আসমাউল হুসনা (পর্ব-৫২)
দয়াময় আল্লাহর আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হ'ল ওয়াকিল। ওয়াকিল এমন এক ব্যক্তি যার ওপর সব কিছু অর্পণ করা হয় ও তিনি সব কিছুকেই সামাল দিতে বা সুসম্পন্ন করতে সক্ষম।
আরবি ভাষায় ওয়াকিল শব্দটিকে- কর্তা ও কর্ম- এ দুই অর্থেই ব্যবহার করা যায়। কর্তা অর্থে সংরক্ষক বা অভিভাবক অথবা দেখাশুনাকারী এবং কর্ম অর্থে বিশ্বস্ত বা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির কাছে কাজ বা নানা বিষয় অর্পণ করাকে বোঝায়।
মহান আল্লাহ হচ্ছেন সব বিষয়কে শুভ পরিণতি দান করতে সক্ষম সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও সর্বোত্তম অভিভাবক। সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ এমন এক সত্ত্বা যার কোনো মৃত্যু বা ধ্বংস নেই তাই সব সময়ই তাঁর ওপর নির্দ্বিধায় নির্ভর করা যায়। একজন ভালো ওয়াকিল বা অভিভাবককে সব ধরনের জ্ঞান রাখতে হয় ও সবকিছু জানতে হয়। আর মহান আল্লাহই হচ্ছেন সর্বজ্ঞানী ও সব গোপন বিষয়ও তাঁর কাছে স্পষ্ট। মহান আল্লাহর জ্ঞান পরিপূর্ণ ও তাতে কোনো ত্রুটি নেই। তিনি জানেন মানুষের কি কি চাহিদা ও সেসব পূরণের পথে বাধাগুলো সম্পর্কেও তিনি অবহিত। তাই সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর অসীম ক্ষমতা ও জ্ঞানের কারণে অভিভাবকত্বের কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম।
আল্লাহ ছাড়া অন্যদের ক্ষমতা, জ্ঞান ও অস্তিত্ব সসীম এবং নানা ত্রুটিযুক্ত বলে তারা চিরস্থায়ী ও সর্বোত্তম বা নির্ভরযোগ্য ওয়াকিল বা অভিভাবক হতে সক্ষম নন। সুরা আসরার ৬৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহকে সহায়তা ও সুরক্ষা দেয়ার জন্য সর্বোত্তম বা যথেষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ওয়াকিল শব্দটি ২৪ বার এসেছে। এই শব্দগুলোতে মহান আল্লাহকেই একমাত্র ও প্রকৃত অভিভাবক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হওয়া সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাঁকে মানুষের প্রকৃত অভিভাবক বলে উল্লেখ করেননি। যেমন সুরা আসরার ৫৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞাত আছেন। তিনি যদি চান, তোমাদের প্রতি রহমত করবেন কিংবা যদি চান, তোমাদের আযাব দিবেন। হে নবী!আমি আপনাকে ওদের সবার কার্যকর ওয়াকিল বা তত্ত্বাবধায়করূপে প্রেরণ করিনি। - এখানে এটাই বলা হয়েছে যে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়া কেউই স্বাধীনভাবে অন্যদের ওয়াকিল বা নির্ভরতার আশ্রয় হতে পারে না, তবে আল্লাহ যদি কাউকে কোনো বিষয়ে সাময়িকভাবে কোনো কোনো কাজের জন্য অভিভাবক নিয়োগ করেন সেটা ভিন্ন কথা।
ওয়াকিল শব্দের মূল 'ওয়াকালা' অর্থ কারো ওপর নির্ভর করা ও নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করা। ভরসা করার অর্থে ব্যবহৃত তাওয়াক্কুল শব্দটিও এসেছে এই একই মূল থেকে। তাওয়াক্কুল-এর অর্থ হল কাউকে ওয়াকিল হিসেবে মেনে নেয়া ও তার ওপর ভরসা করা। দুর্বল মানুষ নানা অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে একে-অপরের প্রকৃত ওয়াকিল হতে পারে না। তাই মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করা এবং তাঁরই কাছে অক্ষমতা প্রকাশই হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করা প্রসঙ্গে সুরা ত্বালাক্বের তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে: যে কেউ মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। - এই আয়াতের আগে আরও বলা হয়েছে: যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন। এরপর ওই তৃতীয় আয়াতেরই একাংশে মহান আল্লাহ বলেছেন: এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন।
মহানবীর (সা) মতে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করা বা তাওয়াক্কুল করা মানে- কারো ক্ষতি করা, দান করা ও বঞ্চিত করা এসব মানুষের হাতে নেই এবং এসব বিষয়ে মানুষের ওপর ভরসা করা উচিত নয়। কোনো মানুষ যদি এমন জ্ঞানী হন যে আল্লাহ ছাড়া আর কারো সন্তুষ্টির জন্য কোনো কিছু করেন না ও আল্লাহ ছাড়া কারো ওপর আশাবাদী হন না, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেই ভয় পান না এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশাও করেন না তিনিই হচ্ছে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলকারী বা ভরসাকারী।
মহান আল্লাহর ওয়াকিল বা অভিভাবক হওয়া বলতে সৃষ্টিকুলের সব কিছু পরিচালনাও বোঝায়। তিনি সব কিছুরই মালিক ও সব কিছু তাঁর দিকেই ফিরে যায়। সব কিছুর পরিচালনা তাঁরই হাতে। প্রকাশ্য ও গোপন সব কিছুই তিনি জানেন। তাই তিনি তার ওপর ভরসাকারীদের স্বার্থ সর্বোত্তম উপায়ে ও সর্বোচ্চ মাত্রায় পূরণ করেন এবং তাদেরকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন। সব কিছুর মূল নিয়ন্ত্রণ মহান আল্লাহরই হাতে রয়েছে।
আল্লাহর ওপর প্রকৃত ভরসাকারী বা তাওয়াক্কুলকারী নিজের দায়িত্ব পালনে কখনও অবহেলা করেন না। তিনি সব কিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেন না ও এমনটা ভাবেন না যে আল্লাহর ওপর মনে মনে ভরসা করেছি বলে আল্লাহই আমার সব কাজ করে দিবেন। বরং প্রকৃত তাওয়াক্কুলকারী তার নিজের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান ও তাতেও নিজের সমস্যার সমাধান না হলে বা বাধাগুলো দূর না হলেও ভয় পান না। এ অবস্থায়ও তিনি আল্লাহর অসীম ক্ষমতার ওপর ভরসা রেখে প্রচেষ্টা চালিয়ে যান এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। এমনকি যেসব ক্ষেত্রে তার সক্ষমতা রয়েছে সেসব ক্ষেত্রেও নিজেকে আল্লাহর দয়ার মুখাপেক্ষী মনে করে। কারণ সব ক্ষমতা তো আল্লাহর পক্ষ হতেই আসে। অন্য কথায় তাওয়াক্কুল হচ্ছে ইচ্ছাশক্তির এমন দৃঢ়তা যা তাকে হতাশ হয়ে যেতে ও প্রচেষ্টা থেকে দূরে সরে যেতে বাধা দেয় এবং তা তাকে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আরও আশাবাদী করে। সামাজিক বিষয়েও তাওয়াক্কুলের ভূমিকা রয়েছে।
এখন থেকে প্রায় দুই বছর আগে যখন করোনা মহামারী শুরু হয় তখন অনেকেই ভয়ানক আতঙ্ক ও পেরেশানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অন্যদিকে ইমান ও আধ্যাত্মিকতার আলোয় সমৃদ্ধ মানুষেরা আল্লাহর ওপর ভরসা করার পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলে প্রশান্ত থেকেছেন এবং এমনকি তাদের অনেকে করোনা রোগীদের সাহায্য করতে ছুটে গেছেন। এ ধরনের বিশ্বাসীরা কঠিন সংকটেও দ্বিধান্বিত হন না বরং মহান আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে তাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস জোরদার হয়। তারা কখনও নিজের ও অন্যের ওপর ভরসা করেন না। তারা সব ক্ষেত্রে অন্যদের ওপর নির্ভরতা বাদ দিয়ে কেবল আল্লাহকেই অভিভাবক বা ওয়াকিল মনে করেন। সুরা আলে ইমরানের ১৭৩ নম্বর আয়াতে এই শ্রেণীর মানুষেরই প্রশংসা করে বলা হয়েছে: যাদেরকে লোকেরা বলেছে যে, তোমাদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য লোকেরা সমাবেশ করেছে বহু সাজ-সরঞ্জাম; তাদের ভয় কর। তখন তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয় এবং তারা বলে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট; কতই না চমৎকার ও কার্যকর অভিভাবক বা ওয়াকিল তিনি।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।