আল জাজিরার প্রতিবেদন:
সিরিয়ায় ইসরায়েলের নীলনকশা: যুদ্ধ না অপমানজনক আত্মসমর্পণ?
-
সিরিয়ার স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট আবু মোহাম্মদ আল- জোলানি
পার্সটুডে: কাতারভিত্তির স্যাটেলাইট চ্যানেল আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, মার্কিন সরকারের মদদে দক্ষিণ সিরিয়ায় ইসরায়েলের সামরিক তৎপরতা- দেশটিকে ব্যাপক সংঘর্ষের মুখে ঠেলে দিচ্ছে এবং দামেস্ককে কঠিন এক দ্বিধায় ফেলেছে—যুদ্ধ নাকি অপমানজনক আত্মসমর্পণ।
আল জাজিরা তাদের বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে লিখেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সিরিয়ায় বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে আগ্রাসী অভিযান নতুন দামেস্ক প্রশাসনকে চরম চাপে ফেলেছে। এই তৎপরতা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা ইরনা'র উদ্ধৃতি দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, সিরিয়া ইসরায়েলের ভূরাজনৈতিক প্রকল্পের কেন্দ্রবিন্দু, যার লক্ষ্য পশ্চিম এশিয়ার কাঠামো পরিবর্তন করা—অর্থাৎ আঞ্চলিক দেশগুলোকে ভেঙে ছোট ছোট জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বক্তব্য থেকেও এই লক্ষ্য পরিষ্কার বোঝা যায়।
সামাজিক ও ভৌগোলিকভাবে ইরাক ও তুরস্কের সঙ্গে সংযোগ এবং ইরানের সঙ্গে জাতিগত ও ধর্মীয় মিল থাকার কারণে, তেল আবিবের দৃষ্টিতে সিরিয়া এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি 'আদর্শ উদাহরণ'। বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ার কাঠামোতে যেকোনো পরিবর্তন পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আল জাজিরা আরও জানিয়েছে, সিরিয়ায় ইসরায়েলের বেশ কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে—যেমন দক্ষিণ সিরিয়ায় একটি নিরাপত্তা অঞ্চল (Buffer Zone) তৈরি, সুয়াইদা প্রদেশে মানবিক করিডর, এবং “দাউদ করিডর” নামে একটি পরিকল্পনা। এর কিছু ইতোমধ্যেই বাস্তবায়নের পর্যায়ে, আবার কিছু এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে তবে সেগুলো কার্যকর করার জন্য ইসরাইল উপযুক্ত সুযোগ খুঁজছে।
অন্যদিকে, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা দেশটিতে হস্তক্ষেপের একটি অজুহাত হিসেবে কাজ করছে। তেল আবিবের দৃষ্টিতে সিরিয়া এখনো নানা পরিবর্তনের সম্ভাবনাময় এক দেশ। ইসরায়েলি নেতৃত্ব সিরিয়াকে দেখে এক ধরনের “আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্যের পরীক্ষাগার” হিসেবে, যেখানে নতুন কৌশলগত সমীকরণগুলো পরীক্ষা ও প্রয়োগ করা সম্ভব। দেশের অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা এই পরিস্থিতিকে আরও বিস্ফোরণমুখী করে তুলেছে।
নিরাপত্তা চুক্তি নাকি বাস্তবতা চাপিয়ে দেওয়া?
আল জাজিরা লিখেছে, ইসরায়েল সিরিয়ার জন্য দুইটি পথ নির্ধারণ করেছে—যুদ্ধ বা অপমানজনক আত্মসমর্পণ? এই পরিকল্পনা মূলত গোলান মালভূমি ও দক্ষিণ সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। তেল আবিব তার সামরিক ক্ষমতা ও দামেস্কের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাজধানী ও তার উপকণ্ঠে প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
এ কারণেই ইসরায়েল দামেস্কের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তির দিকে কোনো নমনীয়তা দেখাচ্ছে না। সুইদা সীমান্তে করিডর খোলা হয়েছে মূলত কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি এড়ানোর কৌশল হিসেবে। সাবেক মোসাদ কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত ইসরায়েলি জেনারেলরা মনে করেন, এই পর্যায়ে কোনো নিরাপত্তা চুক্তি ইসরায়েলের স্বার্থে নয়, কারণ এটি সামরিক কার্যক্রম সীমিত করবে এবং কোনো লাভ ছাড়াই পিছু হটার অর্থ বহন করবে।
বর্তমানে দক্ষিণ সিরিয়া কার্যত ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে এবং দামেস্কও তাদের সরাসরি হামলার আওতায় রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ জলসম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চল যেমন কুনেইত্রা ও দারা ইসরায়েলের দখলে এবং সিরিয়া থেকে কোনো তাৎক্ষণিক হুমকি অনুভূত হচ্ছে না। ফলে তেল আবি তার অর্জিত ভূরাজনৈতিক সুবিধা থেকে পিছু হটার প্রয়োজন দেখছে না।
তবে এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে ইসরায়েলের অবস্থানও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। দামেস্কে যে সরকারই থাকুক না কেন, যদি তারা আলোচনার মাধ্যমে বা মধ্যস্থতার পথ খুঁজে সংকট নিরসন করতে না পারে, তবে তারা কঠিন এক বাস্তবতার মুখে পড়বে। দামেস্কের উপকণ্ঠে ইসরায়েলের প্রভাব বৃদ্ধি সিরীয় নেতৃত্বের নমনীয়তা ও বাস্তববাদী নীতিকে দুর্বল করছে এবং যুদ্ধের পথকে ক্রমেই অপরিহার্য করে তুলছে।
ট্রাম্পের নিরাপত্তা নীতি ও আগ্রাসনের মুখে নীরবতা
আল জাজিরা প্রতিবেদনের শেষাংশে মার্কিন সরকারের ভূমিকার প্রসঙ্গে লিখেছে: "ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, তারা পশ্চিম এশিয়ায় এক নতুন নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলছে, যা সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরবর্তী ব্যবস্থার বিকল্প হবে। কিন্তু এই নতুন কাঠামো আন্তর্জাতিক আইন নয়, বরং ইসরায়েলের নিরাপত্তা স্বার্থকে ভিত্তি করে তৈরি হচ্ছে।
ওয়াশিংটন তেল আবিব ও দামেস্কের মধ্যে এমন একটি নিরাপত্তা চুক্তিকে সমর্থন করে যা ইসরায়েলের শর্তে হবে, আন্তর্জাতিক আইন বা আঞ্চলিক রাজনীতির নিয়মে নয়। তাই ইসরায়েল যখন নতুন সিরীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, যুক্তরাষ্ট্র তাতে কোনো আপত্তি করছে না—এমনকি সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের প্রতিও তারা মুখে প্রতিবাদ জানায়নি।
এর অর্থ, ওয়াশিংটন পশ্চিম এশিয়ার নতুন নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের প্রক্রিয়াকে ইসরায়েলের সিরিয়া-কেন্দ্রিক স্বার্থ থেকে আলাদা করে দেখছে।
আল জাজিরা আরও লিখেছে, গাজায় যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে ট্রাম্পের আগ্রহ আসলে কোনো শান্তির প্রয়াস নয়, বরং নিজ দেশের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও নির্বাচনী ব্যয়ের ফল। এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলে চরমপন্থী মন্ত্রিসভার টিকে থাকা পুরো সিরিয়া ও অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে।#
পার্সটুডে/এমএআর/২১