ইরান বিরোধী 'আরব ন্যাটো জোট' গঠন বাস্তবতা নাকি দিবাস্বপ্ন?
(last modified Fri, 07 Dec 2018 12:22:37 GMT )
ডিসেম্বর ০৭, ২০১৮ ১৮:২২ Asia/Dhaka
  • ইরান বিরোধী 'আরব ন্যাটো জোট' গঠন বাস্তবতা নাকি দিবাস্বপ্ন?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর মে মাসে সৌদি আরব সফরে গিয়ে 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ সফরে গিয়ে তিনি সৌদি আরবের কাছে বিপুল অংকের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আরব দেশগুলোকে নিয়ে 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। তবে এ জোটের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও এর কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রিয়াদ সফরে গিয়ে কথিত সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব ঠেকানোর জন্য এ অঞ্চলের আরব দেশগুলোকে নিয়ে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন। ধারণা করা হচ্ছে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ভূমিকা পালন করবে সৌদি আরব। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত বছর (২০১৭ সালে) জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন ফোরামে এ ধরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলে আসছিলেন। অন্যদিকে, সৌদি কর্মকর্তারাও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে আমেরিকা ও সৌদি আরবের মধ্যে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিস্তারের প্রস্তাব দিয়েছেন। সহযোগিতার অংশ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উপদেষ্টারা দায়েশসহ বিভিন্ন উগ্রপন্থীদের মোকাবেলা করার জন্য সৌদিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় আমেরিকাকে সহযোগী করারও প্রস্তাব দেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে 'আরব ন্যাটো' জোট গঠন করাসহ মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে মার্কিন নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব দিয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্য বর্তমানে 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। তিনি ন্যাটোর আদলে এ অঞ্চলের আরব দেশগুলোকে নিয়ে বিশেষ নিরাপত্তা সংস্থা গঠনের চেষ্টা করছেন। মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরণের কোনো সামরিক জোট গঠন করা সম্ভব হলে তা আমেরিকার নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব মোকাবেলা করা এবং ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ইরান সমর্থকদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলা। জর্দান ও মিশরসহ আরো ছয়টি আরব দেশকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা এ ধরণের সামরিক জোট গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে হোয়াইট হাউজ কথিত 'আরব ন্যাটো' জোটের সদস্য দেশগুলোকে ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশল এবং অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার পদক্ষেপ নিয়েছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত হবে এই জোটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শরীক দেশ অর্থাৎ তারাই নেতৃত্ব দেবে এবং আমেরিকার সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে তারা সবাই ইরানকে মোকাবেলা করবে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও

প্রকৃতপক্ষে, আমেরিকা ও তার মিত্ররা মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার কথা বলে নানা সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এ অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। আরব সংবাদ বিশ্লেষক আব্দুল বারি আতাওয়ান বলেছেন, "কথিত আরব সামরিক জোট গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ভৌগোলিক বিরোধ সৃষ্টির পাশাপাশি ধর্মীয় ও গোত্রীয় গোলযোগ বাধানো।"

যাইহোক, 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের লক্ষ্যে সম্প্রতি আমেরিকা এবং আটটি আরব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের উপস্থিতিতে পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা পিজিসিসি'র বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের বিষয়ে আটটি আরব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বাহরাইন, মিশর, জর্দান, সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অংশ নেন। বৈঠকের পর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "উপস্থিত প্রতিনিধিরা তাদের ভাষায় আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিরুদ্ধে ইরানের হুমকি মোকাবেলার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। বিশেষ করে 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের বিষয়ে তারা শলাপরামর্শ করেছেন।" বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, "ওই বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও দায়েশসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে পরাজিত করা এবং সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের তৎপরতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।" মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এও দাবি করা হয়েছে, "বৈঠকে উপস্থিত সবাই আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হুমকি ইরানকে মোকাবেলায় একমত হয়েছেন। এ ছাড়া, 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের বিষয়েও তাদের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।

আমেরিকা ও তার মিত্ররা গত কয়েক মাস ধরে ন্যাটোর আদলে আরব দেশগুলোকে নিয়ে বিশেষ নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনী গঠনের বিষয়ে নানান কথাবার্তা বলে আসছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে এ দেশগুলোর মধ্যে মতবিরোধের কারণে এ ধরণের সামরিক জোট গঠন করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিম লিন্ডারকিং বলেছেন, হোয়াইট হাউজ আগামী ডিসেম্বরের আগেই 'মিডিলইস্ট স্ট্র্যাটেজিক ইউনিয়ন' গঠনের চেষ্টা করছে যা কিনা 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের ক্ষেত্র তৈরি করবে। লিন্ডার কিং কিছু দিন আগে আগামী বছরের জানুয়ারিতে এ ধরণের জোট গঠনের বিষয়ে আলোচনার জন্য আরব দেশগুলো সফর করেন। ওয়াশিংটনে এ সংক্রান্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। লিন্ডার কিং বলেছেন, "পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে হুমকি ঠেকানো 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য। বিশেষ করে ইরান ও সাইবার হুমকির মোকাবেলা করা এবং সিরিয়া ও ইয়েমেনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে এ জোটের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।"

'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের আরব মিত্রদের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পরপরই সারা বিশ্বে বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ছিল তার সবচেয়ে বড় টার্গেট। এ কারণে তিনি ক্ষমতায় আসার পরপরই প্রথমেই মধ্যপ্রাচ্য সফরে আসেন এবং সৌদি আরবের সঙ্গে ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি করেন।

কোন কোনো সূত্র জানিয়েছে, আরব দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা যে 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের চেষ্টা করছে তা বাস্তবায়নের পথে অনেক বাধাও রয়েছে। কারণ যাদেরকে নিয়ে এ জোট গঠন করা হবে তাদের অর্থাৎ আরব দেশগুলোর মধ্যে নানা ইস্যুতে ব্যাপক মতপার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়া, জোটের অন্যতম শক্তি হচ্ছে মিশর। কিন্তু আরব বিশ্বে বর্তমানে মিশরের অবস্থান খুবই দুর্বল। কাতার ও সৌদি আরবের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব চলছে। এ অবস্থায় কি করে তারা 'আরব ন্যাটো' জোট গঠন করবে বা গঠন করলেও কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থ রয়েছে সে কারণে তারা যেকোনো উপায়ে এই জোট গঠনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা পিজিসিসি ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যকার বিরোধ এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইরানকে মোকাবেলার জন্য 'আরব ন্যাটো' জোট গঠনের স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হবে না। আর যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলেও অন্যান্য জোটের মতো এটিও লোক দেখানো একটি সামরিক জোট হিসেবেই টিকে থাকবে এবং এ থেকে আমেরিকা, সৌদি আরব ও ইসরাইল কোনো সুফল পাবে না। #

 পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন  

ট্যাগ