তেসরা ও চৌঠা মহররমের ঘটনা-প্রবাহ
'ফতোয়া' ও হুমকির ফল: ইয়াজিদ বাহিনীতে ১৩ হাজার কুফাবাসীর যোগদান
১৩৮২ বছর আগে ৬১ হিজরির তৃতীয় ও চতুর্থ মহররম যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে সেসবের মধ্যে ৩ মহররম কারবালায় ইমাম হুসাইনের কাফেলার তাবু স্থাপন ও কুফার চার হাজার সেনা নিয়ে কারবালায় ওমর বিন সা'দ-এর প্রবেশ এবং কাজি শুরাইহ’ নামের এক দরবারি আলেমের পক্ষ থেকে ইমাম হুসাইনের রক্তপাতকে বৈধ বলে ফতোয়াদান ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
কুফায় নিযুক্ত ইয়াজিদের নরপিচাশ গভর্নর ইবনে জিয়াদ ‘কাজি শুরাইহ’ নামের এক দরবারি আলেম ও প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে নেয়া ফতোয়ার ভিত্তিতে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যার জন্য জনগণকে উস্কানি দিয়েছে।কুফার মসজিদে ইবনে জিয়াদ ওই ফতোয়া শুনিয়ে একদল মানুষকে ইমামের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। ইবনে জিয়াদ কুফার মসজিদে সমবেত জনগণকে এই বলে হুমকি দেয় যে, তাদেরকে হয় ইমাম হুসাইনের (আ) বিরুদ্ধে সেনা-সমাবেশ ঘটাতে হবে অথবা মৃত্যু-বরণ-- এ দু'য়ের যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে হবে! তারা যদি হুসাইন (আ)'র বিপক্ষে যুদ্ধ করে তবে তাদের পুরস্কার দেয়া হবে বলেও জিয়াদ ঘোষণা দেয়।
ইবনে জিয়াদের নির্দেশে তৈরি করা কাজি শুরাইহ'র ওই ফতোয়ায় বলা হয়েছিল হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের তথাকথিত খলিফা ও 'আমিরুল মুমিনিন' ইয়াজিদের আনুগত্য করেননি, তাই তাকে দমন করা তথা তার রক্তপাত ঘটানো মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব।
কুফার ১৩ হাজার বিভ্রান্ত মুসলমান ইমাম হুসাইন (আ.)’র বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ওমর সাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। এদের মধ্যে শিমার বিন জিল জুশান ছিল ওই ১৩ হাজার সেনার চার জন গ্রুপ-লিডারের অন্যতম। অথচ কুফাতে কিছুকাল আগে এমন সময়ও ছিল যখন ইমাম হুসাইন কুফায় এসেছেন শুনে হাজার হাজার মানুষ তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে ছুটে আসেন। কিন্তু পরে দেখেন যে ইবনে জিয়াদ ইমাম হুসাইনের জনপ্রিয়তা পরীক্ষা করতে ও ইমামপন্থীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে ওই গুজব রটায় ও নিজেই ইমাম হুসাইনের ভাব নিয়ে মুখ ঢেকে কুফার বাইরে থেকে কুফায় প্রবেশ করে! ফলে কুফায় ইমামপন্থীদের বেশিরভাগই ত্রাস ও আতঙ্কের শিকার হন।
ইমাম হুসাইন (আ.) তেসরা মহররম কারাবালায় তাবু স্থাপন করেন। আর ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ তার সেনাদের নিয়ে কারবালায় পৌঁছে। আগে নানা জায়গায় ইমামের কাফেলার তাবুগুলো কিছুটা উঁচু বা টিলার মত স্থানে বসানো হয়েছিল। কিন্তু এবার ইমাম (আ.) সমতল বা কিছুটা গর্তময় স্থানে তাবু বসানোর নির্দেশ দেন। সম্ভবত এর কারণ ছিল শিশু ও নারীরা যাতে যুদ্ধের দৃশ্য দেখে ভয় না পান।
হোর ইবনে ইয়াজিদ (রা.) নামের একজন সেনা কর্মকর্তা সর্ব প্রথম কারবালায় ইমাম শিবিরের বিপরীতে তাবু গাঁড়েন। তিনিই ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে প্রথম খবর দেন যে ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় এসেছেন। হোর প্রকৃতিগতভাবে ভালো মানুষ হওয়ায় ও ইমামের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা থাকায় আশুরার দিন ইয়াজিদ বাহিনী ত্যাগ করে কয়েকজন সঙ্গীসহ ইমাম শিবিরে যোগ দেন ও সবার আগে তিনি বীরের মত যুদ্ধ করে শহীদ হন। তিনি ইমামের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন, আমি ভাবতে পারিনি যে এরা আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করবে ও আপনাকে হত্যা করতে চায়! হোরের বাধার কারণেই ইমাম কুফার দিকে যেতে পারেননি -এই ভেবে হোর মহান আল্লাহর দরবারে ও ইমামের কাছে গভীর অনুতাপ প্রকাশ করেছিলেন। মহানুভব ইমামও তাঁকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন। হোর শহীদ হওয়ার সময় ইমাম তাঁকে বলেছিলেন: তোমার মা যেমনটি তোমার নাম রেখেছিলেন হোর বা মুক্ত তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে (তোমার মুক্তিকামী আচরণের মাধ্যমে) মুক্তই হলে!
ইমাম জানতেন কারবালায় কি ঘটতে যাচ্ছে। তিনি তেসরা মহররমই কারবালার জমি স্থানীয় নেইনাভাবাসীদের কাছ থেকে কিনে নেন। তিনি তাদের এ শর্ত দেন যে ভবিষ্যতে যারা এখানে নবীসা. পরিবারের সদস্যদের কবর জিয়ারত করতে আসবেন তাদের জন্য আপ্যায়ন করা হয় ও পথ দেখিয়ে দেয়া হয়।
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র নেতৃত্বে কারবালার মহাবিপ্লব খোদাদ্রোহী ও মুনাফিক চরিত্রের অধিকারী উমাইয়া শাসকদের স্বরূপ উন্মোচন করেছিল। ইসলামের নামে ধর্মান্ধতা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ চালু করেছিল ইয়াজিদি শাসক গোষ্ঠী। উমাইয়াদের রাজতান্ত্রিক ইসলামে বসেছিল দরবারি আলেমদের মেলা। লাখ লাখ জাল হাদিস প্রচার করে ইসলাম সম্পর্কে ধুম্রজাল ও বিভ্রান্তি জোরদার করা হয়েছিল সে সময়। ইসলামের খাঁটি নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা ও ভন্ড প্রকৃতির নেতাদের মাহাত্ম্য প্রচার করা ছিল তাদের স্বভাব।
উমাইয়া রাজশক্তি পক্ষ থেকে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর মহান সঙ্গীদেরকে ‘ইসলামী হুকুমাতের’ বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বলে প্রচার করা হয়েছিল। তাই ঐতিহাসিক বর্ণনায় দেখা গেছে, হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যার জন্য উদ্যত সেনাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল নামাজি। তারা বলছিল: তাড়াতাড়ি হুসাইনের মাথা কাট, নামাজ বা জামায়াতে নামাজ আদায়ের সময় পার হয়ে যাচ্ছে!
এরা একবারও হয়তো চিন্তা করেনি যে, রাসূল (সা.)’র আহলে বাইতের একজন মহান সদস্যকে তারা হত্যা করতে এসেছে! আর আহলে বাইত (আ.)’র ওপর দরুদ পেশ করা ছাড়া নামাজ আদায় হয় না।
উল্লেখ্য জাহেলি যুগেও আরব মুশরিক ও কাফিররা পবিত্র মহররম মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ করত না। কিন্তু উমাইয়া শাসনামলে মুসলমান নামধারী শাসকরা এতটাই হীন ও নীচ হয়ে পড়েছিল যে তারা রাসূলের(সা.) নাতি ও তাঁর পরিবারকে এই নিষিদ্ধ বা পবিত্র মাসেই নৃশংসভাবে শহীদ করতে কুণ্ঠিত হয়নি।
বাংলার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সে যুগের উমাইয়া শাসকদের প্রকৃতি তুলে ধরেছিলেন এভাবে:
ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ্।..তখতের লোভে এসেছে এজিদ কমবখতের বেশে !
এসেছে সীমার, এসেছে কুফা'র বিশ্বসঘাতকতা,ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা !
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ, ...কাঁদে আসমান জমিন, কাঁদিছে মোহররমের চাঁদ।
একদিকে মাতা ফাতেমার বীর দুলাল হোসেনী সেনা,আর দিকে যত তখত-বিলাসী লোভী এজিদের কেনা।..
এই ধুর্ত্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,আলী'র সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান !
এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায় হাসানে হোসেনে গালি দিতে যেত মক্কা ও মদিনায়।.. #
পার্সটুডে/মু.আ. হুসাইন/৪