একটি নিরব জোট
ইসরায়েল ও ক'টি আরব সরকারের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার গোপন কাহিনী
-
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের অবকাশে নিউইয়র্কে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাত
পার্স টুডে - হোয়াইট হাউজের ফাঁস হওয়া কিছু নথির ওপর ভিত্তি করে একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যম গত তিন বছরে সেন্টকমের সহযোগিতায় ইহুদিবাদী ইসরায়েল ও এ অঞ্চলের আরব দেশগুলোর মধ্যে একটি নিরাপত্তা-সামরিক কাঠামো গঠন এবং সম্প্রসারণের বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে।
আমেরিকান নথিপত্র থেকে জানা গেছে গাজা যুদ্ধসহ পশ্চিম এশিয়ার নানা সংঘাতের সময়, ইসরায়েল এবং এই অঞ্চলের কয়েকটি আরব দেশের কর্মকর্তারা মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) সহায়তায় আঞ্চলিক হুমকি, ইরান এবং গাজায় ভূগর্ভস্থ টানেল বা সুড়ঙ্গ মোকাবেলার উপায় নিয়ে বিভিন্ন সভা ও প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করেছিল।
শনিবার এক রিপোর্টে ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, মার্কিন সরকারের প্রকাশিত নানা নথি ও তথ্য-প্রমাণ থেকে দেখা গেছে, ওই আরব সরকারগুলো গাজা যুদ্ধের নিন্দা করা সত্ত্বেও নীরবে ইসরায়েলের সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়িয়েছে। সেপ্টেম্বরে কাতারে ইসরায়েলি হামলার পর এই সামরিক সম্পর্ক সংকটের সম্মুখীন হয়, কিন্তু এখন গাজায় যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে এই আরব সরকারগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।"
ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, গত তিন বছরে, ইসরায়েল ও ছয়টি আরব সরকারের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় বাহরাইন, মিশর, জর্ডান এবং কাতারে ধারাবাহিকভাবে নানা বৈঠক করেছেন। এইসব বৈঠকে ট্রাম্পের গাজা সম্পর্কিত পরিকল্পনার প্রতি সমর্থনের সবুজ সংকেত দেন তারা। গাজায় এখন (গত শুক্রবার থেকে) যুদ্ধ বিরতি চলছে। ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো গত নয় সেপ্টেম্বরে কাতারে আঘাত হানা সত্ত্বেও দোহার সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে গোপনে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করছে।
ঐসব নথিতে দেখা গেছে আরব ও ইসরায়েলি সিনিয়র কর্মকর্তারা ২০২৪ সালের মে মাসে কাতারের আল উদাইদ ঘাঁটিতে বৈঠক করেছিলেন। ওই বৈঠকের দুই দিন আগেই এ সম্পর্কে তৈরি করা নথি থেকে জানা যায় যে ইসরায়েলি প্রতিনিধিদল সরাসরি বিমানযোগে ওই ঘাঁটিতে আসেন এবং বেসামরিক প্রবেশপথগুলো তারা এড়িয়ে গেছেন যাতে তাদের উপস্থিতির কথা কেউ টের না পায়। ফাঁস হওয়া ৫টি নথির ভিত্তিতে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে মার্কিন সেন্টকমের সহযোগিতায় ইহুদিবাদী ইসরায়েল ও এ অঞ্চলের আরব দেশগুলোর মধ্যে একটি নিরাপত্তা-সামরিক কাঠামো গঠনের যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তাতে ইসরায়েল ছাড়াও রয়েছে কাতার, বাহরাইন, মিশর, জর্ডান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই নথিগুলোতে কুয়েত এবং ওমানকেও "সম্ভাব্য অংশীদার" হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যাদের সমস্ত বৈঠক সম্পর্কে অবহিত রাখা হয়েছিল।
আমেরিকান সংবাদমাধ্যমটি এই বৈঠকগুলো সম্পর্কে আরও বিশদ বিবরণ প্রদান করে লিখেছে: "২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ন্যাশভিলের কাছে মার্কিন ফোর্ট ক্যাম্পবেল ঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকগুলির মধ্যে একটিতে এমন একটি অধিবেশন অন্তর্ভুক্ত ছিল যেখানে আমেরিকান সামরিক কর্মীরা তাদের আরব ও ইসরায়েলি অংশীদারদের প্রতি ভূগর্ভস্থ টানেল বা সুড়ঙ্গ দ্বারা সৃষ্ট হুমকিগুলি সনাক্ত এবং সেসব বানচাল করতে শেখান, যা গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হামাসের প্রধান হাতিয়ারগুলোর অন্যতম।
আরেকটি নথিতেও দেখা গেছে যে, এই ছয়টি দেশের কথিত অংশীদাররা ভূগর্ভস্থ টানেল ধ্বংসের ওপর একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিল, যদিও এই দেশগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়নি। সেন্টকমের কর্মীরা ইরান যে ফিলিস্তিনিদের আঞ্চলিক রক্ষক-এই বক্তব্য বা ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা অভিযান পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা অধিবেশনও পরিচালনা করেছিলেন। ২০২৫ সালের একটি নথি অনুসারে, অধিবেশনগুলোতে "আঞ্চলিক সমৃদ্ধি এবং সহযোগিতার একটি সম্মিলিত আখ্যান প্রচার" নিয়েও আলোচনা করা হয়েছিল।
রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা বিবেচনা করে নথিগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে অংশীদারিত্ব "নতুন জোট গঠন করবে না" এবং সমস্ত সভা "গোপনীয়তার সাথে অনুষ্ঠিত হবে।"
উপরোক্ত কাঠামোর আওতায় আরব ইসরাইলি সামরিক সহযোগিতা প্রসঙ্গে ওয়াশিংটন পোস্ট আরো লিখেছে, প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণগুলো থেকে দেখা যায় কিভাবে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনগুলো মোকাবেলার জন্য গঠিত বিশেষ কাঠামোর আওতায় একটি অভিন্ন প্রতিরক্ষা কর্মসূচি গড়ে তোলা হয়েছিল। গত তিন বছরে এই কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০২২ সালেই এক নিরাপত্তা সম্মেলনে এই কর্মসূচি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল যেখানে এই লক্ষ্য পূরণে অভিন্ন ও সমন্বিত সামরিক মহড়া চালানোর এবং এজন্য প্রয়োজনীয় সব সাজ সরঞ্জাম অর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
সেন্ট কম ২০২৪ সালে এই পরিকল্পনার শরিকদেরকে নিজস্ব নেটওয়ার্ক-এ সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়। ফলে শরিক দেশগুলো তাদের রাডার ও সেন্সরগুলোর তথ্য মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীকে সরবরাহ করে, আর এর বিনিময়ে তাদেরকে সম্মিলিত ডাটা ব্যাংকের তথ্য দেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রতিরক্ষা সিস্টেম গত নয় সেপ্টেম্বর কাতারে ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় কোন প্রতিরক্ষার পদক্ষেপ নেয়নি।
মোট সাতটি দেশ নিয়ে গঠিত এই সামরিক কাঠামো ভিত্তিক জোট নিজেদের মধ্যে রাডার ও অভিন্ন নেটওয়ার্ক সিস্টেমের তথ্য ও ছবি আদান-প্রদান করে এসেছে।
আর ইসলামী ইরান ও প্রতিরোধ অক্ষ-বিরোধী এবং গোপনে ইসরাইলের সহযোগী এই বিশেষ জোটের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সামরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সৌদি আরব। ওয়াশিংটন পোস্ট এ সম্পর্কে লিখেছে এই সহযোগিতার কাঠামোর আওতায় সৌদি আরব ইসরাইলি ও আরব সহযোগী দেশগুলোকে বিপুল মাত্রায় নানা ধরনের সামরিক তথ্য দিয়ে সমন্বয়ের কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
পার্স টুডে/এমএএইচ/১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।