ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২ ০২:৪৫ Asia/Dhaka
  • বাইডেন
    বাইডেন

ড. সোহেল আহম্মেদ: আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাতশ’ কোটি ডলার আমেরিকায় গচ্ছিত ছিল। এর অর্ধেক সাড়ে তিনশ’ কোটি ডলার হাতিয়ে নিয়েছে জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন মার্কিন সরকার। মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে,এই অর্থ আফগানিস্তানকে আর ফেরত দেওয়া হবে না। বাকি সাড়ে তিনশ’ কোটি ডলার ফেরত দেওয়ার কথা তারা বলছে।

তবে সে অর্থও আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের মাধ্যমে নয়, নিজস্ব চ্যানেলে ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বাইডেন প্রশাসনের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১১ ফেব্রুয়ারি এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আফগান জনগণের এই বিপুল টাকা আত্মসাৎ করেন।

আফগান জনগণের টাকা আমেরিকা কেন নেবে? এ ক্ষেত্রেও দাঁড় করানো হয়েছে খোঁড়া যুক্তি ও অজুহাত। আফগান জনগণের এই টাকা তারা ৯/১১ হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের দেবে। আফগান জনগণকে দুর্ভিক্ষের দোরগোড়ায় রেখে একদল ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন নাগরিকের মাঝে তাদের অর্থ বিলিয়ে দেওয়ার এই ঘোষণা মার্কিন বেহায়াপনার এক চূড়ান্ত রূপ। এটা প্রকাশ্য চুরি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারসহ কয়েকটি স্থাপনায় যে হামলা হয় তাতে আফগান জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা এখনো প্রমাণ করতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেদিন হামলার জন্য যারা বিমান ছিনতাই করেছিলেন তাদের মধ্যে একজন আফগান নাগরিকও ছিলেন না। অবশ্য এই হামলার সঙ্গে আফগান নাগরিকেরা জড়িত থাকলেও এর দায় গোটা জাতির ওপর বর্তায় না। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দায় একটি রাষ্ট্র বা জাতির ওপর চাপানো যায় না।

আফগানিস্তানকে ২০ বছর জবরদখলে রাখার পর সেদেশ ছেড়েছে মার্কিন বাহিনী। এই জবরদখলের কারণে লাখ লাখ আফগান নিহত হয়েছেন। আহত ও গৃহহারা মানুষের সংখ্যা অগণিত। আর্থিক ক্ষতির খতিয়ানটাও বেশ লম্বা। এই প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির দায় পুরোপুরি আমেরিকার। কারণ তারা আফগানিস্তানে জোর করে ঢুকেছে এবং নিজেদের ইচ্ছামতো কাঠের পুতুল দিয়ে দেশ চালিয়েছে,যাকে ইচ্ছা তাকে হত্যা করেছে। দুই দশকের মার্কিন আগ্রাসনের পরিণতিতে আফগান জনগণ আজ না খেয়ে মরতে বসেছে। আফগানিস্তানে মার্কিন স্টাইলের যে গণতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার ফলাফল কেবলি হাহাকার।

অস্ত্রের জোরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে ঢোকে সেখানকার জনগণকে কচুকাটা করার নাম গণতন্ত্র হতে পারে না। আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় নারী-শিশুসহ নিরপরাধ মানুষের রক্তের ছাপ। পটকার শব্দ শুনে কত সংখ্যক বিয়ে-বাড়িকে যে মার্কিন বাহিনী বোমা মেরে মরা-বাড়ি বানিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এরপরও নিষ্ঠুরতা থেমে নেই। আফগানদের কষ্ট বাড়াতে এবার তাদের গচ্ছিত অর্থও আত্মসাৎ করেছে ওয়াশিংটন। আসলে আফগানিস্তানে পরাজয়ের গ্লানি কিছুতেই ভুলতে পারছে না আমেরিকা। পরাজয়ের গ্লানি থেকে উৎসারিত প্রতিশোধের তৃষ্ণা মার্কিন প্রশাসনকে ভবিষ্যতে আরও বেহায়া ও বেপরোয়া করে তুলতে পারে। কারণ লাখ লাখ আফগানকে হত্যার পরও আমেরিকাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে তাদের বিচার হবে এমন সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে।

আমেরিকা গোটা আফগান জাতির ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়। এর প্রমাণ হলো-রাষ্ট্র পরিচালনায় অপ্রস্তুত তালেবানের হাতে আফগানিস্তানকে তুলে দিয়ে তড়িঘড়ি মঞ্চত্যাগ করেছে তারা। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার হলেই আফগানিস্তানের ক্ষমতা যে পুরোপুরি তালেবানের হাতে চলে যাবে সে বিষয়ে আমেরিকা শতভাগ নিশ্চিত ছিল। মার্কিন প্রশাসন এর মাধ্যমে আফগান জনগণকে আরেক দফা বিপদে ফেলতে চেয়েছে। তালেবান যে স্বীকৃতি সংকটে পড়বে তা সবাই জানত। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া গোটা বিশ্বেই তালেবান সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত ছিল। ফলে এটাই স্বাভাবিক যে, তালেবান সরকার সহজে স্বীকৃতি পাবে না এবং এই স্বীকৃতি সংকটের মধ্যে পড়ে জনগণ পিষ্ট হতে থাকবে। তালেবানের উগ্র মনোভাবও সবার জানা। এ কারণে আমেরিকা ধরেই নিয়েছিল তালেবান ক্ষমতা নিয়েই প্রতিশোধপরায়ন হয়ে উঠবে, গণহত্যা চালাবে এবং দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা-অরাজকতার নতুন এক অধ্যায় সূচিত হবে।  

ন্যূনতম দায়িত্বানুভূতি থাকলেও কেউ এমন সংকটের মাঝে কোনো রাষ্ট্রকে ফেলে যেতে পারে না। তারা কাণ্ডারি বিহীন জাহাজের মতো আফগানিস্তানকে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিল। মার্কিনীরা চেয়েছিল আফগানিস্তান নামক মুসলিম রাষ্ট্রটি ডুবে মরুক। কিন্তু তালেবান এবার কিছুটা পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে যা আমেরিকার কাছেও ধারণাতীত। তালেবান এখন রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা চূড়ান্ত পরীক্ষায় কতটুকু সফল হবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে ঐক্য, সম্প্রীতি ও সহনশীলতার মনোভাব বজায় থাকলে তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়বে।

অন্যের গচ্ছিত অর্থ-সম্পদ মেরে দেওয়ার মার্কিন প্রবণতা নতুন কিছু নয়। ইরানেরও শত শত কোটি ডলার আটকে রেখেছে আমেরিকা। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানি অর্থ-সম্পদ জব্দের ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন। আমেরিকা অর্থ-সম্পদ আটকে দিতে পারলেও আটকাতে পারেনি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের অগ্রযাত্রা। দখলদারদের প্রত্যাবর্তনের পথ চিরতরে রুদ্ধ করতে এবারের লড়াইয়ে আফগান জাতিকেও টিকে থাকতে হবে। সদর্পে টিকে থাকার কৌশল জানতে আফগানদের বেশি দূর যেতে হবে না। বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মূর্ত প্রতীক প্রতিবেশী ইরানই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট।#

ড. সোহেল আহম্মেদ: লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]

ট্যাগ