ডিসেম্বর ০৯, ২০২১ ১৫:১৭ Asia/Dhaka

দুই শতাব্দী আগেও পাশ্চাত্য-সমাজে লাইফ স্টাইল পরিভাষাটির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বর্তমান সমাজে সবচেয়ে ব্যবহৃত পরিভাষাগুলোর তালিকা করলে লাইফ স্টাইল পরিভাষাটি এই তালিকার সামনের দিকে স্থান পাবে।

লাইফ স্টাইল এখন গোটা বিশ্বের সমাজ বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হলো এটি সব মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। লাইফ স্টাইল হচ্ছে, মানুষের খাদ্য তালিকা থেকে শুরু করে সামাজিক সম্পর্ক ও আচরণের অন্তর্ভুক্ত। টেকনোলোজি বা প্রযুক্তি হচ্ছে আরেকটি নয়া বিষয় যা গত কয়েক দশক ধরে ব্যাপকভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতিও হচ্ছে ক্ষিপ্র গতিতে। প্রায় সব কিছুই এখন শিল্প ও কারখানা নির্ভর হয়ে পড়েছে। এর ফলে উন্নয়নের সমার্থক হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও অগ্রগতি।

প্রযুক্তিগত উন্নতি ও অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অর্থও পাল্টে যাচ্ছে। গণমাধ্যম ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রভাব মানুষের লাইফ স্টাইলকেও প্রভাবিত করছে। প্রযুক্তি মানুষের সেবায় নিযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি মানুষের ওপর নিজেকে চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও রাখে। প্রযুক্তির উন্নয়নের ক্ষিপ্র গতির কারণে একটা সময় পর্যন্ত এর নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। কিন্তু এখন পাশ্চাত্যে এই প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এমন বিজ্ঞ সমালোচকদের একজন হলেন মার্কিন লেখক নিল পোস্টম্যান। তিনি প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব ও দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়েই সে বিষয়ে মাতামাতি করার বিপক্ষে। এর ক্ষতিকারক দিকগুলোকেও গুরুত্ব দিতে বলেছেন তিনি। বর্তমান যুগের আরেকটি পরিভাষা হচ্ছে ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগত। যোগাযোগের নয়া প্রযুক্তি নির্ভর বর্তমান যুগের লাইফ স্টাইলের সঙ্গে এই পরিভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আকর্ষণীয় কিন্তু অস্পষ্ট এ জগতকে সেকেন্ড লাইফ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয়।

ভার্চুয়াল জগত এখন অনেকের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা যখন ইমেইল পড়ি অথবা ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে কথা বলি তখন আমরা ভার্চুয়াল জগতে অবস্থান করি। এই জগতে ইচ্ছে করলে নিজেকে আলাদা এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব। এটাকে নিজের ভার্চুয়াল পারসোনালিটি হিসেবেও আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এখানে নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। এটা অনস্বীকার্য যে, ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগত মানুষের জীবনযাপনকে সহজ করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর সুবাদে তথ্য সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। নানা ক্ষেত্রে ব্যায় কমেছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণ অনেক বেশি সহজ ও সূক্ষ্ম হয়েছে। তবে ভার্চুয়াল জগতকে ব্যবহার করে নানা অপকর্মও ঘটছে। বেআইনি ধ্বংসাত্মক তৎপরতার ধরণে পরিবর্তন এসেছে। মাদক, বিস্ফোরক, আগ্নেয়াস্ত্রের অবৈধ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে এই ভার্চুয়াল জগতকে কেন্দ্র করে।

শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বয়সীদের কুপথে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এই জগতে সহজেই নিজের পরিচয় গোপন করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, সমাজে সব সময় কিছু মানুষ থাকে যারা অপরাধ-প্রবণ হয়। ভার্চুয়াল জগত তাদের অপরাধ করার পথকে সহজ করে দিয়েছে। এ ধরণের মানুষ নিজের পরিচয় গোপন করে সমাজবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারছে। এই জগতকে ব্যবহার করে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। এর আগে ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে চার হাজারের বেশি। এরপর ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে অর্থাৎ এমন ঘটনা ঘটেছে ৮ হাজারের বেশি। প্রতিদিন গড়ে ২২টি এমন ঘটনা ঘটেছে।  শিশুদের প্রতি নৃশংসতা মোকাবেলা বিষয়ক ব্রিটিশ সংস্থা এনএসপিসিসি'র নির্বাহী পরিচালক পিটার ওয়ানলেস বলেছেন, প্রতিটি ঘটনা শিশুর জন্য ভয়াবহ কষ্টের কারণ হয়েছে। আর এই পরিসংখ্যান বাস্তবতার ছিটেফোঁটা মাত্র। 

অনেক শিশু-কিশোরই এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। অনেকেই ভার্চুয়াল জগতে এমন সব গেম খেলছে যা তাদের মন-মানসিকতার ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলছে। ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ শহরে দু'টি মসজিদে যে স্টাইলে হামলা চালানো হয়েছে তা ছিল ভার্চুয়াল গেইমের অনুকরণ। হামলাকারী ঐ হামলার দৃশ্য সরাসরি অনলাইনে প্রচার করেছে। টুইটার ও ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তা সরাসরি দেখতে পেয়েছেন। এরপর বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কম্পিউটার গেইমের প্রভাবেই এমন হামলা চালিয়েছে বর্ণবাদী অস্ট্রেলীয় জঙ্গি ব্রেন্টন ট্যারান্ট।  কম্পিউটার বা ভিডিও-গেম, শিশু-কিশোর এমনকি বড়দের কাছেও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর কারণ হলো এসবে রয়েছে খেলার নানা ধরনের নিয়মের মধ্যে ইচ্ছামত বিভিন্ন নিয়ম বেছে নেয়ার ব্যবস্থা ও এইসব নিয়মের ব্যাখ্যাগুলো বোঝার ব্যবস্থা, কাল্পনিক বীর নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ ও এমনকি নায়কের সক্ষমতার পরীক্ষায় নম্বর দেয়ারও ব্যবস্থার মত আকর্ষণীয় নানা দিক!

কম্পিউটার-ভিত্তিক এইসব গেম শিশু-কিশোরদের নানা ধরনের জ্ঞান দিচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তারা ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতিসহ অন্য অনেক বিষয়ে বিশেষ চিন্তাধারা ও তথ্যের মুখোমুখি হচ্ছে। অন্য কথায় শিশুদের মন-মগজকে বিশেষ কিছু দিকে অথবা মতবাদে আকৃষ্ট করার বা মগজ ধোলাই করার ব্যবস্থাও রয়েছে এইসব ভিডিও গেমে। ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগত ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এখন এই প্রযুক্তি প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। তারা মোবাইলের মাধ্যমে সহজেই এই জগতে প্রবেশ করছে। এই জগত তাদের অজান্তেই লাইফ স্টাইল বা জীবন প্রণালীর ওপর প্রভাব ফেলছে। এছাড়া এই জগতে প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছে লাখ লাখ শিশু। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের ২০১৮ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতিদিন ১ লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি বা প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু প্রথমবারের মতো অনলাইন জগতে প্রবেশ করে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থাটির মতে, ডিজিটাল দুনিয়ায় এই প্রবেশ তাদের সামনে উপকার ও সুযোগের বিশাল দ্বার উন্মোচন করে। তবে একই সঙ্গে তাদের ঝুঁকি ও ক্ষতির মুখেও ফেলে, যার মধ্যে রয়েছে ক্ষতিকর আধেয় বা কনটেন্ট, যৌন হয়রানি ও শোষণ, সাইবার উৎপীড়ন ও তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার।

শিশু-কিশোরসহ সব মানুষের লাইফ স্টাইলের ওপরই এই জগত প্রভাব ফেলছে। এর একটি নেতিবাচক প্রভাব এখন গোটা বিশ্বেই আলোচিত হচ্ছে। আর তাহলো মানুষের পরস্পরের মধ্যে বাস্তব যোগাযোগ ও সম্পর্ক হ্রাস।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ