বাবা! আমার মা কোথায় গেছেন?: শিশু হযরত ফাতিমার প্রশ্ন!
হে সব প্রকৃত মুমিনদের মাতা (উম্মুল মু’মিনিন)! আপনার ওফাত-বার্ষিকীতে নিন আমাদের অনন্ত সালাম!
মহানবী (সা) ইয়াতিম অবস্থায় দুনিয়ায় এসেছিলেন। প্রায় ৫ বছর বয়সে মাকেও হারান। ফলে তাঁকে লালন-পালনে আরও বেশি মনোযোগী হন হযরত ইব্রাহিমের একত্ববাদী ধর্মে বিশ্বাসী দাদা আবদুল মুত্তালিব। কিন্তু দাদাও বিদায় নেন কিছুকাল পর। বিদায়ের আগে প্রিয় নাতীর জন্য নিজেই সন্তানদের মধ্য হতে ঠিক করেন নতুন অভিভাবক আবু তালিবকে। তিনিও ছিলেন ইব্রাহিমের একত্ববাদী ধর্মে বিশ্বাসী। অর্থাৎ সে যুগে ইসলাম ধর্ম না থাকলেও মক্কার কুরাইশ বংশে ও বিশেষ করে হাশিমি গোত্রের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ইব্রাহিমের একত্ববাদী ধর্মে বিশ্বাসী। এদেরকে বলা হত হানিফ।
এমনই এক হানিফ পরিবারের সতী-সাধ্বী খোদাভীরু মেয়ে ছিলেন হযরত খাদিজা। হযরত খাদিজা ব্যবসা-সূত্রে প্রবাদতুল্য বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁকে বলা হত আরবের শ্রেষ্ঠ ধনী নারী। খাদিজার বাণিজ্য-কাফেলার ম্যানেজার বা ব্যবসায়িক প্রতিনিধি হয়েছিলেন মহানবী (সা) নবুওত লাভের আগে। এ সময়ে তার অনন্য সততা, আমানতদারী ও ব্যবসায়িক দক্ষতা আর সাফল্য দেখে মুগ্ধ হন বিবি খাদিজা। ফলে দাসীর মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান যুবক মুহাম্মদের কাছে। এমন এক অবিশ্বাস্য প্রস্তাব পাবেন দরিদ্র ও ইয়াতিম যুবক মুহাম্মাদ! হয়ত ভাবতেও পারেননি তাঁর অভিভাবক আবুতালিব!
হযরত আবু তালিব (রা) তাঁর প্রিয় ভাতিজার বিয়ের সময় বলেছিলেন: “সব প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে করেছেন ইব্রাহিমের বংশধর, ইসমাইলের বংশ হিসেবে, মা’দের বংশধর ও মুদারের সত্তা বা বংশ হিসেবে, যিনি (আল্লাহ) আমাদের করেছেন তার ঘরের (কাবা শরিফ) মুতাওয়াল্লি বা দেখাশোনাকারী অভিভাবক এবং পবিত্র চত্বর বা আঙ্গিনাগুলোর খাদেম, যিনি আমাদের জন্য তৈরি করেছেন একটি ঘর যা চাওয়া হয় হজের জন্য ও তা হল নিরাপত্তার এক পবিত্র ঘর এবং তিনি আমাদেরকে দিয়েছেন জনগণের ওপর কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব। আমার এই ভাতিজা মুহাম্মাদ একজন অতুলনীয় ব্যক্তি!: আপনারা যদি অন্যদের সম্পদের সঙ্গে তাঁর সম্পদের তুলনা করেন তাহলে তাঁকে সম্পদের অধিকারী হিসেবে পাবেন না, কারণ সম্পদ হচ্ছে ধ্বংসশীল ছায়া ও তুচ্ছ বস্তু মাত্র .... সে খুয়াইলিদের কন্যা খাদিজার পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছে।” (সূত্র: ঐতিহাসিক ইবনে হিশামের লেখা বই আসসিরাত আন নাবাবিয়া)
লক্ষ্য করুন! আবু তালিব বিশ্ব জগতের স্রস্টা এক আল্লাহর প্রশংসা করলেন ভাতিজা তথা আল্লাহর শেষ নবীর বিয়ের অনুষ্ঠানকে মহিমান্বিত করার ভাষণে! হযরত ইব্রাহিমের বংশধর হিসেবে তিনি গৌরব অনুভব করলেন! ইব্রাহিমের পুত্র ইসমাইলের বংশধর হিসেবে ও সেই সূত্রে কাবা ঘরের অভিভাবক হিসেবে তিনি ও তার গোত্র যে আরবের অন্য গোত্রগুলোর ওপর কর্তৃত্ব বা নেতৃত্বের অধিকারী সেটাও উল্লেখ করলেন। মহানবীর বয়স তখনও ২৫ বছর মাত্র এবং তিনি তখনও ইসলাম প্রচারের ঘোষণা দেননি। আবু তালিব যে মূর্তিপূজারীদের বিপরীতে ইব্রাহিমের ধর্মে বিশ্বাসী একত্ববাদী হানিফ বা আদি-মুসলিম ছিলেন তা এখানে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আবু তালিব তো লাত, মানাত, হোবল এবং ওজ্জার মত পৌত্তলিক ও মুশরিকদের দেবতাগুলোর নামও উচ্চারণ করতে পারতেন!
যাই হোক খুয়াইলিদ ইবনে আসাদ ও তার স্ত্রী ফাতিমা বিনতে জা’দার কন্যা খাদিজাও অনন্য-সুন্দর চরিত্রের জন্য আত্ ত্বাহিরা বা পবিত্র হিসেবে খ্যাত ছিলেন। সম্পর্কের দিক থেকে মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন খাদিজার দূরবর্তী চাচাত ভাই। বস্তুগত সম্পদহীন যুবক মুহাম্মাদের সঙ্গে ২৫ বছর ঘর করেন বিবি খাদিজা। বিয়ের ১৫ বছর পর মুহাম্মাদ (সা) নবুওতি মিশন তথা ইসলাম প্রচার শুরু করেন। ইসলামের দাওয়াত পেয়েই সাথে সাথেই কবুল করেন তিনি। আর তাই খাদিজাই ছিলেন সর্বপ্রথম মুসলমান।
পরবর্তীকালে ইসলামের জন্য সব সম্পদ দান করে দিয়েছিলেন মহীয়সী ও দানশীলা নারী খাদিজা। দরিদ্র আর নির্যাতিত নও-মুসলিমদের খাবার দেয়া, কাপড় ও পোশাক দেয়া ও তাদের আশ্রয় দেয়ার কাছে নিজের সব সম্পদ বিলিয়ে দেন হযরত খাদিজা। ফলে মৃত্যুর সময় তার কাছে ছিল না কোনো বস্তুগত সম্পদ। একমাত্র সন্তান ফাতিমার জন্যও তাই রেখে যাননি একটি মুদ্রাও।
খাদিজা যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন মহানবী কোনো বিয়ে করেননি। সামাজিক নানা কুসংস্কার ভাঙ্গতে মহানবী পরে নয়টি বিয়ে করলেও অনুগত খাদিজার স্মৃতি ছিল প্রিয়তম স্মৃতি। তাঁর কথা স্মরণ হলেই মহানবীর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ত অশ্রু!
একবার বিশ্বনবী (সা.)’র কোনো এক স্ত্রী নিজেকে হযরত খাদিজা (সা.)’র চেয়ে উত্তম বলে দাবি করলে আল্লাহর রাসূল তাকে তিরস্কার করে বলেন: ‘আল্লাহর কসম, মহান আল্লাহ আমাকে তাঁর চেয়ে কোনো উত্তম স্ত্রী দান করেননি। তিনি আমার প্রতি তখনই ঈমান এনেছিলেন যখন অন্যরা আমাকে বিদ্রূপ করত, তিনি আমাকে তখনই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন যখন অন্যরা আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তিনি তাঁর সব সম্পদ ব্যয় করেছেন আমার জন্য এবং তাঁর মাধ্যমেই আমি সেইসব সন্তানের অধিকারী হয়েছি যা অন্য কোনো স্ত্রীর মাধ্যমে আমার জন্য নির্ধারিত হয়নি।' (বুখারি শরিফ)
যে বছর হযরত খাদিজা (সা.) ইন্তিকাল করেন সেই বছর ইন্তিকাল করেন রাসূল (সা.)'র প্রিয় চাচা ও অভিভাবক হযরত আবু তালিব(রা.)। তাই এ বছরটিকে ইসলামের ইতিহাসে 'আমুল হোজন' বা 'দুঃখের বছর' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
ইসলামের শৈশবে এর শত্রু কাফির-মুশরিকরা যখন মুসলমানদের ওপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা অবরোধ আরোপ করে তখন শো'বে আবু তালিব উপত্যকায় দিনের পর দিন অনাহারে থাকতে হয়েছিল উম্মুল মু'মিনিন হযরত খাদিজা (সা.)-কে।
ইসলাম প্রচারের প্রথম দিনগুলোতে যখন রাসূল (সা.)-কে নানাভাবে অপমান ও ঠাট্টা-বিদ্রূপের শিকার হতে হত এবং তাঁর মাথায় ছাই বা পশুর নাড়ীভুঁড়ি চাপানো থেকে শুরু করে দাঁত-মুবারক পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেলেছিল শত্রুরা তখন সবচেয়ে বড় সহায়তাকারী হিসেবে পাশে ছিলেন জীবন-সঙ্গী উম্মুল মু'মিনিন হযরত খাদিজা (সা.)।
খাদিজাকে দাফন করার পর শিশু কন্যা ফাতিমাকে (বড় জোর সাত বছর বয়স) সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েন মহানবী (সা) যখন ফাতিমা প্রশ্ন করেন: বাবা! আমার মা কোথায় গেছেন? এ সময় ওহির ফেরেশতা জিব্রাইল (আ) নেমে এসে মহানবীকে বলেন, আপনার প্রভু আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন ফাতিমাকে এটা বলতে যে তিনি (মহান আল্লাহ) ফাতিমার কাছে সালাম বা দরুদ পাঠিয়েছেন এবং বলেছেন, তোমার মা রয়েছেন (খাদিজা) রয়েছে কিংখাব বা বুটিদার রেশমি কাপড়ের এমন একটি ঘরে যার প্রান্ত বা দেয়ালগুলো সোনার নির্মিত ও খুঁটিগুলো চুনি বা রুবি পাথরের তৈরি। ঘরটি রয়েছে আসিয়া বিনতে মুজাহিম (জালিম ফেরাউনের মুমিন স্ত্রী) এবং মারিয়াম বিনতে ইমরানের তথা হযরত ইসার মায়ের ঘরের মাঝখানে।
ধৈর্যের প্রতিচ্ছবি হযরত ফাতিমা মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ সালাম তথা অনন্ত শান্তি এবং শান্তি তাঁর থেকে ও তাঁর প্রতি। ফাতিমা পরবর্তীকালে বাবার অনন্য সেবা যত্নের জন্য উপাধি পান উম্মে আবিহা বা বাবার মাতা! কিন্তু প্রায় ১২ বছর পর একদল প্রভাবশালী মুসলমান ফাতিমা ও আবু তালিবের পুত্র আলীকেও তাদের অধিকার লঙ্ঘন করে ব্যাপক কষ্ট দিয়েছিল বলে ইতিহাসের কোনো কোনো অংশে বর্ণনা রয়েছে। ফাতিমা ও আহলে বাইতকে কষ্ট দিলে আল্লাহ কষ্ট পান বলে মহানবীর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও অভিযোগ রয়েছে যে আলী ও ফাতিমাকে মানসিক ও শারীরিকভাবেও কষ্ট দেয়া হয়েছিল। অনেকেই মনে করেন খুব কম বয়সে বা অসময়ে ফাতিমার মৃত্যু রহস্যজনক মৃত্যু। অন্যদিকে হযরত আলীর (আ) ওপর তাঁর শাসনামলে বিদ্রোহী মুসলমানদের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল যুদ্ধের পর যুদ্ধ। এসবেরই পরিণতিতে কারবালায় নবী-পরিবারের ওপর ঘটেছিল নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। মহানবীর (সা) আহলে বাইতের অনুসারী ও অনুরাগীদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলে আসছে নির্যাতন এবং দমন-পীড়ন। কিন্তু মহানবীর (সা) আহলে বাইতের প্রতি জনগণের ভালবাসা ও শ্রদ্ধাকে স্তব্ধ করতে পারেনি মুনাফিক-চক্র ও ইসলামের শত্রুরা।
একদিন হযরত ইব্রাহিমের তথা আবুতালিবের তথা আলীর ও মহানবীর (সা) বংশধর হযরত ইমাম মাহদি (আ) পৃথিবীতে ঘটাবেন সব অবিচারের অবসান। আজকের এই দিনে মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তার উদ্দেশে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা। হযরত খাদিজার মৃত্যুতে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।
“ ...নর নহে,নারী ইসলাম 'পরে প্রথম আনে ঈমান. আম্মা খাদিজা জগতে সর্ব প্রথম মুসলমান। পুরুষের সব গৌরব ম্লান এক এই মহিমায়।” (নজরুল) #
পার্সটুডে/এমএএইচ/১৬