কেন ব্রিটিশ কর্মজীবী বাবা–মায়েরা ফুড ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছেন?
https://parstoday.ir/bn/news/world-i155084-কেন_ব্রিটিশ_কর্মজীবী_বাবা_মায়েরা_ফুড_ব্যাংকের_দ্বারস্থ_হচ্ছেন
পার্সটুডে: ব্রিটেনে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এর প্রভাব এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক কর্মজীবী বাবা–মা পরিবারের খাবারের জোগান দিতে দাতব্য সংস্থা ও ফুড ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন।
(last modified 2025-12-14T11:59:19+00:00 )
ডিসেম্বর ১৪, ২০২৫ ১৭:৫৫ Asia/Dhaka
  • ব্রিটেনে বর্তমান সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি মানবিক ও সামাজিক সংকট
    ব্রিটেনে বর্তমান সংকট শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি মানবিক ও সামাজিক সংকট

পার্সটুডে: ব্রিটেনে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এর প্রভাব এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক কর্মজীবী বাবা–মা পরিবারের খাবারের জোগান দিতে দাতব্য সংস্থা ও ফুড ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন।

পার্সটুডে’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটেনে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বিনা মূল্যে খাবার সংগ্রহকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, শত শত হাজার ব্রিটিশ কর্মজীবী বাবা–মা নিজেদের পরিবারের ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য দাতব্য সংস্থা ও ফুড ব্যাংকের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

এই জরিপটি প্রকাশ করেছে দাতব্য সংস্থা 'দ্য ফেলিক্স প্রজেক্ট'। এতে বলা হয়, প্রতি চারজন কর্মজীবী অভিভাবকের মধ্যে একজন নিয়মিতভাবে ফুড ব্যাংক থেকে খাবার সংগ্রহ করছেন।

ব্রিটেনে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে, যার ফলে দারিদ্র্য বাড়ছে এবং ধনী–গরিবের ব্যবধান আরও গভীর হচ্ছে। ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়া), ইউক্রেন যুদ্ধের খরচ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা- সব মিলিয়ে ব্রিটেনের অর্থনীতিকে গভীর সংকটে ফেলেছে।

ব্রিটিশ পরিবারগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো- মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি এবং তার ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে খাদ্যপণ্য, বাসস্থান, জ্বালানি ও পরিবহনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুর দাম বেড়েছে। এর ফলে বহু পরিবারই আর তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।

বিশেষ করে কর্মজীবী বাবা–মায়েরা, যারা আগে কোনোমতে সংসারের খরচ চালাতে পারতেন, এখন তারাও পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে তারা বাধ্য হচ্ছেন ফুড ব্যাংক ও দাতব্য সংস্থার সাহায্য নিতে।

শীতকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট আরও তীব্র হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটেনে জ্বালানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফলে ইউরোপের দেশগুলো নিজেরাই জ্বালানি সরবরাহে সমস্যায় পড়েছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনে।

অনেক ব্রিটিশ পরিবারকে এখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে—খাবার কিনবে, নাকি ঘর গরম রাখবে। এই বাস্তবতা উন্নত দেশের জন্য এক গভীর সামাজিক সংকেত।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু জ্বালানির দামই বাড়ায়নি, বরং সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ও কাঁচামালের ঘাটতির কারণে বহু শিল্পপণ্যের দামও বেড়েছে। ব্রিটেন, যা আগে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর আংশিকভাবে নির্ভরশীল ছিল, যুদ্ধ শুরুর কয়েক বছর পরও এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

জ্বালানি সংকটের সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মিলিয়ে সাধারণ পরিবারের ওপর চাপ দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটেনে মূল্যস্ফীতির হার ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। খাদ্য, যাতায়াত এমনকি বাসাভাড়াও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এই অবস্থায় অনেক পরিবার বাধ্য হচ্ছে সস্তা বিকল্প খুঁজতে অথবা দাতব্য সংস্থার সাহায্য নিতে।

বিশ্লেষকদের মতে, ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতিগত দুর্বলতাও এই সংকটের বড় কারণ। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সামাজিক সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।

কর বৃদ্ধি, সরকারি ব্যয় সংকোচনের মতো নীতিগুলো মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে সামাজিক অসন্তোষ বাড়ছে এবং বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে।

এই সংকট শুধু ব্রিটেনেই সীমাবদ্ধ নয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশেও একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। স্পেন ও গ্রিসের মতো দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশগুলোতে উচ্চ বেকারত্ব ও জীবনযাত্রার ব্যয় পরিবারগুলোর ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে।

ফ্রান্স ও ইতালির মতো দেশগুলোতেও সামাজিক সহায়তা থাকা সত্ত্বেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সামরিক ও নিরাপত্তা ব্যয় বৃদ্ধি, ইউরোপীয় দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন এবং সামাজিক সহায়তা নীতির পরিবর্তনের ফলে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান ক্রমশ নিচের দিকে নামছে।

ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্দ সতর্ক করে বলেছেন, সরকারগুলো যদি এই সংকট দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারে, তাহলে ইউরোপে সামাজিক বৈষম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেলও সতর্ক করে বলেছেন, জ্বালানি সংকট ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যার সমন্বয় ইউরোপে ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

সব মিলিয়ে বলা যায়—এই সংকট কেবল একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক সংকট। সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ব্রিটেনসহ ইউরোপের বহু দেশে সামাজিক উত্তেজনা ও অসন্তোষ আরও বাড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্বল শ্রেণির জন্য সহায়তা বাড়ানো, টেকসই অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ওপর চাপ কমানোর উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।#

পার্সটুডে/এমএআর/১৪