পরমাণু ইস্যুতে ইরানিরা যেভাবে আমেরিকা ও ইসরাইলকে ধোঁকা দিয়েছে
(last modified Sat, 26 Oct 2024 12:33:50 GMT )
অক্টোবর ২৬, ২০২৪ ১৮:৩৩ Asia/Dhaka
  • পরমাণু ইস্যুতে ইরানিরা যেভাবে আমেরিকা ও ইসরাইলকে ধোঁকা দিয়েছে

পার্সটুডে: ইরান খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে যে আজকের যুদ্ধে প্রচলিত অস্ত্র যদি সঠিকভাবে ডিজাইন করা হয় এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয় তাহলে সেগুলো নিজেদের ইচ্ছা ও সাফল্যের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র হিসেবে কাজে আসতে পারে।

প্রাপ্ত নোট-পার্সটুডে এবং নিউইয়র্ক টাইমসের উদ্ধৃতি অনুসারে,পারস্য উপসাগরীয় একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ইরানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কৌশল সম্পর্কে বলেছেন, "আমরা আমাদের সমস্ত সময় ব্যয় করি ইরানিদের এমন অস্ত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দিতে যা তারা কখনই ব্যবহার করবে না। "তারা করবে না যখন তারা এবং তাদের প্রক্সি যোদ্ধারা প্রতিদিন আমাদের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র ব্যবহার করে সে সম্পর্কে আমরা গাফিল হয়ে থাকি।"

গত দুই দশকে আমেরিকা ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরান যে জটিল ও পরিপক্ষ খেলা খেলেছে তা সমসাময়িক ইতিহাসের অন্যতম বড় ধোঁকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, ধোঁকা দেয়া যুদ্ধ ব্যবস্থাপনার একটি মৌলিক নীতি; বিশেষ করে সান তজুর মত সামরিক কৌশলবিদদের দৃষ্টিকোণ থেকে তাই বলা হয়ে থাকে।

তজু বলেছেন, "যুদ্ধের শিল্প হল ধোকা বা প্রতারণার শিল্প।" ইরানের মতে এই নীতিটি ব্যবহার করে এই বছরগুলোতে তারা তার পারমাণবিক ইস্যুকে বিতর্ক ও বিভ্রান্তির ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে এবং শত্রুদের দৃষ্টিকে সে যে পথে চেয়েছিল তার দিকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আমেরিকা ও ইসরাইলের পররাষ্ট্রনীতিতে উসকানি ও উদ্বেগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে ইরান পশ্চিমা রাজনৈতিক ও মিডিয়া বিতর্ককে বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করেছিল এবং এইভাবে শত্রুকে পারমাণবিক উদ্বেগের ফাঁদে ফেলে তেহরান তাদের চোখ থেকে দূরে আরো গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা জোরদার করেছে।

আপনার শত্রুকে ব্যস্ত রাখুন

সান জু-এর ভাষায়,"শত্রু যখন একটি পয়েন্টে মনোযোগী হয় তখন নিজেকে অন্য জায়গায় প্রস্তুত করুন।" পারমাণবিক ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং একটি বা দুটি ইউরোপীয় দেশের উদ্বিগ্নতা দেখে ইরান এই সুযোগটি ব্যবহার করে এমন এলাকায় তার সামরিক ব্যবস্থা  শক্তিশালী করেছে যা শত্রুকে দ্রুত  টার্গেটে পরিণত না করে বরং বাস্তব এবং কার্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করবে।

বাস্তব যুদ্ধ, কাল্পনিক নয়

ইরান বুঝতে পেরেছিল যে যুদ্ধে জিততে হলে কাল্পনিক নয় বাস্তববাদী হতে হবে। পশ্চিমের একটি অংশ যখন তার পারমাণবিক সমস্যা এবং কাল্পনিক হুমকি নিয়ে ব্যস্ত ছিল, ইরান যুদ্ধক্ষেত্রে বাস্তব প্রয়োজনের ভিত্তিতে তার কৌশলগুলি তৈরি করেছিল। যেমন যুদ্ধের তাত্ত্বিক ক্লজউইটস বলেছেন, "যুদ্ধ হল অন্য উপায়ে রাজনীতির ধারাবাহিকতা।" একইভাবে, ইরানের রাজনীতি বাস্তব যুদ্ধের হাতিয়ারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং কল্পনার দিকে মনোযোগ না দিয়ে। বাস্তবতা যে এটি যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখীন হতে পারে।

প্রচলিত অস্ত্রকে বেছে নেয়া

ইরান খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল যে আজকের যুদ্ধে প্রচলিত অস্ত্র যদি সঠিকভাবে ডিজাইন করা হয় এবং লক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে সংগঠিত হয়,তাহলে ইচ্ছা ও সাফল্যের জন্য সবচেয়ে কার্যকরি হাতিয়ার। এগুলো এমন প্রচলিত অস্ত্র যা যেকোনো পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা যায়।

রকেটের গুরুত্ব বোঝা

অতএব,ইরান সামরিক সমীকরণে তার প্রযুক্তিগত শক্তির ভিত্তিতে ক্ষেপণাস্ত্রকে ট্রাম্প কার্ড হিসাবে ব্যবহার করেছে। কৌশলগতভাবে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো দ্রুত প্রতিপক্ষের জন্য একটি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করতে পারে যখন যুদ্ধবিমানগুলোর মতো অস্ত্র তৈরি করা সহজ ও সস্তা এবং এগুলো যেকোনো স্থানে দ্রুত মোতায়েন করা যায়। সান জু বিশ্বাস করেন যে "গতি যুদ্ধে সাফল্যের চাবিকাঠি"। ক্ষেপণাস্ত্র ইরানকে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে হুমকির একটি নিষ্পত্তিমূলক এবং প্রতিরোধমূলক প্রতিক্রিয়া প্রদান করার সুযোগ দিচ্ছে। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রকৃতপক্ষে জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার এবং প্রতিরোধ বজায় রাখার জন্য একটি কৌশলগত হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

ড্রোন ফাইটার জেট প্রতিস্থাপন

যদিও ইরানিরা ফাইটার জেটকে পাত্তা দেয়নি তবে এখন পর্যন্ত ভালো প্রজেক্টে এগিয়েছে।  কিন্তু তাদের চাহিদা এবং লক্ষ্যকে স্থির করে তারা ড্রোনগুলোতে আরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। এই সরঞ্জামটি কেবল কম ব্যয়বহুল নয় ইরান অত্যন্ত নির্ভুলতার সঙ্গে শত্রুদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হচ্ছে। ইউএভি বা ড্রোন যুদ্ধবিমানগুলোর একটি ভাল বিকল্প হয়ে উঠেছে এবং তাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ক্ষমতার কারণে এসব অস্ত্র কার্যত ইরানকে এই অঞ্চলে এই প্রযুক্তির অন্যতম অগ্রগামীতে পরিণত করেছে। ইরানও আধুনিক যুদ্ধে ড্রোনের গুরুত্ব ভালোভাবে বুঝেছে এবং তাদেরকে সামরিক অভিযানের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করেছে।

যুদ্ধের জন্য সহযোগী নেটওয়ার্ক

এছাড়াও,নিজের পারমাণবিক শক্তি নিয়ে পশ্চিমাদের বিতর্কের সময় ইরান একটি নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। এই অঞ্চলে পশ্চিম এশিয়ার স্থানীয় নিরাপত্তার প্রতি অনুগত সহযোগিতামূলক প্রবাহের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এই নেটওয়ার্কগুলো লেবাননের প্রতিরোধ থেকে শুরু করে ইয়েমেনের প্রতিরোধ, ইরাকের এবং সিরিয়ার প্রতিরোধ, পশ্চিম এশিয়ায় হস্তক্ষেপবাদী বহিরাগত কারণগুলোর উপর চাপ বাড়াতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। এই অংশীদার নেটওয়ার্কের সুবিধা গ্রহণ করে ইরান পশ্চিম এশিয়ার একটি অংশে কার্যকর সম্ভাবনা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই অংশীদাররা আসলে এক ধরনের যুদ্ধ নেটওয়ার্ক এবং যুদ্ধরত পশ্চিমা শত্রুদের সামরিক খরচ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রতিরোধের উচ্চ মূল্য আরোপ করা

এগুলো ছাড়াও ইরানিদের এই বড় প্রতারণামূলক কৌশল ব্যবহার করার একটি কারণ হচ্ছে  ইসরাইল ও আমেরিকার উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। ইরানিরা শত্রুকে বারবার ক্ষেপণাস্ত্র-বিরোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে ইরানি ড্রোন মোকাবেলায় প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে এবং ব্যয় করতে বাধ্য করেছিল। অবশ্য ইরানিরা ভালো করেই জানত যে ইসরাইল ও আমেরিকার প্রতিরক্ষা মডেল তাদের ক্ষেপণাস্ত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মুখোমুখি হতে পারবে না। উল্লেখ্য ইরান তার গুণগত সমীকরণেও পরিমাণ উপাদানের ওপর জোর দিয়েছে। এর অর্থ হ'ল অপ্রত্যাশিত কৌশলে চলমান হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে শত্রুদের সর্বোত্তম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইতিমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে।

অবশেষে, এই দীর্ঘ ক্ষেত্রে ইরানের কৌশল ছিল "প্রতারণা" নীতির উপর ভিত্তি করে নিজের প্রতিরক্ষার ভিত্তি শক্তিশালী করা। পশ্চিমারা যখন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচীর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে,ব্যয়বহুল উদ্বেগ এবং কূটনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছিল,ইরান আধুনিক যুদ্ধের নীতিগুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করে তার প্রচলিত অস্ত্রগুলোকে সজ্জিত ও শক্তিশালী করতে শুরু করেছিল। আসলে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দেখিয়েছে যে যুদ্ধের বাস্তব সমীকরণে,পারমাণবিক হুমকির চেয়ে প্রচলিত অস্ত্রের সক্ষমতা, নেটওয়ার্কিং এবং স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট বেশি কাজ করে।#

পার্সটুডে/এমবিএ/২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ