পাক-মার্কিন সম্পর্ক: ৭০ বছরের হস্তক্ষেপ, অবিশ্বাস ও উত্তরণের সংগ্রাম
-
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও শাহবাজ শরীফ
পার্সটুডে: গত সাত দশক ধরে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সবসময়ই ওয়াশিংটনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হস্তক্ষেপে প্রভাবিত হয়েছে—যা পাকিস্তানের রাজনীতি, নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক পুনর্ব্যাখ্যা করার বিষয়ে ইসলামাবাদের ক্রমাগত প্রচেষ্টা প্রায়শই ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছে এবং ঐতিহাসিক অবিশ্বাসের ছায়া দুটি দেশের মধ্যে একটি স্থিতিশীল অংশীদারিত্ব গঠনে বাধা সৃষ্টি করেছে। পার্সটুডের এই বিশেষ প্রতিবেদনে পাকিস্তানের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো:
সম্পর্কের সূচনা ও প্রথম হস্তক্ষেপ
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে শীতল যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে বেছে নেয়। ওয়াশিংটনের সমর্থনে ইসলামাবাদ আফগান মুজাহিদীনদের সজ্জিত করতে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যাহারের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত তার সমর্থন কমিয়ে দেয় এবং পারমাণবিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এই অভিজ্ঞতাই ইসলামাবাদের প্রতি ওয়াশিংটনের উপযোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রথম স্পষ্ট লক্ষণ ছিল।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি: ওয়াশিংটনের প্রভাব
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও বহুবার মার্কিন হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে। সরকার ও বিরোধীদের দ্বন্দ্বে পক্ষ নেওয়া থেকে শুরু করে সরকার পতনে জড়িত থাকার অভিযোগ পর্যন্ত নানা সময়ে ওয়াশিংটনের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে। জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে ইসলামাবাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে 'সরকার পতনের ষড়যন্ত্র'–এর অভিযোগ তোলে। এছাড়া, বাইডেন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপ করতে অস্বীকৃতি জানান—যা স্থানীয় গণমাধ্যমে রাজনৈতিক চাপ ও অবহেলার প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।
নিরাপত্তা: ক্রমাগত চাপের হাতিয়ার
সন্ত্রাসবাদের ইস্যুটি দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটনের চাপ প্রয়োগের অন্যতম হাতিয়ার। পাকিস্তান সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে বিপুল মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্র বারবার অভিযোগ তোলে যে, ইসলামাবাদ 'জঙ্গিদের আশ্রয়' দিচ্ছে। যেমন, 'বালুচ লিবারেশন আর্মি' ও 'লস্কর-ই-মজিদ'–কে সন্ত্রাসী সংগঠন তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি অঞ্চলের কিছু উগ্র গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে বোঝা যায়, এসব পদক্ষেপ প্রকৃত সহযোগিতার চেয়ে বেশি ছিল নিরাপত্তা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ ও পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যম।
অর্থনীতি ও লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা
মার্কিন হস্তক্ষেপ পাকিস্তানের অর্থনীতিতেও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। নানা সময়ে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা স্থগিত, সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রশিক্ষণ সহযোগিতা বন্ধ এবং নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকি—সবই ওয়াশিংটনের নীতি ছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় তালেবান আশ্রয়ের অভিযোগে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা দুই দেশের সম্পর্ককে সবচেয়ে নিম্নস্তরে নামিয়ে আনে। এ চাপ পাকিস্তানকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর বড় উদাহরণ হলো চীন–পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্প।
চাপের সমীকরণে ভারতের ভূমিকা
মার্কিন হস্তক্ষেপের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটনের কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করা। পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী ও পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে মার্কিন হিসাব-নিকাশে বিশেষ স্থান দেওয়া হয়েছে। সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতায় ওয়াশিংটনের ভারতের প্রতি সমর্থন দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য পাকিস্তানের ক্ষতির দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং ইসলামাবাদের ওপর চাপ আরও বাড়িয়েছে।
ইসলামাবাদের প্রতিরোধ ও ভবিষ্যৎ
সব চাপের মধ্যেও পাকিস্তান কিছু মৌলিক বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান বজায় রেখেছে। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন, ওয়াশিংটনের চাপিয়ে দেওয়া নীতির বিরোধিতা এবং পূর্ব ব্লকের দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা—এসব তার উদাহরণ। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানি কর্মকর্তাদের ইসলামাবাদ সফর এবং রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে আঞ্চলিক বিকল্প খুঁজছে। পাকিস্তানি বিশ্লেষকরা মনে করেন, কেবল কৌশলগত সতর্কতা ও অতীত অভিজ্ঞতার সঠিক ব্যবহারই সাময়িক সহযোগিতাকে “কৌশলগত ফাঁদে” পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে।
রাজনীতি, নিরাপত্তা ও অর্থনীতির অঙ্গনে মার্কিন হস্তক্ষেপের কারণে পাকিস্তান–মার্কিন সম্পর্ক সবসময়ই অস্থির ও উত্তেজনাপূর্ণ থেকেছে। পারমাণবিক নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে অভিযোগ—এসব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ইসলামাবাদের মনে অবিশ্বাসকে আরও গভীর করেছে। বর্তমানে পাকিস্তান যখন পূর্ব ব্লকের সহযোগিতা ও পশ্চিমা চাপের মধ্যে দোদুল্যমান, তখন ইসলামাবাদ–ওয়াশিংটনের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি অনিশ্চিত দেখাচ্ছে। যতদিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপমূলক নীতি চলতে থাকবে, এই সম্পর্ক কৌশলগত সীমার বাইরে গিয়ে টেকসই ও ভারসাম্যপূর্ণ অংশীদারিত্বে রূপ নেবে—এ সম্ভাবনা খুবই কম।#
পার্সটুডে/এমএআর/১০