ইমাম হুসাইন (আ)'র জন্ম-বার্ষিকী ও ক'টি বিস্ময়কর ঘটনা
আজ পবিত্র শাবান মাসের তিন তারিখ- ইসলামের ইতিহাসের এক মহাখুশির দিন। কারণ, এই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন কারবালার মহা-বিপ্লবের মহানায়ক ও বেহেশতি যুবকদের দুই সর্দারের একজন তথা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)। বেহেশতি যুবকদের অন্য সর্দার হলেন হযরত ইমাম হাসান (আ.)।
মহানবী (সা.)বলেছেন: হাসান ও হুসাইন-দু'জনই মুসলমানদের ইমাম বা নেতা, তা তাঁরা (তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে) বিপ্লব করুক বা নাই করুক (কিংবা ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক)।
মহানবী আরও বলেছেন, যারাই হাসান ও হুসাইনকে ভালবাসে আমিও তাদের ভালবাসি, আর আমি যাদের ভালবাসি আল্লাহও তাদের ভালবাসেন, আর আল্লাহ যাদের ভালবাসেন তাদের বেহেশত দান করবেন এবং যারা হাসান ও হুসাইনের সঙ্গে শত্রুতা রাখে তাদেরকে আমিও আমার শত্রু মনে করি, ফলে আল্লাহও তাদের শত্রু হন, আর আল্লাহ তার শত্রুকে জাহান্নামে পাঠাবেন।
নিষ্পাপ ইমাম হযরত হুসাইন (আ.) বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের ধারায় তৃতীয় ইমাম হিসেবে পবিত্র ইসলামকে মহা-বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও শাহাদতের এক অনন্য দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে গৌরবময় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ মানবজাতির জন্য যুগে যুগে মুক্তি এবং কল্যাণের এক অফুরন্ত উৎস হয়ে আছে।
এই মহামানবের ১৪৩৩ তম জন্ম-বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা এবং বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে অশেষ দরুদ আর সালাম।
এই দিনটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী দিবস বা 'রুজে পসদর' হিসেবেও পালিত হয়।
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র পবিত্র কারবালা বিপ্লবের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত বরকত বা কল্যাণ অফুরন্ত। তাই ইমাম হুসাইন (আ.)’র কারামাত বা মু’জিজা তথা অলৌকিক ঘটনাগুলোও যেন অফুরন্ত। এখানে আমরা তাঁর বিস্ময়কর কারামতের কেবল তিনটি ঘটনা তুলে ধরব:
* হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র পবিত্র কবরের ওপর সর্বপ্রথম সৌধ বা মাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শহীদ মুখতার সাকাফি (র.)। সেই ৬১ হিজরি থেকেই ইমামের পবিত্র কবরের নানা কারামত প্রকাশিত হতে থাকে। ইমাম জাফর আস সাদিকের সাহাবি আলী ইবনে এসবাত একটি বইয়ে লিখেছেন, বহু নারী শহীদদের নেতার কবর জিয়ারত করতে যেতেন। এই মহান ইমামের শাহাদতের পর প্রথম বছরেই তাঁর পবিত্র কবর জিয়ারতের উসিলায় এক লাখ বন্ধ্যা নারী সন্তানহীনতা থেকে মুক্তি পান। ইমামের পবিত্র মাজারের সুবাদে এ জাতীয় কল্যাণের ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। (ইরানের জারান্দ শহরের জুমা নামাজে প্রদত্ত হুজ্জাতুল ইসলাম হাজ আগা আলী ইবরাহিমীর খুতবা থেকে)
* নেককার বা সৎকর্মশীল ব্যক্তির কবরের সম্মানে তার আশপাশের কবরবাসীর কবরের আজাব বন্ধ হয়ে যায় বলে ইসলামী বর্ণনা রয়েছে। হাজ মুহাম্মাদ আলী ইয়াজদি থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি একদিন স্বপ্নে দেখেছেন যে এক মাস আগে মৃত এক ব্যক্তি (শুল্ক বিভাগের কর্মী) খুব ভালো অবস্থায় আছেন। ফলে তার কাছে গিয়ে বললাম, আমি তো তোমার ভেতর-বাইরের সব খবর রাখি, তুমি তো সৎকর্মশীল ব্যক্তি নও। ওই ব্যক্তি ইয়াজদিকে বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন আমি মৃত্যুর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত কঠিন শাস্তি ভোগ করছিলাম। কিন্তু এর আগের দিন অধ্যাপক আশরাফ অহাঙ্গরাজের স্ত্রী মারা যান। তাকে এই কবরস্থানেই দাফন করা হয়। আমার কবর থেকে তার কবরের দূরত্ব ৫০ কদম বা ৫০ ফুট। গত রাতে স্বয়ং ইমাম হুসাইন (আ.) তিন বার তাঁকে দেখতে এসেছেন। তৃতীয়বারে তিনি বলেন, এই কবর থেকে আজাব সরিয়ে নাও। ফলে আমি আমি এখন খুবই প্রশান্তি ও নেয়ামতের মধ্যে রয়েছি।’ এ স্বপ্ন দেখার পর জনাব ইয়াজদি অধ্যাপক আশরাফ অহাঙ্গরাজের কাছে গিয়ে জানতে পারেন যে, ঠিকই মাত্র একদিন আগে তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন এবং তাঁকে ওই বিশেষ কবরস্থানের অমুক স্থানেই দাফন করা হয়েছে। তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)’র পবিত্র কবর জিয়ারত করেননি কখনও এবং এমনকি তাঁর জন্য শোক-প্রকাশের মজলিশের আয়োজনও করেননি, কিন্তু জীবনের শেষের দিকে সব সময় 'জিয়ারতে আশুরা' পাঠ করতেন বলে তাঁর স্বামী জানান। ( হামজা করিমখানির লিখিত ‘আসমানি জিকরসমূহ’ , পৃষ্ঠা-১৯৫)
*আজ হতে ১০০ বা তারও কিছু আগের বা পরের ঘটনা। ওসমানীয় শাসনামলে পবিত্র কারবালা শহরে হযরত ইমাম হুসাইন (আ)’র মাজার প্রাঙ্গণের পাশে পানি বিক্রেতা এক ব্যক্তি জানান, তিনি অতীতে সুগন্ধি মশলা জাতীয় জিনিসের ব্যবসা করতেন এই পবিত্র মাজার প্রাঙ্গণের কাছেই। একবার ইমামের কবরের আশপাশে খনন-কাজ চালানো হয় তার পবিত্র মাজারের সংস্কারের জন্য। এ সময় কিছু মাটি তিনি নিয়ে রাখেন এবং এই পবিত্র মাটি বিক্রি করতে থাকেন। প্রতি মিসকাল মাটি বিক্রি করতেন এক ওসমানী-লিরা মূল্যে। তার খ্যাতি বেড়ে যায় কারবালার পবিত্র মাজারের মাটি বা তুরবাত বিক্রেতা হিসেবে। নানা অঞ্চল থেকে এই পবিত্র মাটি কিনতে আসতো অনেকেই। ফলে তার অবস্থা রমরমে হয়ে পড়ে।
তিনি জানান, একদিন ইমামের পবিত্র মাজারের পাশে শুনছিলাম এক ভিক্ষুক চিৎকার করে বলছে, হে ইমাম হুসাইন! আমার অর্থ চুরি হয়ে গেছে! এ কী অবস্থা! এখন আমি কি করব! আমিও বললাম, হে ইমাম হুসাইন (আ)! এ তো সত্য কথাই বলছে! কেনো তার অবস্থা এমন হবে? কেনো চোরকে ধরিয়ে দিচ্ছেন না?
সে রাতেই স্বপ্নে দেখলাম শহীদদের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে। তিনি আমাকে বললেন, যদি চোরের পরিচয় তুলে ধরতে হয় তাহলে তো তুমিও একজন চোর। কারণ, তুমি আমার মাটি চুরি করছ ও চড়া দামে বাজারে বিক্রি করছ- এটা কি ঠিক? কার অনুমতি নিয়ে তুমি এই সম্পদ এইভাবে অর্জন করছ? এখন ভোর বেলায় ওই ভিক্ষুকের কাছে যাও এবং তাকে তার সিট বা বসার স্থান থেকে উঠাবে। ওই সিটের নীচে একটি পাথর আছে। ওই পাথর ওঠালেই সেখানে অনেক অর্থ-কড়ি বা মাল দেখতে পাবে যা চুরি করা হয়েছে জিয়ারতকারীদের কাছ থেকে। এসব সেখানে গোপন করে রাখা হয়েছিল। এসব মালিকদের কাছে দিয়ে দাও। এসবের মধ্যেই ওই ভিক্ষুকের অর্থও আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি স্বপ্নের বিষয়টি জিয়ারতকারীদের জুতা সংরক্ষণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জানাই। এরপর কয়েক ব্যক্তিকে নিয়ে সেই স্থানটিতে যাই এবং ভিক্ষুককে সরিয়ে পাথরটি তুলে ফেলি এবং পাথরের নীচে অনেক অর্থ-কড়ি ও মাল দেখতে পাই। সেসবই মালিকদের কাছে দিয়ে দিলাম। এরপর আমিও ঘোষণা করলাম যে, ইমাম হুসাইন (আ)’র পবিত্র কবর-সংলগ্ন মাটি বিক্রি বাবদ এ পর্যন্ত যত ব্যক্তির কাছ থেকে আমি যত অর্থ নিয়েছি সেসবই বা এর বিনিময়ে তারা সমান মূল্যের অন্য যে কোনো জিনিস যেন আমার কাছ থেকে ফেরত নেন। যারা খুব দূর দেশের লোক তাদের কাছে যেহেতু অর্থ ফেরত দেয়া সম্ভব হবে না, তাই আলেমদের পরামর্শক্রমে সেই অর্থের সমমূল্যের কিছু জিনিস বিক্রি করে তার অর্থ আল্লাহর রাস্তায় (রাদ্দে মাজলুম বা বঞ্চিতের নামে প্রতিদান হিসেবে) দান করে দেই। এরপর আমি এখানে পানি বিক্রির পেশায় নিয়োজিত হই।
মু. আমির হুসাইন /১০