সোলায়মানি বিশ্বের জনপ্রিয়তম জেনারেল
(last modified Tue, 07 Jan 2020 09:03:42 GMT )
জানুয়ারি ০৭, ২০২০ ১৫:০৩ Asia/Dhaka

আপনারা নিশ্চয় জানেন, গত ৩ জানুয়ারি ইরাকে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে দখলদার মার্কিন সেনারা।

ওই হামলায় শাহাদাতবরণ করেছেন ইরাক ও সিরিয়ায় উগ্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পুরোধা ব্যক্তিত্ব লেঃ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। মার্কিন সেনারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দাবি করে ইরাকে অবস্থান করলেও তারা এমন একজন কমান্ডারকে হত্যা করেছে যিনি সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

সন্ত্রাসী মার্কিন বাহিনীর হামলায় ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার লেঃ জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদাতবরণ সম্পর্কিত বিশেষ আলোচনা।

শুক্রবার ৩ জানুয়ারি সকালে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর নিয়মিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে একটি অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত খবর প্রচারিত হয়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কুদস ফোর্সের কমান্ডার লেঃ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি সন্ত্রাসী মার্কিন সেনাদের বিমান হামলায় শহীদ হয়েছে। খবরটি সব মহলে এতটা বিস্ময় সৃষ্টি করে যে, অনেকের পক্ষে এই সংবাদ বিশ্বাস করাই কঠিন হয়ে যায়। তবে সবার কাছে অবিশ্বাস্য হলেও জেনারেল সোলাইমানির শাহাদাতের খবরে একদিকে ইসলামের শত্রুরা আনন্দিত হয় অন্যদিকে মুসলিম উম্মাহর অন্তরে হয় রক্তক্ষরণ। তবে যে বিষয়টি এখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, ইসলামে শাহাদাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য সুউচ্চ মর্যাদা রয়েছে এবং জেনারেল সোলাইমানি জীবদ্দশায় অসংখ্যবার শাহাদাতপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছেন।

পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী যারা শহীদ হন তারা মারা যান না বরং তারা আল্লাহর কাছে থেকে জীবিকা পেয়ে থাকেন। হযরত আলী (আ.) এ সম্পর্কে বলেছেন, নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সম্মানজক মৃত্যু হচ্ছে ইসলামের শত্রুর হাতে নিহত হওয়া। আবুতালেবের এই পুত্রের জীবন যার হাতে সেই সত্ত্বার শপথ করে বলছি, আমার জন্য নিরাপদ বিছানায় কাফির হিসেবে মৃত্যুবরণ করার চেয়ে এক হাজার তরবারির আঘাত সহ্য করা অনেক বেশি সহজ। জেনারেল সোলাইমানির শাহাদাতের খবর পাওয়ার পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী তাঁর শোকবার্তায় বলেন, ইসলামের একজন মহান জেনারেল ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেছেন। শহীদদের আত্মা কাসেম সোলাইমানির আত্মাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সারাজীবন সংগ্রামকারী এই বীর যোদ্ধা তার বহু আকাঙ্ক্ষিত শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেছেন ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমনের হামলায়।

জেনারেল সোলাইমানি ১৯৫৬ সালে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরমান প্রদেশের একটি পাহাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে ইরাকি বাহিনী ইরানে আগ্রাসন চালালে দেশরক্ষায় রণাঙ্গনে চলে যান এবং সেখানে অল্পদিনের মধ্যে নিজের সামরিক প্রতিভার প্রমাণ তুলে ধরেন। তার উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ৪১ সারুল্লাহ ব্রিগেড গঠন করেন। আট বছরের চাপিয়ে দেয়া ওই যুদ্ধে জেনারেল সোলাইমানি ওয়ালফাজ্‌র-৮, কারাবালা-৪ ও কারবালা-৫’সহ বহু সম্মুখযুদ্ধে ইরানি সেনাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

শহীদ কাসেম সোলাইমানি ১৯৮১ সালে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সুসাংগার এলাকায় এক অভিযান চালাতে গিয়ে ডান হাত ও পেটে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হন। কিন্তু এই আঘাত তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। পরবর্তী সাত বছর তিনি বীরবীক্রমে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধ শেষ হলে জেনারেল সোলায়মানি ইরানের পূর্ব সীমান্তে মাদক চোরাচালান ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন।  ১৯৯৭ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী তাকে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কমান্ডার নিযুক্ত করেন। ২০১০ সালে কাসেম সোলাইমানিকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করার সময় সর্বোচ্চ নেতা তাকে ‘জীবন্ত শহীদ’ বলে অভিহিত করেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় কমান্ডারে পরিণত হন জেনারেল সোলাইমানি। সিরিয়ায় দায়েশের হাতে ইরানি যোদ্ধা শহীদ হোজাজি’র শাহাদাতের পর ইরানের এই কমান্ডার অবিলম্বে দায়েশকে নির্মূল করা হবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে সিরিয়া থেকে জঙ্গি গোষ্ঠী দায়েশের মূলোৎপাটন হয়ে যায়। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী তাকে ইরানের সর্বোচ্চ সামরিক পদক ‘জুলফিকারে’ ভূষিত করেন। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর জেনারেল সোলাইমানি ছিলেন একমাত্র কমান্ডার যিনি এই পদক পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

একটি ইসলামি সমাজের শহীদগণ ওই সমাজের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়তা করেন এবং সমাজের দুর্বলতাগুলোকে দূর করে দেন। যে সমাজে এরকম ব্যক্তির উপস্থিতি থাকে সে সমাজের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়। প্রকৃতপক্ষে শাহাদাত একটি ক্ষয়িষ্ণু সমাজের শিরায় নতুন রক্ত সঞ্চালন করে। বিশ্বনবী (সা.) শহীদদের মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন: শহীদের দেহ থেকে এক ফোটা রক্ত মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সকল গোনাহ মাফ হয়ে যায়। শহীদের মস্তক দু’জন ফেরেশতার মাঝখানে রাখা হয় এবং ফেরেশতারা তার মুখমন্ডলের ধুলাবালি পরিস্কার করে দেয় এবং শহীদকে স্বাগত জানায়। শহীদের দেহে বেহেশতি পোশাক পরানো হয়। বেহেশতে স্বাগত জানানোর দায়িত্বপ্রাপ্তরা শহীদের শরীরে সুগন্ধি মাখানোর কাজে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। শহীদ তাঁর দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই বেহেশেতে নিজের স্থান দেখতে পান। বেহেশতে তাঁর রুহকে বলা হয়, তোমার যেখানে খুশি সেখানে থাকতে পারো।

মহান আল্লাহ সূরা আহযাবের ২৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন: “মুমিনদের মধ্যে কিছু পুরুষ আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ শাহাদাৎবরণ করেছে এবং কেউ কেউ (শাহাদাতের) প্রতীক্ষা করছে। তারা কোনো অবস্থাতেই তাদের সংকল্প পরিবর্তন করেনি।”

আল্লাহ-প্রেমিক প্রতিটি মানুষের অন্তরে জেনারেল সোলাইমানি স্থান করে নিয়েছিলেন। নির্যাতিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ইসলামের এই বিনয়ীতম ও জনপ্রিয়তম কমান্ডার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন এবং আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছেন। তিনি চলে গেছেন কিন্তু ইসলাম পৃথিবীর বুকে রয়ে গেছে সুমহান ঐশী শিক্ষা নিয়ে; মানবতাকে শান্তি ও ন্যায়বিচারের বাণী শোনাতে। তার রক্তের বিনিময়ে ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন আরো বেগবান হবে; প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের লড়াইয়ে আরো বেশি অটল ও অবিচল হবে।

পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সব সময় শত্রুর দুর্বলতা প্রকাশ করে দেয়। যারা সম্মুখযুদ্ধে ভয় পায় তারাই গোপনে এবং ঘোষণা না দিয়ে অপ্রস্তুত অবস্থায় শত্রুর ওপর আক্রমণ চালায়। তবে শত্রুকে একথা জেনে রাখতে হবে যে, তারা জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করার মতো জঘন্য অপরাধের মাধ্যমে ইরাকের সার্বভৌমত্ব লঙঙ্ঘন করেছে, আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি পদদলিত করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করতে চেয়েছে। এই জঘন্য অপরাধের নির্বোধ হোতারা যেন মনে রাখে যে, জেনারেল সোলাইমানির মতো একজন কমান্ডার যখন শাহাদাতবরণ করেন তখন আরো লক্ষ-কোটি সোলাইমানির জন্ম হয় এবং তারা বাতিল শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। আমরা ইসলামের এই মহান ব্যক্তিত্বের শাহাদাতে প্রত্যেককে জানাই শোক, সমবেদনা ও মোবারকবাদ। #

পার্সটুডে/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ