সৌদি ডেপুটি যুবরাজ সালমানের উচ্চাভিলাস ও এর সম্ভাব্য পরিণতি
(last modified Sat, 01 Oct 2016 13:04:03 GMT )
অক্টোবর ০১, ২০১৬ ১৯:০৪ Asia/Dhaka
  • সৌদি ডেপুটি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান
    সৌদি ডেপুটি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান

২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে সৌদি রাজা আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর দেশটির নতুন রাজা হন সালমান বিন আবদুল আজিজ। এভাবে সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ সৌদের ৪৩ পুত্রের মধ্য থেকে আরও একজন দেশটির সিংহাসনে আসীন হন।

নতুন রাজা এ পর্যন্ত সৌদি সরকারের ক্ষমতার কাঠামোয় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছেন। আর এসব পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে নিজের যুবক পুত্র  মুহাম্মাদ বিন সালমানকে ডেপুটি যুবরাজ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদে নিয়োগ দান। বর্তমান সৌদি রাজার আরও অনেক প্রবীণ ভাই ও ভাতিজারা বেঁচে থাকতেই ঘটেছে অভাবিত এই ঘটনা। এইসব বৃদ্ধ প্রিন্স ও প্রিন্সের পুত্ররা দেশটির গুরুত্বপূর্ণ নানা পদে আসীন রয়েছেন।

মুহাম্মাদ বিন সালমানের বয়স এখন প্রায় ৩১। এতো কম বয়সে সৌদি আরবের মতো একটি দেশে এর আগে কেউই প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ডেপুটি যুবরাজ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেননি। তাই মনে করা হচ্ছে এই সৌভাগ্যবান যুবকের রাজা হওয়ার 'দিল্লি' হয়তো খুব বেশি দূরে নয়। অবশ্য সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা বিনা চ্যালেঞ্জে বিষয়টা মেনে নেবেন-এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। কারণ, সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ সৌদের ওসিয়ত অনুযায়ী তার পুত্ররা জীবিত থাকা পর্যন্ত সিংহাসন  তার এক পুত্রের কাছ থেকে তারই আরেক পুত্রের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর এ পর্যন্ত তার ছয় পুত্র সৌদি রাজসিংহাসনে বসেছেন। আবদুল আজিজ সৌদের কয়েকজন পুত্র এখনও বেঁচে আছেন। এ ছাড়াও আবদুল আজিজের নাতিদের মধ্যেও এমন অনেকেই রয়েছেন যারা বয়স, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে মুহাম্মাদ বিন সালমানের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছেন।

সালমান বিন আবদুল আজিজ সৌদি রাজা হওয়ার পর থেকে গত প্রায় বিশ মাসে তার পুত্র মুহাম্মাদ বিন সালমানের অভিভাবকসুলভ তৎপরতাও লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে।
তিনি যে কেবল প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও ডেপুটি যুবরাজ তা-ই নন। একইসঙ্গে দেশটির কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক কমিটির প্রধান ও ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পরিচালক।  
এ ছাড়াও  মূলত মুহাম্মাদ বিন সালমানের উদ্যোগেই ও তার সিদ্ধান্তেই সৌদি আরব প্রতিবেশি ইয়েমেনের সঙ্গে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। ২০১৬ তথা চলতি বছরেও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সফর সম্পন্ন করেছেন মুহাম্মাদ বিন সালমান। সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ রাজা হওয়ার জন্য তিনি পশ্চিমা মিত্রদের বিশেষ করে মার্কিন সরকারের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। 

 সৌদি ডেপুটি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান গত প্রায় তিন মাসে পাকিস্তান, জাপান ও চীনের প্রধানমন্ত্রী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এইসব দেশ সফর করেছেন। তিনি চীনে গিয়েছিলেন জি-টুয়েন্টি অর্থনৈতিক জোটের সম্মেলনে যোগ দেয়ার অজুহাতে। আমেরিকা সফরে গিয়ে সালমান ওবামা ও জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। এভাবে কূটনৈতিক পর্যায়ে নিজেকে সৌদি সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন মুহাম্মাদ বিন সালমান।  জি-টুয়েন্টি সম্মেলনে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সঙ্গে। এ সফরে তিনি চীনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে বেশ কয়েকটি বড় বড় চুক্তিও স্বাক্ষর করেছেন।
এসব সফরের বাইরে কাতারেও সফর করেছেন মুহাম্মাদ বিন সালমান। সেখানে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন কাতারের বর্তমান আমির শেখ তামিমের সঙ্গে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেকে নিকট-ভবিষ্যতেই সৌদি রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তুতি নেয়ার জন্যই এসব সফর সম্পন্ন করেছেন সৌদি ডেপুটি যুবরাজ। মুহাম্মাদ বিন সালমানের জাঁক-জমকপূর্ণ এসব সফর গণমাধ্যম ও বিশ্লেষক মহলের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। সৌদি রাজ-পরিবারের ভেতরের খবর ফাঁসে সুদক্ষ সৌদি সমাজ-কর্মী মুজতাহিদ জানিয়েছেন, ডেপুটি যুবরাজ সালাম সৌদি সরকারের প্রতিপালিত দরবারি আলেমদের বর্তমান কেন্দ্রীয় পরিষদটি বিলুপ্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সালমান এরইমধ্যে এই পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে অবমাননাকর আচরণ করেছেন।  
সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও মধ্যপ্রাচ্য-বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, মার্কিন সরকারই আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি ডেপুটি যুবরাজ সালমানকে ওয়াশিংটন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছে, কারণ, তিনি নিকট ভবিষ্যতেই সৌদি আরবের রাজা হচ্ছেন। তাই তাকে খুব কাছ থেকে জানার জন্যই হোয়াইট হাউজে সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ মন্তব্যের আলোকে মনে করা হচ্ছে বর্তমান সৌদি রাজার ছেলে সালমানকে সৌদি রাজা করার বিষয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে শলা-পরামর্শ হয়েছে সালমানের। আর এই রাজপুত্রও এটা জানেন যে, গণতন্ত্রহীন সৌদি আরবের রাজা হওয়ার অন্যতম বড় শর্ত হল, মার্কিন সরকারের সমর্থন পাওয়া।   
 সৌদি ডেপুটি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান খুব সহজেই সৌদি সিংহাসন দখল করতে পারবেন এমন সম্ভাবনাকে সুদূর পরাহত বলে মনে করছেন বেশিরভাগ বিশ্লেষক। বর্তমানে অসুস্থ যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন নায়েফ যদি মারাও যান তাহলেও আবদুল আজিজ সৌদের অন্য পুত্ররা বর্তমান থাকায় তারা সিংহাসনের দাবি সহজেই ছেড়ে দেবেন বলে মনে হয় না। অবশ্য আবদুল আজিজ সৌদের জীবিত পুত্রদের বয়স অনেক বেশি হয়ে গেছে এবং তারা অসুস্থ- এই অজুহাত দেখিয়ে মুহাম্মাদ বিন সালমানকে রাজা ঘোষণার চেষ্টা করা হতে পারে। কিন্তু আবদুল আজিজ সৌদের অন্য নাতিরাও সহজেই বিষয়টি মেনে নেবেন বলে মনে হয় না। 

সৌদের সিনিয়র বা আধা-বুড়ো নাতিদের মধ্যে অনেকেই সৌদি সিংহাসনের জন্য নিজেদেরকে অতি কম বয়স্ক মুহাম্মাদ বিন সালমানের চেয়ে বেশি যোগ্য ও অভিজ্ঞ বলে মনে করেন। এদের মধ্যে সাবেক সৌদি রাজা আবদুল্লাহর ছেলে মা’তাব বিন আবদুল্লাহ ও  সাবেক যুবরাজ সুলতান বিন আবদুল আজিজের ছেলে বান্দার বিন সুলতানের নাম উল্লেখ করা যায় সবার আগে। সৌদি আরবের দরবারি আলেমদের ওপর বান্দারের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এ দু’জন সহজেই সালমানকে সিংহাসনে বসতে দেবেন বলে মনে হয় না।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, রাজ-সিংহাসন নিয়ে সৌদি রাজ-বংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত জোরদার হতে পারে। মুহাম্মাদ বিন সালমানের প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকেরই বয়স তার বয়সের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। রাজনৈতিক ও সরকারি কাজে তাদের অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। 

সৌদি আরবের ক্ষমতার কাঠামোয় রাজ-পরিবারের মধ্যে দু’টি গোষ্ঠীর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাও লক্ষণীয়। এ দু’টি গোষ্ঠী হল 'সুদাইরি' ও 'শামরি'। বাদশাহ ফাহদ ছিলেন সুদাইরি পরিবারের। অন্যদিকে সাবেক রাজা আবদুল্লাহ ছিলেন শামরি গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। বর্তমান রাজা সালমানও হলেন সুদাইরি পরিবারের সদস্য। বাদশাহ ফয়সালও ছিলেন সুদাইরি পরিবারের। রাজা আবদুল আজিজ সৌদের ৪৩ পুত্রের মধ্যে সুদাইরি পরিবারের তিন জন এ পর্যন্ত সিংহাসনে বসেছেন। সালমান ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে শামরি পরিবার সংশ্লিষ্টদের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা সহজেই রাজ-সিংহাসনের দাবি ছেড়ে দেবেন না। ফলে এ দুই গোষ্ঠী ক্ষমতার প্রশ্নে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
 সাবেক সৌদি রাজা আবদুল্লাহর ছেলে মা’তাব আবদুল্লাহ ও বর্তমান রাজার ছেলে সালমানের মধ্যে নানা বিষয়ে তীব্র মত-বিরোধ রয়েছে। মা’তাব হত্যা প্রচেষ্টার হাত থেকে বেঁচে গেছেন বলেও সম্প্রতি খবর এসেছে। 

ইয়েমেনের ওপর চাপিয়ে দেয়া হঠকারী যুদ্ধে সৌদি সরকারের ক্রমাগত ব্যর্থতা এবং সৌদি সরকারের ইরাক ও সিরিয়া-নীতির ব্যর্থতাও ডেপুটি যুবরাজ সালমানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই এটা স্পষ্ট সালমান ও তার বাবা তথা বর্তমান সৌদি রাজা চাইলেও অনভিজ্ঞ ও কম-বয়স্ক মুহাম্মাদ বিন সালমানের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলো, বিশেষ করে শিগগিরই সৌদি আরবের রাজা হওয়ার স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন হবে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

মুহাম্মাদ বিন সালমানের রাজা হওয়ার চেষ্টা দেশটির রাজবংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত জোরদার করে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।#

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/১
 

ট্যাগ