ডিসেম্বর ০৪, ২০২১ ১৮:২২ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা মুহাম্মাদের ৪নং পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ১৮ থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

فَهَلْ یَنْظُرُونَ إِلا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِیَهُمْ بَغْتَةً فَقَدْ جَاءَ أَشْرَاطُهَا فَأَنَّى لَهُمْ إِذَا جَاءَتْهُمْ ذِکْرَاهُمْ ﴿١٨﴾

“সুতরাং তারা কি শুধু এজন্যে অপেক্ষা করছে যে, কিয়ামত তাদের কাছে এসে পড়ুক আকস্মিকভাবে? অথচ কিয়ামতের লক্ষণসমূহ তো [এরইমধ্যে] এসেই পড়েছে! অতঃপর যখন [কিয়ামত] এসে পড়বে তখন উপদেশ গ্ৰহণে তাদের কি লাভ হবে?”(৪৭:১৮)

গত আসরে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছিল যারা দম্ভ এবং ঠাট্টা ও অবজ্ঞাভরে আল্লাহর নবীদের সঙ্গে কথা বলত। এরপর এই আয়াতে পরকাল অস্বীকারকারী কাফিরদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যারা বলে: যতক্ষণ নিজের চোখে কিয়ামত না দেখব ততক্ষণ তাতে বিশ্বাস স্থাপন করব না। অথচ কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার দলিল-প্রমাণ তাদের চোখের সামনে বিদ্যমান।

তারা যদি সত্য গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকত তাহলে কিয়ামত চোখে না দেখেই তারা এসব দলিল-প্রমাণ উপলব্ধি করে তার প্রতি ঈমান আনত। তারা যদি এখন ঈমান না আনে তাহলে কিয়ামত চোখে দেখার পর তাতে ঈমান আনলে সে ঈমানে তাদের কোনো লাভ হবে না। এটি হচ্ছে সেই রোগীর উদাহরণ যার রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসক ওষুধ দেয়ার পর তা খেতে অস্বীকার করে। সে বলে, যতক্ষণ মৃত্যু চোখে না দেখব ততক্ষণ আমি বিশ্বাস করব না যে, আমার চিকিৎসা প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যক্তির মৃত্যু এসে গেলে আর কোনো চিকিৎসকই তাকে বাঁচাতে পারবে না।

এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- জিদ ও একগুঁয়েমির কারণে কাফিররা তওবা করা ও আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ হাতছাড়া করে। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সময় ও সুযোগকে পায়ে ঠেলে নিজেদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে।

২- কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার প্রচুর বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল আমাদের চোখের সামনে বিদ্যমান। এগুলো উপলব্ধি করার জন্য ঔদ্ধত্ব বাদ দিয়ে বিনয়ী অন্তরের অধিকারী হতে হবে।

সূরা মুহাম্মাদের ১৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِکَ وَلِلْمُؤْمِنِینَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَاللَّهُ یَعْلَمُ مُتَقَلَّبَکُمْ وَمَثْوَاکُمْ ﴿١٩﴾

“জেনে রাখুন যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই।  আর ক্ষমা প্রার্থনা করুন আপনার ও মুমিন নর-নারীদের ত্রুটির জন্য।  আর আল্লাহ্ তোমাদের গতিবিধি এবং অবস্থান সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।” (৪৭:১৯)

কাফিরদের গোঁয়ার্তুমি ও জেদের বিপরীতে এই আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)কে উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন: আপনি আপনার পথে অটল ও অবিচল থাকুন এবং জেনে রাখুন, এক আল্লাহর ইচ্ছাশক্তি ছাড়া এই বিশ্বজগতের ওপর অন্য কোনো শক্তির কার্যকারিতা নেই। আল্লাহকে কেউ অক্ষম করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। কাজেই সর্বাবস্থায় তাঁর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করুন এবং তার ওপর ভরসা করুন। শত্রুদের সংখ্যাধিক্য যেন আপনাকে সন্ত্রস্ত না করে।  আয়াতের পরবর্তী অংশে ঈমানদারদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে, তারা যেন তাকওয়া বা খোদাভীরুতা অবলম্বন করে এবং যখনই কোনো গোনাহ বা ভুল করে ফেলে তখনই যেন আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়।

মহানবী (সা.) নিজের জন্য এবং মুমিন বান্দাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন অর্থাৎ তওবা-ইস্তেগফার করতেন। নবী-রাসূলগণ সব ধরনের গোনাহ থেকে পবিত্র। এখানে রাসূলকে ইস্তেগফার করার যে আহ্বান জানানো হয়েছে তার উদ্দেশ্য গোনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা নয়; বরং এখানে মহান আল্লাহর সামনে রাসূলের বিনয় ও আনুগত্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি আল্লাহ তায়ালার সামনে এতটা বিনয়ী ও অনুগত ছিলেন যে, সব সময় তাঁর মনে হতো, না জানি তাঁর কোনো ভুল হয়ে গেছে।

প্রকৃতপক্ষে রিসালাত এমন একটি মহান ও গুরুদায়িত্ব যে, নবী-রাসূলগণ সব সময় মনে করতেন তাঁরা বুঝি তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারলেন না। এ কারণে তাঁরা কখনও মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া এবং জিহাদ ও সংগ্রাম থেকে বিরত থাকেননি। নবী-রাসূলগণ কখনওই রিসালাতের দায়িত্ব পালন কিংবা আল্লাহর ইবাদত করার ক্ষেত্রে আত্মতুষ্টিতে ভোগেননি।  ঠিক এ কারণেই শুধু আমাদের নবী নন বরং অতীতের সব নবী-রাসূল সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহর কাছে তওবা-ইস্তেগফার করার কথা বর্ণনা করা হয়েছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আমাদের প্রতিটি কথা ও কাজে এক আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল হওয়া উচিত। তাহলে আমরা অন্য সব শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারব।

২- এই আয়াত অনুযায়ী, রাসূলে আকরাম (সা.) যে তওবা-ইস্তেগফার করেছেন  প্রতিটি ঈমানদার নারী ও পুরুষ তার অন্তর্ভুক্ত। তিনি মানুষকে হিদায়েতের দাওয়াত দেয়ার পাশাপাশি তাদের অন্তরের পবিত্রতার জন্য আল্লাহ তায়ালার সাহায্য চেয়েছেন।

৩- অন্যান্য মানুষের মতো নবী-রাসূলগণও মানবীয় গুণাবলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেই সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তাঁরাও মহান আল্লাহর দয়ার মুখাপেক্ষী ছিলেন।

সূরা মুহাম্মাদের ২০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَیَقُولُ الَّذِینَ آمَنُوا لَوْلا نُزِّلَتْ سُورَةٌ فَإِذَا أُنْزِلَتْ سُورَةٌ مُحْکَمَةٌ وَذُکِرَ فِیهَا الْقِتَالُ رَأَیْتَ الَّذِینَ فِی قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ یَنْظُرُونَ إِلَیْکَ نَظَرَ الْمَغْشِیِّ عَلَیْهِ مِنَ الْمَوْتِ فَأَوْلَى لَهُمْ ﴿٢٠﴾

“আর যারা ঈমান এনেছে তারা বলে, [জিহাদ করার জন্য] একটি সূরা নাযিল হয় না কেন? অতঃপর যদি দ্ব্যর্থবোধক ও সুস্পষ্ট মর্মবিশিষ্ট কোন সূরা নাযিল হয় এবং তাতে যুদ্ধের কোন নির্দেশ থাকে আপনি দেখবেন যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা মৃত্যুভয়ে মুর্ছা যাওয়া মানুষের মতো আপনার দিকে তাকাচ্ছে।  সুতরাং তাদের জন্য ওই মৃত্যুই উত্তম।”(৪৭:২০)

এই আয়াতে ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কঠিন পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হচ্ছে: শত্রুদের পক্ষ থেকে এত বেশি হুমকি আসছিল যে, মুমিনগণ রাসূলের কাছে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি চাচ্ছিলেন। তারা বলছিলেন: যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে কোনো আয়াত নাজিল হচ্ছে না কেন? কিন্তু যখন কোনো কোনো সূরা নাজিল করে আল্লাহ তায়ালা কাফিরদের মোকাবিলা করার নির্দেশ দেন তখন যুদ্ধের দাবিদারদের কেউ কেউ পিছু হটে গিয়েছিল এবং ভয়ে তাদের চোখ উল্টে গিয়েছিল। দুর্বল ঈমানের অধিকারী ও রোগাক্রান্ত অন্তরবিশিষ্ট এসব মানুষ যুদ্ধে যাওয়ার আগেই মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। অথচ প্রকৃত মুমিন কখনও এমন হয় না বরং তারা সর্বদা জিহাদে যাওয়ার এবং প্রয়োজনে শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

১- অনেকেই মুমিন-মুসলমান হওয়ার দাবি করতে পারে। কিন্তু জিহাদের ময়দানেই মুনাফিকদের থেকে প্রকৃত মুমিনদের আলাদা করে ফেলা যায়।

২- ইসলাম রহমতের ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও জালিম ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে জিহাদ করার নির্দেশ দিয়েছে।

৩- জিহাদ করতে ভয় পাওয়া এবং জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া দুর্বল ঈমান, এমনকি মুনাফেকির লক্ষণ।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ