ফিলিস্তিনের প্রতি তুরস্কের প্রতীকী সমর্থন; কথায় ও কাজে সামঞ্জস্য নেই
-
ওমিত ওজদাগ
পার্সটুডে- তুরস্কের রাজনীতিক ওমিত ওজদাগের ফিলিস্তিন বিষয়ে মন্তব্য তুরস্কের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের “ভিক্টর পার্টি”-র নেতা ওমিত ওজদাগ বলেছেন, “মসুল ও কারকুক আমাদের জন্য ফিলিস্তিনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আরও বলেন, তার আগের বক্তব্যে যখন তিনি বলেছিলেন “ফিলিস্তিন তুরস্কের জাতীয় বিষয় নয়”, তখন তার বিরুদ্ধে এক প্রচারণা চালানো হয় এবং সমালোচকরা তাকে ইসরায়েলি শাসনের সমর্থক হিসেবে অভিযুক্ত করেন।
ওজদাগ বলেন, “আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, কারণ আমি বলেছি—ফিলিস্তিন তুর্কি জাতির জাতীয় ইস্যু নয়। এমনকি এটি পুরো আরব বিশ্বেরও একটি সাধারণ ইস্যু নয়। জেরুজালেম (বায়তুল মুকাদ্দাস) পবিত্রতার কারণে তুর্কিদের কাছে সম্মানিত, কিন্তু এটি আমাদের প্রধান জাতীয় সমস্যা নয়।”
তিনি তুরস্ক সরকারের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করে বলেন, “যখন গাজার ফিলিস্তিনিরা গণহত্যা ও বাস্তুচ্যুতির শিকার হচ্ছে, তখন তুরস্কের ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য আগের মতোই জোরেশোরে চলছে। যারা বলে ফিলিস্তিন তাদের জাতীয় ইস্যু, তারা আসলে শুধু মুখে কথা বলে—কিন্তু বাণিজ্য থামায় না।”
ভিক্টর পার্টির এই নেতা আরও বলেন, “মসুল ও কারকুক তুর্কমানদের ভূমি এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনের চেয়েও এসব ভূখণ্ড তুর্কিদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি তার দলের জাতীয় অগ্রাধিকারগুলো উল্লেখ করে বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য তুর্কি জাতির স্বার্থ রক্ষা করা।
তুরস্কের রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরেই এরদোগান সরকারের ফিলিস্তিন নীতির সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে গাজায় চলমান গণহত্যা ও ইসরায়েলি অপরাধের পরও তুরস্কের ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়টি তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্কের ফিলিস্তিন বিষয়ক নীতিতে সুস্পষ্ট বৈপরীত্য দেখা গেছে। এরদোগান সরকার একদিকে গাজায় ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়ে নিজেদের ফিলিস্তিনের সমর্থক হিসেবে তুলে ধরে, অন্যদিকে তেলআবিবের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে।
এই দ্বিমুখী আচরণের কারণে বহু বিশ্লেষক মনে করেন, তুরস্কের মুখে মুখে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন আসলে একটি রাজনৈতিক প্রচারণা বা মানুষের মনভুলানোর কৌশল।
তুরস্ক সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ও বক্তৃতায় বারবার ইসরায়েলকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে এবং গাজায় হামলা বন্ধের আহ্বান জানায়, কিন্তু এরপরও বাণিজ্য বিষয়ক পরিসংখ্যান বলছে—ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়নি, বরং কোনো কোনো সময় তা বেড়েছে।
সরকারি বক্তব্য ও অর্থনৈতিক আচরণের মধ্যে এই বৈপরীত্য প্রমাণ করে, ফিলিস্তিন ইস্যুটি তুরস্কে রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও ফিলিস্তিন ইস্যুটি ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী আবেগ উসকে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
এরদোগান নেতৃত্বাধীন একেপি দল নির্বাচন বা রাজনৈতিক সংকটের সময় ফিলিস্তিন ইস্যু সামনে এনে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করে। তবে বাস্তবে ফিলিস্তিনের জন্য তাদের পদক্ষেপ সীমাবদ্ধ থাকে মিডিয়া বিবৃতির মধ্যেই।
আরব ও মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশও মনে করে—তুরস্কের ফিলিস্তিনপ্রীতি আসল কোনো অঙ্গীকার নয়, বরং একটি কূটনৈতিক প্রদর্শন।
তুরস্কের সমাজে বিশেষ করে ইসলামপন্থী সংগঠন ও তরুণদের মধ্যে ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে গভীর আবেগ রয়েছে। সরকারও এই শ্রেণির জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে প্রতীকী ও প্রচারণামূলক অবস্থান নেয়—যেমন আবেগপূর্ণ টুইট, তীব্র ভাষায় বক্তৃতা বা জনসভায় অংশগ্রহণ। কিন্তু নীতির ক্ষেত্রে বা বাস্তব পদক্ষেপের পর্যায়ে খুব কম পরিবর্তন দেখা যায়।
কাজেই তুরস্কের ফিলিস্তিননীতি মূলত একটি জনমত নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক অবস্থান রক্ষার রাজনৈতিক উপকরণ হিসেবে কাজ করে।
এই প্রচারণামূলক ও দ্বিমুখী নীতি হয়তো স্বল্পমেয়াদে কার্যকর হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা তুরস্কের কূটনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতাকে সংকটে ফেলছে।#
পার্সটুডে/এসএ/৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।