কুর্দিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গণভোট পরবর্তী পরিস্থিতি (পর্ব-১)
(last modified Mon, 02 Oct 2017 11:33:43 GMT )
অক্টোবর ০২, ২০১৭ ১৭:৩৩ Asia/Dhaka
  • কুর্দিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গণভোট পরবর্তী পরিস্থিতি (পর্ব-১)

ইরাক সরকারের তীব্র বিরোধিতা উপেক্ষা করে দেশটির আধা-স্বায়ত্বশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চলে গত ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বহু বিতর্কিত গণভোট। ইরাক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত এই গণভোটের পর কুর্দিস্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া কঠিন।

তারপরও আমরা এই ধারাবাহিকের কয়েকটি পর্বে সামনের দিনগুলোতে কুর্দিস্তানের জন্য সম্ভাব্য কী কী পরিণতি অপেক্ষা করছে তা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হবে।

কুর্দিস্তানের ওপর অবরোধ আরোপের সম্ভাব্য পরিণতি    

ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাকামী গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বাগদাদসহ প্রতিবেশী দেশগুলো ওই অঞ্চলের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। ইরাক সরকার কুর্দিস্তানের সঙ্গে নিজের সব সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে বাগদাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইরান ও তুরস্ক ওই আধা-স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে।  ইরাক সরকার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশসহ বিশ্বের সব দেশকে কুর্দিস্তানের আরবিল শহরে ফ্লাইট পরিচালনা না করার আহ্বান জানিয়েছে। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেবাননের জাতীয় বিমান পরিবহন সংস্থা আশ-শারকুল আওসাত এবং মিশরের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা ইরাকের কুর্দিস্তানে তাদের সব ফ্লাইট বাতিল করে দিয়েছে।

এর পরবর্তী ধাপে ইরাকের কুর্দিস্তানের ওপর তেল ও খাদ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান এ সম্পর্কে বলেছেন, “উত্তর ইরাকে (অর্থাৎ কুর্দিস্তানে) যদি ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে ইরাকের কুর্দিরা অভুক্ত থাকবে এবং সেখানে যদি পরিশোধিত তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। ”

ইরাকের স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দিস্তানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি

এদিকে ইরাক সরকারও কুর্দিস্তান থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করা থেকে বিরত থাকতে বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-এবাদি কুর্দিস্তান অঞ্চলের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ট্রানজিট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য ইরাকের পার্লামেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এখানে গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন উঠতে পারে, ইরাক থেকে কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গণভোট অনুষ্ঠানের পরপরই প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বাগদাদসহ প্রতিবেশী দেশগুলো কেন  ওই অঞ্চলের ওপর অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত নিল এবং এই অবরোধ চলতে থাকলে তার পরিণতি কি হতে পারে?

এ প্রশ্নের উত্তরে বিশ্লেষকরা অনেকগুলো কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। কুর্দিস্তান এমন একটি অঞ্চল যা ভূমি দ্বারা বেষ্টিত এবং এর চারপাশে কোনো সাগর নেই। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পানিসীমায় প্রবেশের কোনো সুযোগ কুর্দিস্তানের নেই। এ ছাড়া, এই অঞ্চলটি তুরস্ক, ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার মাঝখানে অবস্থিত। কাজেই বহির্বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগসহ যেকোনো ধরনের যাতায়াত করতে হলে এই চার দেশের ভেতর দিয়েই করতে হবে। ওই চারদেশ ঐক্যবদ্ধভাবে সে কাজ করতে না দিলে কুর্দিস্তানের পক্ষে কোনোকিছুই করা সম্ভব হবে না।  এমনিতেই বর্তমানে কুর্দিস্তান অঞ্চলের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২,২০০ কোটি ডলার, সেখানে বেকারত্বের হার অনেক বেশি এবং সরকারি অফিস আদালতে কর্মরতদের বেতন দিতেই হিমশিম খাচ্ছে কুর্দিস্তান সরকার। বর্তমানে কয়েক মাস পরপর বেতন পাচ্ছেন কুর্দিস্তানের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

গণভোটের ফল প্রকাশের পর ইসরাইলি পতাকা নিয়ে কুর্দিদের উল্লাস

এ সম্পর্কে ওয়াশিংটন থিংক ট্যাংকের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, “ইরাকের কুর্দিস্তান বর্তমানে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে এবং অঞ্চলটি ইরাক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এই সংকটের অবস্থা হবে ভয়াবহ। কুর্দিস্তানের ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টি মনে করছে, আলাদা হয়ে যাওয়ার পর কুর্দিস্তান হবে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটি অঞ্চল যে সম্পদ দিয়ে এটি নিজের অর্থনীতির বিকাশ ঘটাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কুর্দিস্তানের স্বশাসন কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার লক্ষ্যে যতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তার সবগুলো ব্যর্থ হয়েছে। কুর্দিস্তানের অর্থনীতি শুধুমাত্র তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল বলে তেল বিক্রির অর্থ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া, কুর্দিস্তানের তেল রপ্তানি খাতে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি এবং আঞ্চলিক সরকারের ক্ষমতাসীন দল ও নেতাদের হস্তক্ষেপের মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে।”

কুর্দিস্তানের তেল আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক শীর্ষে অবস্থান করছে। এ ছাড়া, কুর্দিস্তান থেকে বহির্বিশ্বে তেল রপ্তানি হয় তুরস্কের উপর দিয়ে। কাজেই তুর্কি সরকার তেল কেনা বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি তার তেল পাইপ লাইনগুলো বন্ধ করে দিলে কুর্দিস্তানের তেল রপ্তানি খাতে আয় শূন্যের কোটায় পৌঁছাবে। আর এই অঞ্চলের মোট আয়ের শতকরা ৮৫ ভাগ তেল খাত থেকে আসে বলে অবরোধ আরোপের সম্ভাব্য ফল হিসেবে কুর্দিস্তানের অর্থনীতির চাকাই বন্ধ হয়ে যাবে।

কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্নতাকামী গণভোটের আরেকটি অবধারিত ফল হচ্ছে এই অঞ্চলের একঘরে হয়ে পড়া। প্রথমত, প্রতিবেশী সবগুলো দেশ অবরোধ আরোপ করার ফলে কুর্দিস্তান ভৌগলিক দিক দিয়ে একঘরে হয়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, বহু বিতর্কিত ওই গণভোটের প্রতি অবৈধ রাষ্ট্র ইহুদিবাদী ইসরাইল ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশ সমর্থন জানায়নি। এমনকি জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও কুর্দিস্তানের গণভোটের বিরোধিতা করে বক্তব্য রেখেছেন। কাজেই এই অঞ্চল ইরাক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কূটনৈতিকভাবেও কুর্দিস্তান একঘরে হয়ে পড়বে। কুর্দিদের জন্য গঠিত সম্ভাব্য আলাদা রাষ্ট্রটিকে বিশ্বের কোনো দেশ বা জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেবে না। অথচ একটি স্বাধীন দেশের টিকে থাকার অন্যতম প্রধান শর্তই হচ্ছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি আদায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি যদি কুর্দিদের জন্য স্বাধীন দেশ গঠনের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তাহলে তাতে বিশ্ব অঙ্গনে কুর্দি জনগোষ্ঠীর অবস্থান দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবে কুর্দিস্তানের একঘরে হয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোনো ফল বয়ে আসবে না। 

ইরাকের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে তুর্কি সরকার কুর্দিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে  যাওয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, তুরস্কের জনগণের শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ কুর্দি নাগরিক। ইরাকের কুর্দিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের কুর্দিস্তানের সীমান্ত রয়েছে। কাজেই ইরাকের কুর্দিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হয়ে গেলে তুরস্কের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী পি.কে.কে নিজের সন্ত্রাসী তৎপরতা পরিচালনার জন্য ইরাকের কুর্দিস্তানে অভয়ারণ্য গড়ে তুলবে। তুর্কি সরকার গত কয়েক দশক ধরে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী পি.কে.কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। এমনকি পি.কে.কে বিরোধী অভিযান চালাতে গিয়ে আঙ্কারা বহুবার ইরাকের কুর্দিস্তানেও হামলা চালিয়েছে। এ অবস্থায় নিজের দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা হালে পানি পেতে পারে এমন কোনো ঘটনা তুর্কি সরকার মেনে নেবে না।

এরকম পরিস্থিতিতে গত ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত গণভোটে কুর্দিস্তানের বেশিরভাগ নাগরিক ইরাক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিলেও এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ হবে না। এ সম্পর্কে তুরস্কের বিখ্যাত রাজনৈতিক ভাষ্যকার ‘দুগাজান বাসারান’ মনে করেন: “ইরাক থেকে কুর্দিস্তান অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অত্যন্ত কম। ইরাকের প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরোধিতাই এখানে মূল ভূমিকা পালন করবে। ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও সিরিয়া তাদের বিরোধিতা কঠোর করলে কুর্দিদের পক্ষে নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সফল হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। ”

তুরস্কের এই বিশ্লেষক আরো মনে করেন: “ঐতিহাসিকভাবে ইরান ও তুরস্ক যখনই কোনো ইস্যুতে একক অবস্থান নিয়েছে তখনই বহির্বিশ্বের কোনো শক্তি তাদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারেনি। কাজেই একথা সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতার কারণে কুর্দিস্তান অঞ্চল কোনোদিনও দেশটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারবে না।”#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/আশরাফুর রহমান/২

 

ট্যাগ