মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিরোধ শক্তির বিরুদ্ধে তিন শয়তানি শক্তি ও তাদের বিপজ্জনক যুদ্ধকৌশল
পশ্চিম এশিয়ায় প্রতিরোধ শক্তির বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য, কিছু আরব দেশ ও ইহুদিবাদীরা নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে। ওই তিন শয়তানি শক্তি ইরানের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করা ছাড়াও লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকের প্রতিরোধ শক্তির বিরুদ্ধেও উঠেপড়ে লেগেছে।
বর্তমান সময়ে কগনেটিভ ওয়ার ফেয়ার হচ্ছে সবচেয়ে অত্যাধুনিক যুদ্ধকৌশল। এটি হচ্ছে পরিপূর্ণ, অত্যাধুনিক, গভীরতম ও ব্যাপকভিত্তিক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। এ যুদ্ধের মাধ্যমে মূলত একটি সমাজের জনগণ ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চিন্তাভাবনা, নিজস্ব স্বকীয়তা ও পরিচিতিকে টার্গেট করা হয়। এ যুদ্ধের মাধ্যমে একটি সমাজের বাস্তবতাকে ঠিক উল্টো করে দেখানো হয় যাতে ভেতর থেকে তারা ধসে পড়ে। সামরিক যুদ্ধের চাইতে এটি অনেক সাশ্রয়ী কিন্তু এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব অনেক গভীরে। বলা যায়, এটা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের উন্নত সংস্করণ। এ যুদ্ধের মাধ্যমে মানুষের চিন্তাচেতনার ওপর প্রভাব বিস্তার তথা মন ও মননকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে সমাজে বিষবাষ্প ছড়ানো। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞার মতো অস্ত্র ব্যবহার করেও একটি সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে সামাজিক সংকট সৃষ্টি করাও এ যুদ্ধের অন্যতম কৌশল যাতে এর মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করা যায়। এর মাধ্যমে শত্রুরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিপর্যয় সৃষ্টির দায় ওই সমাজের প্রতিরোধ শক্তিগুলোর ওপর চাপানোর চেষ্টা করে যারা কিনা সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী।
এ ধরনের যুদ্ধের মাধ্যমে তারা নানা ঘটনা ঘটিয়ে প্রতিটি মানুষের আবেগ অনুভূতিকেও নাড়া দেয়ার চেষ্টা করে। বেশ ক'বছর আগে পেন্টাগন থেকে প্রকাশিত 'মানুষের মন মননের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ' নামক একটি বইয়ে মানুষের মন ও হৃদয়ের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নানা উপায় ও দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ইরানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফারযাদ পুর সাঈদ কগনেটিভ ওয়ার ফেয়ার তথা মানুষের চিন্তাচেতনাকে বিভ্রান্ত করার অত্যাধুনিক যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে বলেছেন, একটি সমাজকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেয়া এ যুদ্ধের লক্ষ্য যা কিনা ওই সমাজের মানুষের চিন্তাভাবনা ও ধ্যান ধারণা সম্পর্কে সামগ্রিক পরিচয় জানা না থাকলে সম্ভব নয়। বর্তমানে এ ধরণের যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করা হয়েছে ইসলামি ইরানের বিরুদ্ধে, ইরাকের জনপ্রিয় স্বেচ্ছাসেবী মিলিশিয়া বাহিনী হাশদ আশ শাবিসহ অন্যান্য প্রতিরোধকামী শক্তির বিরুদ্ধে, ইয়েমেনের জনপ্রিয় আনসারুল্লাহর বিরুদ্ধে, লেবাননের হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে। এমনকি শত্রুরা লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াবের সরকারকেও ছেড়ে দেয়নি এবং তার পতন ঘটিয়ে ছেড়েছে।

কগনেটিভ ওয়ার ফেয়ার তথা মানুষের চিন্তাচেতনার ওপর আধিপত্য বিস্তারে অত্যাধুনিক এই যুদ্ধকৌশলের বিভিন্ন পর্যায় বা ধাপ রয়েছে।
প্রথম পর্যায়টি হচ্ছে জনগণের মধ্যে কারো প্রতি অবিশ্বাস ও অনাস্থা তৈরি করা। পাশ্চাত্য, রাজতন্ত্র শাসিত কয়েকটি আরব দেশ ও ইহুদিবাদী মহল এই তিন শয়তানি চক্র মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত প্রতিরোধ শক্তিকে টার্গেট করে তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রতিরোধ শক্তিগুলোকে তারা দুর্নীতির মূল হোতা এবং অনাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তে বাধা সৃষ্টিকারী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ লেবাননের ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহর মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ সবসময়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ওপর জোর দিয়ে আসছেন। কিন্তু তারপরও নাসরুল্লাহর বিরোধীরা নয়া প্রচার কৌশলেরসাহায্যে হিজবুল্লাহকে লেবাননে দুর্নীতির প্রধান উৎস বলে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে গত প্রায় তিন দশক ধরে লেবাননের শাসন ক্ষমতা পাশ্চাত্যপন্থীদের হাতে রয়েছে। লেবাননের জনগণের সঙ্গে ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ শক্তির মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করাই হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রধান উদ্দেশ্য।
মানুষের চিন্তাচেতনার ওপর প্রভাব বিস্তার তথা মন ও মননকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে পরিচালিত নতুন এ যুদ্ধ কৌশলের দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে জনপ্রিয় কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের গ্রহণযোগ্যতাকে এমনভাবে নষ্ট করে দেয়া যাতে মানুষ তাদের থেকে দূরে সরে যায়। অর্থাৎ জনগণের মধ্যে কারো প্রতি অবিশ্বাস তৈরির পর তাদের গ্রহণযোগ্যতাকেও নষ্ট করে দেয়া হয়। এই কৌশলের অংশ হিসেবে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে একটি সমাজের অর্থনীতির চাকাকে অচল করে দেয়া হয় যাতে জনগণের মধ্যে সরকার কিংবা দায়িত্বশীলদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা না থাকে। উদাহরণ স্বরূপ লেবানন ও ইরাকের কথা উল্লেখ করা যায় যেখানে পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট বিরাজ করছে। অথচ ওইসব দেশের এসব সংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে জনপ্রিয় প্রতিরোধ সংগঠনগুলোকে যাতে জনগণ এদের থেকে দূরে সরে যায় এবং সংগঠনের নেতৃবৃন্দের গ্রহণযোগ্যতা আর না থাকে। এমনকি চীন ও ইরানের মধ্যকার দীর্ঘ মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তি নিয়েও তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে যাতে ইসলামি বিপ্লবী সরকারের প্রতি ইরানের জনগণের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা কোনটিই না থাকে।

অনাস্থা সৃষ্টি ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পর ওই তিন শয়তানি শক্তির যুদ্ধের তৃতীয় কৌশল হচ্ছে, শত্রু ভাবাপন্ন দেশগুলোর সরকারকে অযোগ্য ও অকার্যকর প্রমাণ করা।
তারা প্রচার চালায় দেশ পরিচালনায় অযোগ্যতা বা ব্যর্থতার জন্য দায়ী হচ্ছে ওইসব সরকার কিংবা প্রতিরোধ শক্তিগুলো। অথচ লেবাননের পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াবের সরকারের বয়স হয়েছিল মাত্র ছয় মাস এবং এই ছয় মাসে হাসান দিয়াবকে পরিকল্পিত এমন সব সরকার বিরোধী বিক্ষোভ মোকাবেলা করতে হয়েছে যাদেরকে বাইরে থেকে ইন্ধন যোগানো হয়েছিল যাতে সরকারকে অযোগ্য ও অকার্যকর প্রমাণ করা যায়। অর্থনৈতিক সংকটের জন্য হাসান দিয়াবের সরকারকে দায়ী করে বিক্ষোভ লেলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল লেবানন সরকারের পতন ঘটানো।
নতুন ধরনের এ যুদ্ধকৌশলের চতুর্থ ধাপ হচ্ছে, প্রতিরোধ শক্তিগুলোর মনোবল ভেঙে দেয়া। যেমন মাত্র অল্পকিছু অনুচর বা সমর্থককে বিক্ষোভের নামে রাস্তায় নামিয়ে তাদেরকে দিয়ে বিভিন্ন শ্লোগান দেয়া হয়। কিছু সংখ্যক মানুষের ওইসব শ্লোগান বা বিভিন্ন দাবি দাওয়াকে তারা সমাজের সর্বস্তরের দাবি বলে তুলে ধরে। এর মাধ্যমে তারা জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং বিপ্লবী সরকার কিংবা প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলোর মনোবল দুর্বল করার ও আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা চালায় যাতে তারা হতাশ হয়ে পড়ে। ঠিক একই কৌশলে ও অপপ্রচার চালিয়ে লেবাননের হাসান দিয়াব সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে।

মানুষকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে নতুন ধরনের এ মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের টার্গেট বহুমুখী।
ইরানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইয়াদুল্লাহ জাওয়ানি মনে করেন, ভবিষ্যতের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও হতাশা সৃষ্টি করা, নেতৃবৃন্দের ব্যাপারে খারাপ ধারণা তৈরি করা এবং যুবক শ্রেণীকে প্রতিরোধমূলক সংগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে শত্রুরা।
মোট কথা, ওই তিন শয়তানি শক্তি বিপ্লবী দেশ বা সমাজে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। বিস্ফোরণের পর লেবাননের সাম্প্রতিক সহিংস বিক্ষোভ ও সরকার পতন এসবই ওই ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধেরই অংশ। মিথ্যা প্রচার চালিয়ে শত্রুরা ওই বিস্ফোরণের জন্য হাসান দিয়াব সরকারের অবহেলাকে দায়ী করেছে। আবার বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরক মজুদের জন্য হিজবুল্লাহকেও দায়ী করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে লেবাননের সরকার ও প্রতিরোধ শক্তির বিরোধীদের সহযোগিতায় বিক্ষোভ ও সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল যাতে জনগণ সরকার ও হিজবুল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মোটকথা নতুন এ যুদ্ধ কৌশলের উদ্দেশ্য দখলদার ইসরাইলের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করা। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৬