সূরা মুহাম্মাদ : আয়াত ১-৩ (পর্ব-১)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা মুহাম্মাদের ১ম পর্ব নিয়ে আলোচনা। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাম অনুসারে নাজিল হওয়া এই সূরায় মুমিন ও কাফিরদের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। অপরকে সিরাতুল মুস্তাকিমের দিকে দাওয়াত করা ঈমানদারদের দায়িত্ব। কিন্তু কাউকে বলপূর্বক ঈমান আনতে বাধ্য করা যাবে না। আজ আমরা এই সূরার ১ থেকে ৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِیم
الَّذِینَ کَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِیلِ اللَّهِ أَضَلَّ أَعْمَالَهُمْ ﴿١﴾ وَالَّذِینَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَآمَنُوا بِمَا نُزِّلَ عَلَى مُحَمَّدٍ وَهُوَ الْحَقُّ مِنْ رَبِّهِمْ کَفَّرَ عَنْهُمْ سَیِّئَاتِهِمْ وَأَصْلَحَ بَالَهُمْ ﴿٢﴾ ذَلِکَ بِأَنَّ الَّذِینَ کَفَرُوا اتَّبَعُوا الْبَاطِلَ وَأَنَّ الَّذِینَ آمَنُوا اتَّبَعُوا الْحَقَّ مِنْ رَبِّهِمْ کَذَلِکَ یَضْرِبُ اللَّهُ لِلنَّاسِ أَمْثَالَهُمْ ﴿٣﴾
“বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম।"
“যারা কুফরী করেছে এবং [অন্যকে] আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত করেছে [আল্লাহ] তাদের আমলসমূহ ব্যর্থ করে দিয়েছেন।” (৪৭:১)
“আর যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে এবং মুহাম্মাদের প্রতি যা নাযিল হয়েছে তাতে ঈমান এনেছে, আর তা-ই তাদের রবের পক্ষ হতে প্রেরিত সত্য, [আল্লাহ] তাদের মন্দ কাজগুলো ঢেকে দিয়েছেন এবং তাদের অবস্থা সংশোধন করে দিয়েছেন।” (৪৭:২)
“এটা এজন্যে যে, যারা কুফরী করেছে তারা বাতিলের অনুসরণ করেছে এবং যারা ঈমান এনেছে তারা তাদের রবের প্রেরিত সত্যের অনুসরণ করেছে। এভাবে আল্লাহ মানুষের জন্য তাদের অবস্থার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন।” (৪৭:৩)
কাফির ও মুশরিক অধিপতিরা নিজেদের কায়েমি স্বার্থ ধরে রাখার জন্য সব সময় নিজেদের দল ভারী করার চেষ্টা করে। তারা ছলে-বলে-কৌশলে, প্রয়োজনে দরিদ্র মানুষকে দান করে এবং জনসেবামূলক তৎপরতা চালিয়ে অপরকে কুফর ও শিরকের দিকে টানার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য অপবিত্র বলে আল্লাহ তায়ালা তাদের এই সৎকর্মসমূহ কবুল করবেন না। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি শুধুমাত্র সুনাম অর্জনের লক্ষ্যে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে সেবা প্রদান করে তাতে অসুস্থ মানুষ উপকৃত হলেও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাকারী ব্যক্তি আল্লাহর কাছ থেকে কোনো পুরস্কার পাবে না।
পক্ষান্তরে যারা সত্য উপলব্ধি করে তার প্রতি ঈমান আনে এবং সত্য আনয়নকারী রাসূলের প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করে এই আয়াতে তাদের সৎকর্মগুলো আল্লাহ কবুল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি নিজের অনুগ্রহে এসব মানুষের গোনাহ ক্ষমা করে দেন এবং তাদের জীবনের কাজগুলো সংশোধন ও সহজ করে দেন। পরের আয়াতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: হক ও বাতিলের পার্থক্যের ভিত্তিতে কুফর ও ঈমানের পার্থক্য নির্ধারিত হয়। একদল সত্য উপলব্ধি করে তা অনুসরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু অপর দল সত্যকে চেনার পরও তার আনুগত্য করে না বরং তার বিরোধিতায় দাঁড়িয়ে যায়। পৃথিবীর সব মানুষ এই দুই দলের যেকোনো একটির অন্তর্গত; সত্য গ্রহণকারী অথবা সত্য বিদ্বেষী।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- ইসলামের শত্রুরা এই ধর্মের মোকাবিলা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং ইসলাম দিন দিন আরো শক্তিশালী হয়।
২- শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান যথেষ্ট নয় বরং যে রাসূলের মাধ্যমে আমাদের কাছে দ্বীনি শিক্ষা এসেছে তাঁর প্রতি ঈমান আনাও অপরিহার্য কর্তব্য। এছাড়া, ঈমানের পাশাপাশি নেক আমল বা সৎকাজও করতে হবে।
৩- আমরা যদি আমাদের সাধ্য অনুযায়ী সৎকাজ ও নেক আমল করার চেষ্টা করি তাহলে আল্লাহ তায়ালা আমাদের ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করবেন এবং আমাদের কাজগুলোকে সংশোধন ও সহজ করে দেবেন।
৪- প্রতিটি মানুষের ভালো বা খারাপ পরিণতি তার কৃতকর্মের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ সত্য নাকি বাতিলের অনুসারী তার মাধ্যমেই তার পরিণতি নির্ধারিত হয়।
সূরা মুহাম্মাদের ৪ থেকে ৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَإِذا لَقِیتُمُ الَّذِینَ کَفَرُوا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتَّى إِذَا أَثْخَنْتُمُوهُمْ فَشُدُّوا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاءً حَتَّى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ذَلِکَ وَلَوْ یَشَاءُ اللَّهُ لانْتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَکِنْ لِیَبْلُوَ بَعْضَکُمْ بِبَعْضٍ وَالَّذِینَ قُتِلُوا فِی سَبِیلِ اللَّهِ فَلَنْ یُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ ﴿٤﴾ سَیَهْدِیهِمْ وَیُصْلِحُ بَالَهُمْ ﴿٥﴾ وَیُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ عَرَّفَهَا لَهُمْ ﴿٦﴾
“অতএব যখন তোমরা [জিহাদের ময়দানে] কাফিরদের মুকাবিলা কর তখন তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করার আগ পর্যন্ত তাদের ঘাড়ে আঘাত করতে থাকো। অবশেষে যখন [তারা তোমাদের হাতে বন্দি হয়] তখন তাদেরকে মজবুতভাবে বাঁধ [যাতে তারা পালাতে না পারে]; তারপর হয় তাদের প্রতি অনুকম্পা করো [ও তাদেরকে মুক্তি দাও], নয়তো মুক্তিপণ আদায় করো; যতক্ষণ না যুদ্ধ তার ভার (বা অস্ত্র) নামিয়ে না ফেলে। এরূপই [আল্লাহর নির্দেশ], আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে [প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিয়ে] তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি [জিহাদের নির্দেশ এজন্য দিয়েছেন যে তিনি] চান তোমাদের কিছুকে অন্যের দ্বারা পরীক্ষা করতে। আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় আল্লাহ কখনো তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট হতে দেন না।” (৪৭:৪)
“অচিরেই তিনি তাদেরকে [সুউচ্চ মাকামের দিকে] পথনির্দেশ করবেন এবং তাদের অবস্থা ভাল করে দেবেন।” (৪৭:৫)
“আর তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পরিচয় তিনি তাদেরকে জানিয়েছিলেন।”(৪৭:৬)
আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় কাফিরদের ছল, বল ও কৌশলের যে কথা বলা হয়েছিল তার একটি হচ্ছে মুমিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে সুস্পষ্ট ও কঠোরভাবে বলে দিচ্ছেন: জিহাদের ময়দানে তোমরা বজ্রমূর্তি ধারণ করো, বীরবিক্রমে যুদ্ধ করো ও শত্রুদের সম্পূর্ণরূপে পর্যদুস্ত করো। তবে তাদের কেউ যদি আত্মসমর্পন করে তবে তাকে হত্যা করো না বরং তাকে বন্দি করে ফেলো।
যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর হয় বন্দিদের প্রতি দয়া দেখিয়ে তাদেরকে কোনো বিনিময় ছাড়া মুক্ত করে দাও অথবা মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দাও। শত্রুর মোকাবিলায় তোমাদের এমন কৌশলি হতে হবে যাতে তারা সম্পূর্ণভাবে অক্ষম ও হীনবল হয়ে যায়। শত্রুর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার আগ পর্যন্ত এভাবে জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে।
স্বাভাবিকভাবেই এরকম যুদ্ধে শত্রুর হাতে মুমিন ব্যক্তিদের একাংশ নিহত হবেন। যদি তারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়ে থাকেন তবে আল্লাহ তাদের প্রাণ কিনে নেন ও কিয়ামত দিবসে তার বিনিময় প্রদান করেন। কিন্তু যারা বাতিলের রাস্তায় নিহত হয় তাদের প্রাণ বিসর্জন বৃথা যায় এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- যেসব কাফির মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে না তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ করতে হবে। অন্যদিকে যারা যুদ্ধ ঘোষণা করবে তাদের প্রতি আচরণ হবে বজ্রকঠিন।
২- জিহাদের ময়দানে শত্রুর প্রতি বিন্দুমাত্র অনুকম্পা প্রদর্শন করা যাবে না কিন্তু যুদ্ধ শেষে বন্দিদের হত্যা করা নিষেধ।
৩- যুদ্ধ বা জিহাদ হচ্ছে মুমিনদের পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহর একটি মাধ্যম। কে জিহাদে যায় আর কে জিহাদের ময়দান থেকে পালায় তা আল্লাহ দেখতে চান।
৪- যারা জিহাদে শহীদ হন বাহ্যিকভাবে তারা ব্যর্থ হয়ে যান। কিন্তু তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সঙ্গে বাণিজ্য করেছেন। তাদের কৃতকর্ম আল্লাহ কখনোই ব্যর্থ করেন না বরং তিনি তাদেরকে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে অর্থাৎ জান্নাতে পৌঁছে দেন। কাজেই শহীদগণই হচ্ছেন জিহাদের ময়দানের প্রকৃত বিজয়ী।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।