ট্রাম্পের হুমকির মুখে ভারত কেন নতিস্বীকার করছে না?
-
এস. জয়শঙ্কর
পার্সটুডে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির জবাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, দিল্লির জ্বালানিনীতি কেবল জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
টাইমস ইকোনমিক গ্লোবাল ফোরামে ভাষণ দিতে গিয়ে জয়শঙ্কর বলেন, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারের স্থিতিশীলতায়ও অবদান রাখে।
তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ২০২২ সালে যখন তেলের দাম চূড়ান্তভাবে বেড়ে গিয়েছিল, তখন পশ্চিমা দেশগুলোই বলেছিল যে, ভারত যদি রাশিয়ার তেল কেনে, তা বিশ্বের জন্য সহায়ক হবে। অথচ এখন সেই দেশগুলোই দিল্লিকে মুনাফাখোরির অভিযোগে অভিযুক্ত করছে, যেখানে চীন এখনও রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক – অথচ তাদের জবাবদিহি খুব একটা চাওয়া হয় না।
ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বৈত চাপ
এক মাসেরও কম সময়ে ট্রাম্প সরকার ভারতের বিরুদ্ধে দুই দফা শুল্ক আরোপ করেছে; আগস্টের শুরুতে ভারতের রপ্তানিপণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং পরে রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি বাণিজ্যের ওপর একই মাত্রার শুল্ক। এতে কার্যত ভারতের অর্থনীতির ওপর ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছে।
ফিনান্সিয়াল টাইমস ও ইকোনমিক টাইমস–এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটনের এই নীতির প্রথম লক্ষ্য মস্কোকে আলোচনার টেবিলে টেনে আনা এবং দ্বিতীয় লক্ষ্য ভারতের কৃষি বাজারকে মার্কিন পণ্যের জন্য উন্মুক্ত করা। কিন্তু ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন সতর্ক করেছে, এই কৌশল উল্টো ফল দেবে এবং ভারতকে আরও বেশি চীনের দিকে ঠেলে দেবে। অন্যদিকে কার্নেগি ইনস্টিটিউশন জানিয়েছে, ভারতের ৮৫ শতাংশ জ্বালানি আমদানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য রাশিয়ার তেল থেকে সরে আসা সম্ভব নয়। বিশেষত, মস্কোর দেওয়া ছাড় ভারতের অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করেছে এবং ইউরোপে প্রক্রিয়াজাত জ্বালানি রপ্তানির সুযোগ বাড়িয়েছে।
চীন-ভারত সম্পর্কের নতুন বাস্তবতা
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ট্রাম্প সরকারের অতিরিক্ত চাপ প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর জন্য কূটনৈতিক ফাটল তৈরি করছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই'র সাম্প্রতিক দিল্লি সফর এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নরেন্দ্র মোদীর সাথে তার বৈঠক ভারসাম্যের এই পরিবর্তনের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
বিশ্লেষকদের মতে, এ সফরের বার্তা ছিল পরিষ্কার: ভারত ও চীন শত্রু নয়, বরং সহযোগী হতে পারে। ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় সীমান্ত সংঘাতের পর যেসব সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়েছিল, আমেরিকার বাড়তি চাপ তা আবার উষ্ণ করেছে।
ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ক্ষোভ
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে দিল্লির অবস্থান নিয়ে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অসন্তোষও ভারতের ওপর কঠোর নীতি চাপিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্লেষকদের মতে, দিল্লি এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে, কারণ তারা নিজেদের স্বাধীন খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছে, যারা সিদ্ধান্ত নেয় কেবল জাতীয় স্বার্থে – বাইরের চাপের ভিত্তিতে নয়।
অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট
দেশের ভেতরেও মোদি সরকার আমেরিকার চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে পারবে না। ভারত তার বিপুল শোধনাগার ক্ষমতা ব্যবহার করে রাশিয়ার সস্তা তেল আমদানি করে, তা প্রক্রিয়াজাত করে এবং এর একটি অংশ ইউরোপকেও রপ্তানি করে। এর ফলে দিল্লি অর্থনৈতিক লাভ তো পাচ্ছেই, পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারেও মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমাতে অবদান রাখছে। এ প্রসঙ্গে জয়শঙ্কর বলেন: “এটি শুধু আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বৈশ্বিক স্বার্থের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
ভারতের বার্তা: স্বাধীনতা সর্বাগ্রে
ওয়াশিংটনের প্রতি ভারতের স্পষ্ট বার্তা – শুল্কনীতি ও সহযোগিতা বন্ধের হুমকি দিল্লির জ্বালানি কৌশল বদলাতে পারবে না। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ভারত সবসময় ভারসাম্য খোঁজে। তবে যদি কেউ চাপ ও হুমকির পথে হাঁটে, দিল্লি বিকল্প পথ বেছে নেবে। চ্যাথাম হাউস–এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জ্বালানি নীতিতে এই স্বাধীনতা ভারতের কৌশলগত পরিচয়ের অংশ, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দিল্লির ওজন বাড়াতে সহায়ক।
আজকের বাস্তবতায় ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ক রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করতে পারেনি; বরং ভারতকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভারত স্পষ্ট করে দিয়েছে – বড় শক্তির সঙ্গে মেলামেশায় তার 'রেডলাইন' হলো স্বাধীনতা রক্ষা। যত বেশি ওয়াশিংটন চাপ দেবে, দিল্লি তত জোরালোভাবে এই স্বাধীনতার কথা বলবে।
জয়শঙ্কর এক বাক্যে এই সত্যটি সংক্ষেপে বলেছেন; আমেরিকার হুমকির মুখে ভারতের সামষ্টিক নীতি প্রতিফলিত করে এমন একটি বাক্য: “যদি আপনাদের ভালো না লাগে, তাহলে কিনবেন না।”
পার্সটুডে/এমএআর/২৬