ডিসেম্বর ০৪, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা মুহাম্মাদের ৩য় পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ১৫ থেকে ১৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِی وُعِدَ الْمُتَّقُونَ فِیهَا أَنْهَارٌ مِنْ مَاءٍ غَیْرِ آسِنٍ وَأَنْهَارٌ مِنْ لَبَنٍ لَمْ یَتَغَیَّرْ طَعْمُهُ وَأَنْهَارٌ مِنْ خَمْرٍ لَذَّةٍ لِلشَّارِبِینَ وَأَنْهَارٌ مِنْ عَسَلٍ مُصَفًّى وَلَهُمْ فِیهَا مِنْ کُلِّ الثَّمَرَاتِ وَمَغْفِرَةٌ مِنْ رَبِّهِمْ کَمَنْ هُوَ خَالِدٌ فِی النَّارِ وَسُقُوا مَاءً حَمِیمًا فَقَطَّعَ أَمْعَاءَهُمْ ﴿١٥﴾

“মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত এরকম: তাতে আছে নির্মল পানির নদীমালা [যার রং ও স্বাদ অপরিবর্তিত থাকে], আছে দুধের নদীমালা যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, আছে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু শরাবের নদীমালা, আছে পরিশোধিত মধুর নদীমালা এবং সেখানে তাদের জন্য [প্রস্তুত] থাকবে প্রত্যেক প্রকারের ফলমূল। আর [সবার ঊর্ধ্বে থাকবে] তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা।  [এরা অর্থাৎ মুত্তাকীরা] কি তাদের সমান যারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে এবং যাদেরকে পান করানো হবে ফুটন্ত পানি; ফলে তা নাড়ীভুঁড়ি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেবে?” (৪৭:১৫)

আগের কয়েকটি আয়াতে ঈমানদার ও কাফির ব্যক্তিদের পরিণতি সম্পর্কে তুলনা করা হয়েছে। এরপর এই আয়াতে পরকালে এই দুই শ্রেণির মানুষের অবস্থান বর্ণনা করা হচ্ছে। পার্থিব জীবনে মানুষের অন্যতম শারিরীক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের তৃষ্ণা পায়। এই বৈশিষ্ট্য পরকালেও অক্ষুণ্ন থাকবে এবং তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পানির প্রয়োজন হবে। আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে বলছেন, মুমিন ব্যক্তিদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য জান্নাতে নানা রকম পানীয়র ব্যবস্থা রেখেছেন। পানি থেকে শুরু করে দুধ, শরাব ও মধুর শরবত সেখানে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু জাহান্নামবাসীর কপালে ফুটন্ত পানি ছাড়া কিছুই জুটবে না। আর এ পানি তাদের নাড়ীভুড়ি ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে পেট থেকে বের করে দেবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য ও ভোগসম্ভার যেন আমাদেরকে গুনাহের দিকে টেনে না নেয়। গুনাহ থেকে মুক্ত থাকতে পারলে আল্লাহ তায়ালা পরকালে জান্নাতবাসীর জন্য সীমাহীন ভোগ্যবস্তু ও বিনোদনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

২- যারা নিষিদ্ধ ইন্দ্রীয়পরায়ণতা থেকে নিজেদেরকে পবিত্র রাখতে পারবে তারাই জান্নাতের চিরস্থায়ী ভোগসম্ভার উপভোগ করতে পারবে।

৩- অসংখ্য ভোগ্যবস্তুর পাশাপাশি মহান আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত জান্নাতবাসীকে চূড়ান্ত মানসিক প্রশান্তি দান করবে।

সূরা মুহাম্মাদের ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 وَمِنْهُمْ مَنْ یَسْتَمِعُ إِلَیْکَ حَتَّى إِذَا خَرَجُوا مِنْ عِنْدِکَ قَالُوا لِلَّذِینَ أُوتُوا الْعِلْمَ مَاذَا قَالَ آنِفًا أُولَئِکَ الَّذِینَ طَبَعَ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ ﴿١٦﴾

“আর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক [সবার সামনে] আপনার [কথা] মনোযোগ দিয়ে শোনে, অবশেষে আপনার কাছ থেকে বের হয়ে যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত তাদেরকে [ঠাট্টার ছলে] বলে, এইমাত্র সে কী বলল? এরাই তারা, যাদের অন্তরসমূহে আল্লাহ্‌ মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তারা অনুসরণ করেছে নিজেদের খেয়াল-খুশীর।” (৪৭:১৬)

এই আয়াতে রাসূলের যুগের দুর্বল ঈমানের অধিকারী ও অস্থিরচিত্ত মানুষদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে, রাসূলের বক্তব্য এবং ঐশী বাণীর প্রতি তাদের বিশ্বাস ছিল না। বিশ্বনবী (সা.)-এর মুখ থেকে তারা আল্লাহ পাকের কালাম শুনত আর বলত: এর কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তারা বুৎপত্তিসম্পন্ন ও দুরদর্শী মুমিনদের দেখতে পেলে ঠাট্টাচ্ছলে বলত: তোমরা কি রাসূলের বাণী বুঝতে পেরেছ? আমরা তো কিছুই বুঝলাম না!

এই আয়াতে এ ধরনের মুনাফিকদের নিন্দা জানিয়ে বলা হচ্ছে: রাসূলের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট ও বোধগম্য। কিন্তু তোমরা যেহেতু নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করছ এবং সত্য মেনে নিতে নারাজ তাই মহাসত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছ। রাসূলের পক্ষ থেকে আল্লাহর বাণী উপস্থাপনে কোনো সমস্যা নেই বরং তোমরাই তা গ্রহণ করছ না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- খেয়াল-খুশির অনুসরণ ও মনের অবৈধ কামনা-বাসনার কাছে আত্মসমর্পন করলে মানুষের পক্ষে মিথ্যা থেকে সত্য আলাদা করা কঠিন হয়ে যায়।

২- যারা বিশ্বনবী (সা.)-এর বক্তব্য ও ঐশী বাণী সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করে মানুষের ঈমান দুর্বল করতে চায় তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে।

৩- আল্লাহ পাকের কালাম পড়া ও শোনাই যথেষ্ট নয় বরং এর শিক্ষা ও মর্মার্থ গভীরভাবে উপলব্ধি করা জরুরি। সেইসঙ্গে এই বাণী পরিপূর্ণভাবে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র মুখে আল্লাহর কালাম শুনে বহু মানুষ তাঁর প্রতি ঈমান আনতে পারেনি।

সূরা মুহাম্মাদের ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 وَالَّذِینَ اهْتَدَوْا زَادَهُمْ هُدًى وَآتَاهُمْ تَقْوَاهُمْ ﴿١٧﴾

“আর যারা হিদায়াত প্রাপ্ত হয়েছে [আল্লাহ] তাদের হিদায়াত বৃদ্ধি করেন এবং তাদেরকে খোদাভীতি ও তাকওয়া প্রদান করেন।”(৪৭:১৭)

এই আয়াতে বলা হচ্ছে, যারা রাসূলের পক্ষ থেকে ঘোষিত হেদায়াতের বাণী শোনার সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করে মহান আল্লাহ তাদেরকে দু’টি সুসংবাদ দেন। এর একটি হচ্ছে, কঠিন ও বিপদসংকুল পৃথিবীতে তাদেরকে হেদায়েতের পথ দেখিয়ে দেন এবং দ্বিতীয়ত তাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দেন।

যেকোনো সময় যেকোনো ভুল করে বসা ও পদস্খলন ঘটা মানুষের জন্য স্বাভাবিক একটি বিষয়। পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়সহ যেকোনো বিষয়ে সঠিক পথ বেছে নেয়া মানুষের জন্য সহজ কাজ নয়। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক পথ অন্বেষণের জন্য মানুষ আল্লাহর সাহায্যের মুখাপেক্ষী।

আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে সেই সঠিক পথটি বাতলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শুধুমাত্র তাদেরকে যারা প্রাথমিক হেদায়েতের পথ বেছে নেয়। অর্থাৎ যারা আল্লাহর যেকোনো হুকুম-আহকামের সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনের মানসিকতা দেখায় তারাই আল্লাহর সাহায্য পায়।  অবশ্য হেদায়েত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের পবিত্রতা অর্জনও জরুরি। পবিত্র আত্মার অধিকারী হতে পারলেই মানুষের পক্ষে হিংসা, অহংকার, রেষারেষি ও কৃপণতার মতো মন্দ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হতে মুক্ত থেকে সঠিক পথে চলা সম্ভব।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- সত্যের বাণী শোনার সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করলে আল্লাহ তায়ালার হেদায়েত লাভ করার পথ খুলে যায়।

২- হেদায়েত গ্রহণ করলে মানুষের অভ্যন্তরীণ ধারণক্ষমতা বেড়ে যায়।

৩- একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়েতপ্রাপ্তির মাধ্যমেই পবিত্র আত্মার অধিকারী হওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্ম কিংবা হিন্দুত্ববাদের মতো মানবরচিত মতবাদ কখনোই মানুষের অন্তরকে কলুষমুক্ত করতে পারে না।

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ