আসমাউল হুসনা (পর্ব-৫০)
দয়াময় আল্লাহর আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হ'ল শাহিদ। এ নামের অর্থ হাজির ও নাজির তথা উপস্থিত ও পর্যবেক্ষণকারী এবং সাক্ষ্য দাতা বা সাক্ষী।
পবিত্র কুরআনে এই শব্দ ১৯ বার এসেছে। মহান আল্লাহর প্রত্যেক নামই তাঁর নানা পূর্ণতার এক একটি দিক মাত্র। আর আল্লাহ নামটি এসব নামেরই সম্মিলিত প্রকাশ। এসবের কোনো কোনোটিকে আল্লাহর পবিত্র নামগুলো নিয়ে গঠিত বৃক্ষের কাণ্ড ও কোনো কোনোটিকে শাখা ও কোনো কোনোটিকে প্রশাখা ধরা যায়। যেমন, আলিম নামকে যদি আসমায়ে ইলাহি নামক বৃক্ষের অন্যতম প্রধান শাখা ধরা হয় তাহলে তাঁরই প্রশাখা হচ্ছে হাকিম, খাবির ও শাহিদ। অন্য কথায় আলিম নামের প্রভাব হাকিম, খাবির ও শাহিদ-এর চেয়ে বেশি। অন্যদিকে এই একই বৃক্ষের মূল কাণ্ডের অংশ ক্বাইয়ুম-এর প্রভাব আলিম-এর চেয়েও বেশি বা এই নাম আরও উচ্চ পর্যায়ের নাম। আর এভাবে মহান আল্লাহর নামগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে আল্লাহ শীর্ষক নাম। মহান আল্লাহর শাহিদ নাম বিশ্ব জগতে মহান আল্লাহর উপস্থিতি ও জ্ঞানগত কর্তৃত্বের প্রতীক।
সুরা মুজাদিলার ৬ নম্বর আয়াতে এই শাহিদ নাম ব্যবহার করে মহান আল্লাহ বলেছেন: সেদিন স্মরণীয়; যেদিন আল্লাহ পুনরুত্থিত করবেন তাদেরকে, অতঃপর তাদেরকে জানিয়ে দিবেন যা তারা করত। আল্লাহ তার হিসাব রেখেছেন, আর তারা তা ভুলে গেছে। আল্লাহর সামনে উপস্থিত আছে সব কিছুই। -
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনু-পরমাণু বা তার থেকেও ক্ষুদ্র যে কোনো কিছু ও বিশাল আকৃতির বস্তু সবই মহান আল্লাহ দেখেন। ছায়াপথ, সৌর জগত, গ্রহ-নক্ষত্র, বিষুব রেখা, মেঘমালার তৎপরতা- এসবই দেখছেন তিনি। সব কিছুর সব অবস্থাই দেখছেন তিনি। মানুষের হাসি-কান্না, দুঃখ-শোক, কুফরি ও কৃতজ্ঞতা, একনিষ্ঠতা ও কপটতা এবং ভেতর ও বাইরের অবস্থা এসবও গোপন নেই আল্লাহর কাছে। মোট কথা মহান আল্লাহ'র দৃষ্টির বাইরে কোনো কিছুই নেই। সুরা ইউনুসের ৬১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ মহানবীকে (সা) সম্বোধন করে বলছেন: বস্তুত: যে কোন অবস্থাতেই তুমি থাক এবং কোরআনের যে কোন অংশ থেকেই পাঠ করা কিংবা যে কোন কাজই তোমরা কর অথচ আমি তোমাদের নিকটে উপস্থিত থাকি যখন তোমরা তাতে আত্ননিয়োগ কর।
আদালতে কোনো কিছু বিচারকের কাছে প্রমাণ করতে হলে সাক্ষ্য দিতে হয় ও প্রমাণ করতে হয় যে ঘটনাস্থলে উপস্থিতি থেকে অমুক সময়ে অমুককে অমুক কাজ করতে দেখেছে সাক্ষী। অথচ আল্লাহ কেবল ঘটনা ঘটার স্থান ও সময়েরই সাক্ষী নন তিনি মনের ইচ্ছাগুলোরও খবর রাখেন। সাধারণ মানুষ অনেক সময় বাহ্যিক বেশভূষা দেখে কাউকে ধার্মিক মনে করতে পারে, কিন্তু সে প্রকৃতই ধার্মিক কিনা তা কেবল মহান আল্লাহই জানেন। মুমিন ব্যক্তি আল্লাহকে হাজির নাজির জানেন বলেই সব সময়ই সংযত থাকেন কথা ও কাজে। মহান আল্লাহর সাক্ষ্য বা দর্শনের কথা মনে রেখে ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর ফেরেশতাদের সাক্ষ্যের কথা মনে রেখে মুমিন বিচ্যুত চিন্তারও ধারে কাছে যান না। নবী-রাসুলরাও নিজ নিজ জাতি বা উম্মতের মানুষের তৎপরতার বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন বা সাক্ষী হবেন। আর স্বয়ং মহানবী (সা) হবেন সব নবী-রাসুলের জন্য সাক্ষী। সুরা নাহলের ৮৯ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন:
সেদিন প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে আমি একজন বর্ণনাকারী দাঁড় করাব তাদের বিপক্ষে তাদের মধ্য থেকেই এবং তাদের বিষয়ে আপনাকে সাক্ষী স্বরূপ উপস্থাপন করব। ...
কিয়ামতের দিন বা বিচার দিবসে জমিন ও সময়ও সাক্ষীর কাজ করবে। সুরা জিলজালের ৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: কিয়ামতের দিন জমিন তার খবরগুলো বিস্তারিতভাবে বলবে। ইমাম বাক্বির (আ) থেকে বর্ণিত: তিনি সময়ের সাক্ষ্য সম্পর্কে বলেছেন: প্রতিটি দিনই মানুষকে বলে: হে আদম সন্তান! আমি একটি নতুন দিন। আমি তোমার বিষয়ে সাক্ষ্য দেব। আমার মধ্যে ভালো কাজ কর যাতে কিয়ামতের দিন তোমার পক্ষের সাক্ষী হতে পারি।
মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও কিয়ামত বা বিচার দিবসে তাদের কাজকর্মের বিষয়ে সাক্ষ্য দিবে। যেমন, মুখ ও হাত পা সাক্ষী হবে সেদিন। এমনকি চোখ, কান ও গায়ের চামড়াও বিচার দিবসে মানুষের কাজকর্মের সাক্ষী হবে। কোনো কোনো পাপী সেদিন নিজের চামড়াগুলোকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে দেখে লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বলবে: কেন আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছ? জবাবে ত্বকগুলো বলবে : যে আল্লাহ সব কিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন। (সুরা ফুসিলাত-২১ নম্বর আয়াত)
যারা আল্লাহর পথে জীবন দান করেন তাদেরকেও শহীদ বা শাহিদ বলা হয়। শহীদদের বেহেশতে অবস্থানের সাক্ষী হবেন আল্লাহ ও ফেরেশতাকুল এবং আর শহীদরা সাক্ষ্য হবেন বেহেশতের অশেষ নেয়ামত ও খোদা-প্রদত্ত সম্মানের। শহীদ হলে তাঁর ও আল্লাহর মধ্যে পর্দা দূর হয়ে যায়। সুরা আলে ইমরানের ১৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনও মৃত ভেবো না, বরং তারা জীবিত ও আল্লাহর পক্ষ থেকে তারা রিজিক পান।
পবিত্র কুরআনের প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা মুহাম্মাদ হুসাইন তাবাতাবায়ি শহীদদের মর্যাদা প্রসঙ্গে তাফসির আল মিযান নামক বইয়ে লিখেছেন: শাহাদাত এমন এক কুরআনি বাস্তবতা যার অর্থগুলো অনেক ব্যাপক। আমাদের সাধারণ অনুভূতি বা অনুভবের মাধ্যমগুলো কেবল শহীদদের মুখ ও কাজের বাহ্যিক দিকগুলোই বুঝতে পারে। কিন্তু শহীদরা কুফ্র ও ইমান, সৌভাগ্য ও লাঞ্ছনা, ভালো ও মন্দ, সৌন্দর্য ও কদর্যতার মত বাস্তবতাগুলো এবং যা কিছু গোপন অনুভূতি ও মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরের সেসবই সরাসরি দেখতে পারেন, সেসব সম্পর্কে জানতে পারেন ও সেসবের কাছেও উপস্থিত হতে পারেন।
আশুরার দিন ইমাম হুসাইন (আ) যখন তাঁর ছয় মাসের শিশু পুত্র আলী আসগরকে শেষ বারের মত দেখতে চাইলেন ও তাঁর কাছ থেকে শেষ বারের মত বিদায় নিতে চাইলেন এবং তাঁকে চুমো দিতে চাইলেন তখন ইয়াজিদ বাহিনীর হারমালা নামক এক পাষণ্ড তিন শাখাযুক্ত একটি তির নিক্ষেপ করে ওই শিশুকে শহীদ করে। ইমাম শিশু আলী আসগরের গলার তিরবিদ্ধ অংশে হাত দিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে তা আকাশের দিকে নিক্ষেপ করে বলেছিলেন: যেহেতু আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনার সাক্ষ্য বা শাহীদ যা কিছু কষ্ট বা বিপদ-মুসিবত আমার হয়েছে তা আমার জন্য সহজ।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।