসাগরীয় আরব সরকার বা রাজা-বাদশাহরা ইরাককে ৪৫০০ কোটি ডলার অর্থ সাহায্য দিয়েছিল ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের খরচ হিসেবে। সাদ্দামকে এতো বিপুল অর্থ দেয়া না হলে সে দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতো না।
মিশরের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবু গাজালার মতে, উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব রাজা-বাদশাহরা ইরাককে আরো অনেক বেশি অর্থ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, কেবল সৌদি সরকারই ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে দিয়েছিল ছয় হাজার কোটি ডলার। কুয়েতে ইরাকের হামলা এবং সেখানে ইরাকি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পর আমেরিকায় নিযুক্ত কুয়েতি রাষ্ট্রদূত শেইখ সাবা ইরাকের প্রতি আর্থিক সহায়তা প্রসঙ্গে বলেছেন, কুয়েত ইরাককে নগদ ১৪০০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছিল। এ ছাড়াও কুয়েত ইরাককে ১৬০০ কোটি ডলার মূল্যের সেবামূলক সহায়তা দিয়েছিল ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে।
সাদ্দাম তার সরকারের প্রতি মার্কিন সহায়তার কথা বার বার উল্লেখ করেছে। ইরানের মাধ্যমে খুররম শহর দখলমুক্ত হওয়ার পর ইরাকের কাছে মার্কিন অর্থ সহায়তা প্রকাশ্য রূপ নেয়। ১৯৮২ সালের শেষের দিকে মার্কিন সরকার প্রথমবারের মত ত্রিশ কোটি ডলার অর্থ সাহায্য দেয় সাদ্দাম সরকারকে। এর পর থেকে ইরাকের জন্য মার্কিন অর্থ সহায়তা ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং এর পরিমাণ ৫০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।
সাদ্দামকে অর্থ সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে প্যারিসও পিছিয়ে ছিল না। ফরাসি দৈনিক 'লা মন্ড' ও এক্সপ্রেস জানিয়েছে, সাদ্দামের প্রতি ফরাসি অর্থ সহায়তার পরিমাণ ছিল ৫ হাজার কোটি ফ্রাঙ্ক। ফরাসি দৈনিক 'দো প্যারি'র খবর অনুযায়ী এই অর্থ সহায়তার পরিমাণ ছিল ৮ হাজার কোটি ফ্রাঙ্ক। ফ্রান্সের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্লাউড শেইসন জানিয়েছেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কোনো কোনো স্থায়ী সদস্যের অনুরোধে এবং ইসলামী ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে সহায়তা দেয়ার গোপন সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বাগদাদকে যুদ্ধের প্রথম দিকেই এই বিপুল অর্থের সামরিক ও বেসামরিক সহায়তা দেয় প্যারিস। ইরাক দেনা শোধ করতে সংকটের শিকার হওয়ায় ফ্রান্স বেশ কয়েক বার পাওনা আদায়ের কাজ স্থগিত রাখে এবং অস্ত্র কেনার জন্য সাদ্দামকে আবারও বিপুল অংকের অর্থ ঋণ দেয়।
ইরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সময় বিপুল অংকের অর্থ সাহায্য ছাড়াও সাদ্দামের সহযোগী শক্তিগুলো বাগদাদকে বিপুল পরিমাণ আধুনিক ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রও দিয়েছিল। মার্কিন লেখক ফ্রেডম্যান লিখেছেন: 'মার্কিন সরকার সিআইএ'র তৎকালীন প্রধান উইলিয়াম কেইসির পরামর্শে ইরাককে ক্লাস্টার বোমা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বোমাকে ইরানি প্রতিরোধ বানচালের জন্য উপযুক্ত অস্ত্র বলে পরামর্শ দেয়া হচ্ছিল। এই অস্ত্রটি রাসায়নিক অস্ত্রসহ অপ্রচলিত নানা অস্ত্রের মতই যুদ্ধের ময়দানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এই বোমাগুলো ঠিকমত কাজ করলে একটি ফুটবল মাঠের চেয়ে দশ গুণ বড় স্থানে ঝর্ণাধারার মত ছড়িয়ে পড়ে সব কিছুকে ধ্বংস করে দেয়।'
একই সময়ে ইতালির কাছ থেকে ৯০ লাখ মানব-বিধ্বংসী মাইন কেনে ইরাক। এই মাইনগুলোর মূল্য ছিল দুই কোটি ৫০ লাখ ডলার। ইরাকের বসরার একজন সামরিক প্রশিক্ষক বলেছেন: (মাইন বিছানের পর) মাত্র এক বার গোলা বর্ষণের মাধ্যমে দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে থাকা সব ইরানিদেরকে হত্যা করতাম। এইসব অস্ত্র ইরানি সেনাদের ঢল রুখে দিত।
ফ্রান্স প্রায় ১৬০ কোটি ডলার মূল্যের এক চুক্তির আওতায় ইরাককে ৮৩টি ভালক্যান কামান দিয়েছিল। এ ছাড়াও ইরাক ফ্রান্সের টিআরটি কোম্পানির কাছ থেকে বিশেষ ধরনের অত্যাধুনিক ফিউজ কিনেছিল। এই ফিউজ মর্টারের গোলার মাথায় বসানো হত এবং তা মাটিতে পড়ার আগেই গোলা বিস্ফারিত হত।
১৯৮২ সালের জুন মাসে বেলজিয়ামের সিকসিকো কোম্পানি ইরাকের সঙ্গে ৮৩ কোটি ডলার মূল্যের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। এ চুক্তির আওতায় ইরাকে ভূগর্ভের ৫০ মিটার গভীরে ৮০০টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পায় ওই কোম্পানি।
ইরাকের সামরিক শিল্প বিভাগের তৎকালীন প্রধান হুসাইন কামাল বলেছেন: আসলে আমরা পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টা করছিলাম। এ ছাড়াও জার্মান কোম্পানি কার্ল কুলম্ব সামেরায় ৬ টি রাসায়নিক অস্ত্রের কারখানা তৈরি করে দেয় ইরাকের জন্য। এইসব কারখানায় মাস্টার্ড ও সারিন জাতীয় নার্ভ গ্যাসসহ নানা ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করতো ইরাক। পরবর্তীকালে জার্মান ম্যাগাজিন ইশপাইগেল-এর বরাত দিয়ে বিবিসি বলেছে, জার্মানি গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের কাজে ইরাককে যে ব্যাপক পরিমাণ গবেষণাগত ও উৎপাদনগত সহায়তা দিয়েছে বিশ্বের অন্য কোনো দেশই এতোটা সহায়তা দেয়নি। কিন্তু মানবাধিকারের দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এইসব অপরাধের ব্যাপারে নীরব থেকেছে। এমনকি সাবেক মার্কিন সিনেটর রিচার্ড মরফি এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারকে ইরাকের অধিকার বলে বলে উল্লেখ করেছিলেন।
ইরাককে এতো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য দেয়া ছাড়াও সাদ্দামের সহযোগী সরকারগুলো ইরাকে অনেক দক্ষ সেনাও পাঠায়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় ইরানি পাইলটরা চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের পুরো সময়টিতেই নানা দেশের পাইলটদের শত্রুতার শিকার হয়েছেন। ইরাকের কোনো কোনো মিগ-২১ ও মিগ-২৩’র পাইলটরা ছিল মিশরীয়। ইরাকের ফরাসি মিরাজ-১ জঙ্গি বিমানগুলোর পাইলটদের মধ্যে অনেকেই ছিল বেলজিয়। বিশেষ করে ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৬ সালে এইসব ইরাকি বিমানের পাইলটরা ছিল বেলজিয়, দক্ষিণ আফ্রিকান, অস্ট্রেলিয়ান ও অন্তত একটি ক্ষেত্রে আমেরিকান। এ ছাড়াও ফরাসি ও জর্দানি বৈমানিকরা ইরাকিদের প্রশিক্ষক হিসেবে সেবা দিয়েছে। রুশ ও জার্মান পাইলটরাও মিগ-২৫ নিয়ে নানা অভিযানে অংশ নিত। ইরাকে মোতায়েন রুশ পাইলটরা সব সময় ইরানের এফ-১৪ বিমানগুলোকে মোকাবেলা করতো এবং এসব সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকটি ইরাকি মিগ-২৫ রুশ পাইলটসহ ইরানিদের হাতে ভূপাতিত হয়েছে।
রাশিয়া সাধারণত তার কয়েকজন সেরা ও অভিজ্ঞ পাইলটকে ইরানে হামলার অভিযানে পাঠাত। যুদ্ধের সময় ইরাকি পাইলটরা খুবই আনাড়িপনা দেখিয়েছিল। তাদের তৎপরতা ছিল পশ্চিমা স্ট্যান্ডার্ডের চেয়ে অনেক বেশি নিম্নমানের। আসলে পুরো যুদ্ধের সময়টাতেই ইরাকিরা আধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ সেনার অভাবে ভুগেছে। এটা ছিল তাদের অন্যতম বড় সমস্যা। তারা কখনোই আধুনিক অস্ত্রগুলোকে সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করতে পারেনি। যেমন, ইরাক সুখো-২৪ বিমানগুলো পাওয়ার পরও চার বছর ধরে এইসব জঙ্গি বিমান ব্যবহার করতে পারেনি। আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহারে ভুল করা বা অদক্ষতার কারণে বহু ইরাকি সেনা প্রাণ হারিয়েছে। তাদের অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে কমান্ডারদের দুর্বলতার কারণে। ঠিক কতো সংখ্যক ইরাকি সেনা এইসব কারণে এবং তাদের কতোজন সরাসরি যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে তার হিসেব দেয়াও বেশ কঠিন কাজ। যুদ্ধ শুরুর পর ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ইরাকের প্রায় ২০০টি জঙ্গি বিমান ধ্বংস হয়। এসবের মধ্যে বেশিরভাগই ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে নয় বরং নানা দূর্ঘটনায় এবং মেরামতের বা সংরক্ষণের সমস্যার কারণে ধ্বংস হয়েছে।
এভাবে বলা যায় সাদ্দাম আসলে বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হয়েই ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। আর এ জন্যই পাশ্চাত্য তাকে বহু ক্ষেপণাস্ত্র ও রাসায়নিক অস্ত্র দিয়েছিল এবং পরমাণু অস্ত্র দেয়ারও উদ্যোগ নেয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পরাশক্তিগুলোর দেয়া এইসব অস্ত্র ইরানের বেসামরিক নাগরিকদের ওপরও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বেসামরিক জনগণের ওপর গণহত্যা চালিয়েও এইসব পরাশক্তি যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি ও নতজানু করতে পারেনি বিপ্লবী ইরানি জাতিকে। ইরানি জাতির বীরত্ব ও আত্মত্যাগ বিশ্বের জনগণের জন্য কিংবদন্তীতুল্য ইতিহাস হয়ে আছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা ইরানি যোদ্ধাদের বীরত্ব ও কৌশল সম্পর্কে ১৯৮৪ সালে এক নিবন্ধে লিখেছিল: সাহসিকতার দিক থেকে ইরানিদের সামরিক কৌশল ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও ইরানি মুজাহিদদের বীরত্বের ঘটনাগুলো বিশ্ববাসীর মনে এখনও প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে। #
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/৮