১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা কি স্বেচ্ছায় তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করেছিল?
https://parstoday.ir/bn/news/west_asia-i150604-১৯৪৮_সালে_ফিলিস্তিনিরা_কি_স্বেচ্ছায়_তাদের_মাতৃভূমি_ত্যাগ_করেছিল
পার্সটুডে: ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা স্বেচ্ছায় তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করেছিল এই মিথটি ইহুদিবাদী ইসরায়েল এবং তার সমর্থকরা ফিলিস্তিনি ভূমিতে এই রাষ্ট্র গঠনের ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য যে বানোয়াট আখ্যান ব্যবহার করে আসছে তার মধ্যে একটি।
(last modified 2025-07-29T12:16:04+00:00 )
জুলাই ২৩, ২০২৫ ১৬:১৭ Asia/Dhaka
  •  “ডেভিড বেন-গুরিয়ন” একজন ইহুদিবাদী নেতা যিনি পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন
     “ডেভিড বেন-গুরিয়ন” একজন ইহুদিবাদী নেতা যিনি পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন

পার্সটুডে: ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিরা স্বেচ্ছায় তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করেছিল এই মিথটি ইহুদিবাদী ইসরায়েল এবং তার সমর্থকরা ফিলিস্তিনি ভূমিতে এই রাষ্ট্র গঠনের ন্যায্যতা প্রমাণ করার জন্য যে বানোয়াট আখ্যান ব্যবহার করে আসছে তার মধ্যে একটি।

তবে, ঐতিহাসিক বাস্তবতা স্পষ্টভাবে দেখায় যে এই প্রস্থান স্বেচ্ছায় ছিল না বরং এটা ছিল পরিকল্পিত সহিংসতা, জাতিগত নির্মূল অভিযান এবং ইহুদিবাদী প্রকল্পের অন্তর্নিহিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার অপযুক্তির ফল।

ইসরায়েলি দাবির বিপরীতে, ফিলিস্তিনিরা দেশপ্রেমিক উপনিবেশবাদ নামে একটি বিশেষ ধরণের উপনিবেশবাদের শিকার হয়েছিল। এ ধরণের উপনিবেশবাদ, যার মধ্যে ইসরায়েল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উদাহরণ রয়েছে,ঐতিহ্যবাহী উপনিবেশবাদ থেকে আলাদা। ঐতিহ্যবাহী উপনিবেশবাদে, উপনিবেশকারী প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সস্তা শ্রম খোঁজে, কিন্তু বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশবাদের লক্ষ্য হল জমি অধিগ্রহণ করা এবং জনসংখ্যা প্রতিস্থাপন করা।

ইহুদিবাদী আন্দোলন উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শুরু হয়েছিল এবং ইউরোপীয় ইহুদিদের ফিলিস্তিনে অভিবাসনের মাধ্যমে তীব্রতর হয়েছিল। এই অভিবাসনগুলো শুরু থেকেই এমন সচেতনতার সাথে পরিচালিত হয়েছিল যে তারা জানতো ফিলিস্তিন কোনও খালি ভূমি নয়। ইহুদিবাদী নেতারা নিজেরাই স্বীকার করেছিলেন যে তারা স্থানীয়দের দ্বারা অধ্যুষিত একটি ভূমির মুখোমুখি হচ্ছে। ফিলিস্তিনে প্রেরিত একটি প্রতিনিধিদলের বিখ্যাত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: "কনে একজন সুন্দরী মহিলা, কিন্তু তিনি অন্য একজন পুরুষকে বিয়ে করেছেন।" এই বিবৃতিটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে ইহুদিবাদীরা জানতো ফিলিস্তিনে একটি স্থানীয় আরব জনসংখ্যা রয়েছে। যাই হোক, ইহুদিবাদী মতাদর্শ এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল যে এই আদিবাসীদের জমির উপর কোনও অধিকার নেই এবং এটি একটি বাধা যা অপসারণ করা উচিত।  

ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা প্রথম প্রথম ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে এক ধরণের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার পেয়েছিল এবং স্বাগত জানানো হয়েছিল তাদেরকে। অনেক ফিলিস্তিনি তাদের আশ্রয় দিয়েছিল, তাদের সাহায্য করেছিল এবং এমনকি তাদের কৃষিকাজও শিখিয়েছিল। কিন্তু শীঘ্রই এটি স্পষ্ট হয়ে গেল যে এই অভিবাসীরা আদিবাসীদের সাথে বসবাস করতে চায় নি বরং তারা সেখানে শেকড় গাড়তে চেয়েছিল। এই বোঝাপড়াই ছিল ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের সূচনার ভিত্তি। এরপর থেকে, ইহুদিবাদীরা পরিকল্পেতভাবে অ-স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে জমি কেনা, শ্রমবাজারে বর্ণবাদী নীতি বাস্তবায়ন এবং এমনকি বলপ্রয়োগ ও সহিংসতার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ধীরে ধীরে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করার দিকে এগিয়ে যায়।

ডেভিড বেন-গুরিওনের মতো ইহুদিবাদী নেতারা, যিনি পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, ফিলিস্তিনিদের ইহুদি জাতীয় প্রকল্পের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেছিলেন এবং তাদের বক্তৃতায় তাদের "রোগ" হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন যা ইহুদি শ্রম দিয়ে প্রতিস্থাপন করা উচিত। তারা ফিলিস্তিনিদের বহিষ্কার এবং একটি সম্পূর্ণ ইহুদিবাদী সমাজ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। বেন-গুরিওন এবং তার সহযোগীরা ১৯৪৮ সালের আগে বহু বছর ধরে তাদের চিঠি এবং বক্তৃতায় আরবদের বহিষ্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে আসছিলেন।

বিশেষ করে ১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক নেতারা, বৃহৎ আকারের ইহুদি অভিবাসন রোধ করতে এবং ভবিষ্যতের রাষ্ট্রকে এমনভাবে গঠন করার জন্য ব্রিটেনের সাথে আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন যা শান্তিপূর্ণ ও বন্টনযোগ্য হবে। এমনকি তারা পূর্ববর্তী ইহুদি অভিবাসীদের গ্রহণ করতেও ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু আরও অভিবাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। তবে, ইহুদিবাদী আন্দোলন এরকম কোনও সাধারণ সমাধান প্রত্যাখ্যান করেছিল, কারণ তাদের লক্ষ্য ছিল একটি সম্পূর্ণ ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এর ফলে ১৯২৯ এবং ১৯৩৬ সালে ব্যাপক দাঙ্গা শুরু হয়, যার মূলে ছিল ব্রিটিশ আচরণের প্রতি ফিলিস্তিনিদের হতাশা এবং দখল ও দখলদারিত্বের প্রক্রিয়ার প্রতি ক্রোধ।

১৯৪৭ সালে ব্রিটেন যখন ফিলিস্তিনের প্রশ্নটি জাতিসংঘে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ফিলিস্তিনিরা একটি একক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করে যেখানে ইহুদি অভিবাসীরা বসবাস করবে, কিন্তু আর কোনও অভিবাসন বা বসতি স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হবে না। যাই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের মুখে, জাতিসংঘ একটি বিভক্তি পরিকল্পনা অনুমোদন করে যা ফিলিস্তিনি ভূমির অর্ধেকেরও বেশি ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়, যদিও তারা জনসংখ্যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ছিল। এই সিদ্ধান্তের ফলে যুদ্ধ শুরু হয়, যার সময় সাড়ে ৭ লাখেরও  বেশি ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে বহিষ্কার করা হয় অথবা পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। তাদের অনেককে কখনও ফিরে আসতে দেওয়া হয় নি এবং কয়েক ডজন ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহর সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছিল।

ইসরায়েল এবং তার সমর্থকদের দ্বারা সৃষ্ট মিথ, যেমন "খালি ভূমি" বা "স্বেচ্ছায় প্রত্যাহার", এই প্রকল্পকে বৈধতা দেওয়ার হাতিয়ার ছিল। পশ্চিমা মিডিয়া এবং ইউরো-সার্কিন রাজনৈতিক সাহিত্যে এই মিথগুলোকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে, ইলান পপে, বেনি মরিস এবং অন্যান্য আধুনিক ইসরায়েলি ঐতিহাসিকদের মতো স্বাধীন গবেষকরা আর্কাইভাল নথি ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে ইহুদিবাদী প্রকল্প শুরু থেকেই নির্মূল, শুদ্ধিকরণ এবং উপনিবেশ স্থাপনের যুক্তির ওপর ভিত্তি করে ছিল।

অতএব, ইসরায়েল সৃষ্টিকে উপনিবেশবাদের ইতিহাস থেকে আলাদা করা যায় না। এই রাষ্ট্রটি কেবল ধর্মীয় প্রতিশ্রুতি বা বাস্তবতা থেকে দূরে ঐতিহাসিক আখ্যানের মতো মিথের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না, বরং আদিবাসী ফিলিস্তিনিদের অধিকার অস্বীকার করে এবং তাদের বৈধ প্রতিরোধকে উপেক্ষা করে আজও বর্জন এবং দখলদারিত্বের নীতি অনুসরণ করে চলেছে। ইহুদিবাদী মিথের বিপরীতে, ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের ভূমি থেকে স্বেচ্ছায় বিতাড়িত করা হয় নি, বরং বলপ্রয়োগ করে, সহিংসতা চালিয়ে, নির্বাসনের মাধ্যমে অত্যাচার জুলুম নিপীড়ন চালিয়ে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। ফিলিস্তিনি জাতীয় আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল এমন এক অপরিহার্য পরিস্থিতি থেকে যে পরিস্থিতিতে সেখানকার জনগণ তাদের নিজস্ব ভূমি রক্ষা করা,আত্মপরিচয় ও মর্যাদা রক্ষা করার স্বাভাবিক ইচ্ছা থেকে। ফিলিস্তিনীরা শুরু থেকেই ইহুদিবাদী উপনিবেশবাদকে সঠিকভাবে চিনতে পেরেছিল এবং তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল।#

পার্সটুডে/এনএম/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।