সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-২৫)
শিশুদের সামাজিক হওয়ার কৌশল শেখানোর বিষয়ে গত পর্বের আলোচনার ধারাবাহিকতায় আজ আমরা শিশুদের সামাজিক হওয়ার ক্ষেত্রে স্কুল-পূর্ব শিশু-শিক্ষা কেন্দ্রের ভূমিকার ওপর আলোকপাত করব।
পরিবারের পরই শিশুদের সামাজিক করার ক্ষেত্রে স্কুল ও শিক্ষা-কেন্দ্রগুলোর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল স্কুল-পূর্ব শিশু-শিক্ষা কেন্দ্র বা নার্সারি স্কুল তথা প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেনগুলো মূলত ৩ থেকে ৬ বছর বয়স্ক শিশুদেরকে ভাষাসহ নানা বিষয় শেখানোর ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। এসব শিক্ষা কেন্দ্রে শিশুরা ছবি ও খেলাধুলার মাধ্যমে নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করছে। যেসব বাবা-মা'র উভয়ই চাকুরীজীবী বা নানা কারণে যেসব শিশুর মা সন্তানদের সময় দিতে পারেন না তাদের শিশুকে লালন-পালন ও নানা বিষয় শেখানোর ক্ষেত্রে এইসব শিক্ষাকেন্দ্র সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে বিশ্বের নারী সমাজের এক বড় অংশই শ্রমজীবী বা চাকুরীজীবী হয়ে পড়েছেন। আর এইসব মায়ের শিশুদের সামাজিক করতে গড়ে উঠেছে নার্সারি বা শিশু-শিক্ষা কেন্দ্র। দুঃখজনকভাবে গত কয়েক দশকে বহু মুসলিম পরিবারও নিজের প্রধান কাজ বা দায়িত্ব অর্পণ করেছে চাইল্ড কেয়ার সেন্টার বা স্কুল-পূর্ব শিশু-শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর ওপর। কিন্তু তারা ভুলে গেছেন যে কেবল এইসব কেন্দ্র শিশুর সব চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। আর এইসব শিক্ষা কেন্দ্রে শিশুদের কখন পাঠাতে হবে তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার বিষয়। অন্যদিকে এইসব সেন্টারও কেমন হওয়া উচিত-তা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
গবেষণায় দেখা গেছে শিশুরা তিন বছর বয়স থেকে সামাজিক হওয়ার অনুভূতি অর্জন করতে থাকে। আর ছয় বছর বয়সে তা পরিপক্ব পর্যায়ে পৌঁছে। তাই এ সময় থেকেই শিশুদের নানা বিষয়ে শিক্ষা দান তাদের পরবর্তী শিক্ষা-জীবনের জন্য খুব সহায়ক হয়ে থাকে। তবে এ সময় যদি শিশুরা পারিবারিক পরিবেশে মায়ের কাছে থাকে সেটাই তাদের জন্য সর্বোত্তম। কারণ পারিবারিক পরিবেশে ও মায়ের কাছেই শিশুরা সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা অনুভব করে ও স্নেহের যে বন্ধন তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাও সে মায়ের কাছেই সর্বোচ্চ মাত্রায় পায়। কিন্তু কোনো মা যদি নানা কারণে তার শিশুর কাছে থাকতে না পারেন বা শিশুকে ঘরে রাখতে না পারেন তাহলে দুই বছর বয়স হওয়ার পর তাকে স্কুল-পূর্ব শিশু-শিক্ষা কেন্দ্রে পাঠাতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে দেখতে হবে যে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন্ প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেন আপনার শিশুর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী।
প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেন শিশুদের নানা বিষয় শেখানোর জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে সক্ষম। এক্ষেত্রে পরিবারের পরই তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এ ধরনের কেন্দ্রে যাওয়ার কারণে অন্য সাধারণ শিশুর চেয়ে এই শিশুরা বেশি সামাজিক হওয়ার সুযোগ পায়। এমন অনেক আচার-আচরণ শিশুরা এসব প্রতিষ্ঠানে শিখতে পারে যা তারা পরিবারে শিখতে পারেনি। নেতিবাচক নানা আচরণ ও সামাজিক দিক থেকে পছন্দনীয় নয় এমন অনেক আচরণ এইসব প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেনের প্রশিক্ষণের কারণে শিশুর মধ্যে তেমন একটা আর দেখা যায় না। এইসব সেন্টার সামাজিকতার বিষয়ে শিশুদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানায় এবং এসব জ্ঞান বা ধারণার প্রভাবে শিশুরা অনেক নেতিবাচক অভ্যাস সহজেই ত্যাগ করে।
প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেনগুলো শিশুদের ভাষা বা কথা শেখানোর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেসব শিশু এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে যায়নি তাদের তুলনায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ পাওয়া শিশুরা অনেক বেশি শব্দ শিখতে পারে বলে গবেষণায় দেখা গেছে। এ ছাড়াও তারা এমন প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে অন্য শিশুদের তুলনায় সহজেই অন্য শিশুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম ও সহজেই বেশি মাত্রায় মিশতে পারে। তাই যেসব প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে উন্নত মানের ও স্বাস্থ্য-বিধিমালা খুব ভালোভাবে মেনে চলে সেসব প্রতিষ্ঠান শিশুর নানা প্রতিভা বিকাশ ও মানসিক বিকাশের জন্য খুবই কার্যকর। তবে প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেন যদি স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও শিক্ষা বিষয়ে উন্নত মানের না হয় তাহলে তা শিশুদের জন্য ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
উন্নত প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেন মানে শিশুকে কেবল খাবার যোগানো ও কিছু খেলায় মাতিয়ে রাখা নয়। বরং শিশুকে এমনভাবে নানা বিষয় শেখাবে যে শিশু হয়ে উঠবে আত্ম-বিশ্বাসী। এখানে আপনার শিশু যাতে নিজের সম্পর্কে সুধারণা অর্জন করে সেভাবে তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। নানা পরিবেশ ও চ্যালেঞ্জের মুখেও কিভাবে শিশু নিজেকে গুছিয়ে ও মানিয়ে নিতে পারে তা শেখানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার এসব প্রতিষ্ঠানে। শৃঙ্খলা ও ধৈর্য শেখানো, কোনো কিছু প্রাপ্তির লাইনে পালাক্রম মেনে চলা, সামষ্টিক কাজে শরিক হওয়া ও অন্যদের কথা শোনা-এসবই শেখায় একটি ভালো প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেন। স্কুল-জীবনে এসব খুবই কাজে লাগে বলে আগেই সেসব শিখে রাখা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মূলত নানা ধরনের খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদেরকে এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে একটি ভালো প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেন। কারণ শিশুদেরকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত মূলত খেলাধুলার মাধ্যমেই সব কিছু শেখাতে হয়। এইসব খেলাধুলা তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে ভূমিকা রাখে। সাত বছর বয়সের আগে কোনো কিছু সরাসরি শিশুদের শেখাতে গেলে তা তাদের জন্য উপযুক্ত মাধ্যম হয় না। আর এতে শিশুদের সৃষ্টিশীলতার বিকাশও ক্ষুণ্ণ হয়। প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষণ কর্মসূচী এমন হওয়া উচিত যাতে শিশুরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
একটি ভালো প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেনের প্রশিক্ষকদের হতে হবে শিশুর মায়েদের মত স্নেহশীল বা বিকল্প মাতা যাতে তাদের কাছে শিশুরা নিরাপত্তা, প্রশান্তি ও মাতৃসুলভ স্নেহ পায়। বয়স্ক ব্যক্তিদের মত শিশুরাও হয়ে থাকে নানা প্রকৃতির। তাদের আচার-আচরণে ও মানসিকতায় ভিন্নতা থাকে। তাই একটি ভালো প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেনকে শিশুদের সঠিক আচরণগুলো শেখানোর মত উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হয় যাতে শিশুরা সামাজিক, মানসিক ও শারীরিক সব ক্ষেত্রেই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে। তাই সন্তানকে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর আগে দেখতে হবে যে এর শিক্ষকরা মায়ের বিকল্প হতে সক্ষম কিনা।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে হতে হবে সব সময় শিশুর সঙ্গী। শিশুদের সঙ্গে নিয়ে নানা কর্মসূচী প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের যোগ্যতা তার থাকতে হবে। তিনি শিশুদেরকে এমনভাবে শেখাবেন যাতে শিশু নিজেই তার দায়িত্ব আবিষ্কার করতে পারে ও উপায়-উপকরণও নিজেই খুঁজে নিতে পারে। যেসব প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেন শিশুর দেহ ছাড়াও তার মানসিক বিকাশেও যত্নশীল সেসব প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি করাতে হবে আপনার শিশুকে। শিশুর ঘুম, খাবার-দাবার, বিশ্রাম, খেলাধুলা ও বয়স অনুপাতে নানা কর্মসূচি, নিরাপদ পরিবেশ-ইত্যাদি রয়েছে কিনা এসবও আগেই জেনে নিতে হবে বাবা মা বা অভিভাবককে।
প্রি-স্কুল কিন্ডারগার্টেনের কর্মকর্তাদের উচিত বাবা-মা এবং অভিভাবকদের সঙ্গে এমন সম্পর্ক বা যোগাযোগ রাখা যাতে তারা এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাশীল হন। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের উচিত পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেন ও শরিকানা জাতীয় সম্পর্ক গড়ে তোলা। শিশু সম্পর্কে বিস্তারিত ও ভালোভাবে জানতে হলে কিন্ডারগার্টেনকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে এবং এরই আলোকে শিশুর শিক্ষণ ও অন্যান্য চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের যোগাযোগের ফলে প্রতিষ্ঠান বুঝতে পারবে যে অভিভাবকরা সন্তানের জন্য কি কি চান বা তাদের কি কি শেখাতে চান।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।