ডিসেম্বর ২৩, ২০২১ ২০:৫৫ Asia/Dhaka

পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল ক্বাভিয়্যু বা ক্বাওয়িউ।

এর অর্থ অপরাজেয় এবং অক্ষমতা ও দুর্বলতা-মুক্ত,  চির-বিজয়ী, অক্লান্ত ও অন্যের সাহায্যের অমুখাপেক্ষী। পবিত্র কুরআনে এই শব্দ বা নাম তেরো বার এসেছে: সাত বার এসেছে মহান আল্লাহর আজিজ নামের পর এবং দুই বার এসেছে 'কঠিন শাস্তিদাতা' বা 'শাদিদুল ইক্বাব'  শীর্ষক বাক্যের পর ও একবার এসেছে প্রবল শক্তির অধিকারী বা মহাশক্তিধর অর্থে ব্যবহৃত 'শাদিদুল ক্বুউয়া' শীর্ষক বাক্যের পর। আর তিন বার এসেছে মহান আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার বিষয়টি তুলে ধরতে।-  ক্বাওয়ি বা ক্বাভি বলতে এমন কাউকে বোঝায় যিনি খুব সহজেই ও অন্যের সাহায্য ছাড়াই কাজ করেন। মহান আল্লাহ চির-বিজয়ী ও  তিনি কখনও পরাস্ত বা ব্যর্থ হন না। তিনি অন্যদের আশ্রয় দেন ও কারো আশ্রয়ের মুখাপেক্ষী নন।  মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও শক্তিগুলো নিরঙ্কুশ। অন্যদের যদি কিছু শক্তি থেকে থাকে তা তারা মহান আল্লাহ থেকেই পেয়েছেন তাঁরই দয়া বা অনুগ্রহের কারণে! তাই পবিত্র কুরআনের সুরা বাক্বারার ১৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: সব ক্ষমতা কেবল আল্লাহরই। 

একমাত্র আল্লাহই প্রকৃত সম্মান ও ক্ষমতার অধিকারী বলে তিনি ক্বাভি যদিও কাফির বা অবিশ্বাসীরা তা কখনও উপলব্ধি করে না। মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে সুরা হজের ৭৩ ও ৭৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন:  হে লোক সকল! একটি উপমা বর্ণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না, প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন। তারা আল্লাহর যথাযোগ্য মর্যাদা বোঝেনি। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্বাভি তথা মহাশক্তিধর ও আজিজ বা মহাপরাক্রমশীল।

ক্বাভি বলতে বোঝায় বলশালী ও শক্তিশালী। দীর্ঘ ও সুঠাম দেহের অধিকারী আদ জাতির লোকেরা দৈহিক শক্তির জন্য খ্যাতিমান ছিল। তারা প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। সমৃদ্ধ শহর ও নগর এবং সবুজ-শ্যামল বাগ-বাগিচা ও প্রান্তরের অধিকারী ছিল তারা। পবিত্র কুরআনে সুরা ফাজ্‌র-এর ৮ নম্বর আয়াতে এই জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে:  যাদের সমান শক্তি ও বলবীর্যে সারা বিশ্বের শহরগুলোতে কোন লোক হয়নি সৃজিত!

-কিন্তু তাদের এই শক্তিমত্তা দম্ভ ও সত্য থেকে বিচ্যুতির কারণ হয়েছিল। ফলে তারা নবীর বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং খোদায়ি নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করে। সুরা ফুসিলাতের ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:  যারা ছিল আদ, তারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে অহংকার করল এবং বলল, আমাদের চেয়ে শক্তিধর কে? তারা কি লক্ষ্য করেনি যে, যে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের চেয়ে বেশি শক্তিধর ? বস্তুত: এমন ধারণার কারণেই তারা সব সময় আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করত।

মহান আল্লাহর ক্বাভি নাম পবিত্র কুরআনে কয়েকবার 'আজিজ' ও 'শাদিদুল ইক্বাব' শব্দরাজির পর এসেছে। আজিজ হচ্ছে এমন বিজয়ী যাকে নতজানু করা বা হারানো অসম্ভব। আর 'শাদিদুল ইক্বাব' হচ্ছেন এমন কঠোর শাস্তিদাতা যার মোকাবেলায় সবাই অসহায় তথা কোনো সাহায্যকারী নেই। মহান আল্লাহ ক্বাভি বা অন্যান্য শক্তিধর বলেই  সমকামের মত জঘন্য পাপাচারে লিপ্ত লুত জাতির শহরকে পুরোপুরি উল্টো দিয়ে ধ্বংস করেছেন এবং পাপীদের ওপর পাথরের বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। ফিরআউনের জাতিও যখন পাপাচারের ক্ষেত্রে চরম সীমায় পৌঁছে তখন তারাও খোদায়ি শাস্তির উপযুক্ত হয় এবং মহান আল্লাহর নির্দেশে নিল্ দরিয়ার ঢেউ অতি অল্প সময়ের মধ্যে ফিরআউন ও তার দলবলকে ডুবিয়ে বিধ্বস্ত করে ও তাদেরকে সেখানকার মাছের খাদ্যে পরিণত করে। আদ জাতিও যখন দৈহিক শক্তির অহংকার নিয়ে আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে অস্বীকার করে তখন মহান আল্লাহ ঝড়ো হাওয়াকে নির্দেশ দেন যাতে তা শক্তিশালী ওই পাপী লোকগুলোকে এবং তাদের ঘরবাড়ি ও প্রাসাদগুলোকে খড়কুটার মত আকাশে উঠিয়ে নেয় ও বহু দূরে আছড়ে ফেলে।  

 আবরাহার সেনাদল যখন হস্তিবাহিনী নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংস করতে আসে তখন মহান আল্লাহর নির্দেশে ছোট ছোট পাখি ছোট ছোট নুড়ি-পাথর মুখে নিয়ে এসে হস্তিবাহিনীকে চর্বিত ঘাসের মত বিধ্বস্ত করে এবং এভাবে কাবার দিকে তাদের এগিয়ে আসার পদক্ষেপ বানচাল হয়ে যায়।

মহান আল্লাহ ক্বাভি বা মহাপরাক্রমশালী বলেই নুহ নবীর প্রতি তাঁর উম্মতের উপহাস ও যন্ত্রণা চরমে পৌঁছলে আল্লাহর নির্দেশে আকাশ থেকে প্রবল বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয় এবং ভূপৃষ্ঠ হতে প্রবল স্রোতধারাসহ নানা ঝর্ণা সৃষ্টি হয়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা পৃথিবী মহাপ্লাবনের শিকার হয় এবং নুহের কিশতিতে আশ্রয় নেয়া সৎকর্মশীল মুমিনরা অন্য সব মানুষ বিলুপ্ত হয়।  এ ধরনের কঠোর শাস্তির কথা যথাযোগ্যভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে মহান আল্লাহ কখনও কখনও নিজের ক্বাভি নাম ব্যবহার করেছেন কঠোর শাস্তিদাতা নামক বাক্যাংশের পর। যারা খুব সহজেই পাপে জড়িয়ে পড়ে ও মহান আল্লাহর দয়ার সুযোগ নিয়ে যখন তারা অহংকারী ও উদ্ধত হয়ে পড়ে তখন মহান আল্লাহ তাদের স্মরণ করিয়ে দেন যেন যে আল্লাহ সবচেয়ে দয়ালু হওয়া সত্ত্বেও শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রেও তিনি সবচেয়ে কঠোর!

মুমিন বা বিশ্বাসীরা এটা হৃদয়ঙ্গম করেন যে অতি মহান ও গৌরবময় আল্লাহর শক্তিমত্তা ছাড়া অন্য কারো কোনো শক্তি নেই। মানুষ যা কিছুই করে তা নিজের ইচ্ছায় করলেও মহান আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া শক্তি দিয়েই তা করতে সক্ষম হয়। লা হাওলা ওয়া লা কুউয়াতা ইল্লা বিল্লাহ তথা অতি মহান ও গৌরবময় আল্লাহর শক্তিমত্তা ছাড়া অন্য কারো কোনো শক্তি নেই- এ বাক্যের অর্থ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ইমাম বাক্বির -আ. বলেছেন: এর অর্থ হল আমাদের কোনো ক্ষমতা নেই পাপ বর্জনের ও আল্লাহর ইবাদতের যদি না আল্লাহ আমাদের সুযোগ দেন ও সাহায্য করেন।

মুমিন ব্যক্তি নিজের শরীরকে শক্তিশালী রাখার পাশাপাশি আত্মার দিকেও লক্ষ্য রাখেন ও ইমান বাড়াতে সচেষ্ট হন। মহান আল্লাহর ক্বাভি নামের রঙ্গে রঙিন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী -আ.'র হাত হতে খাইবারের যুদ্ধের তীব্রতার এক পর্যায়ে ঢাল পড়ে গেলে দুর্গের বিশাল দরজা উপড়ে নিয়ে লোহার সেই বিশাল দরজাকে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত ঢাল বা বর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। যুদ্ধ শেষ হলে সবচেয়ে শক্তিধর আট জন সেনা এসে ওই দরজাকে আগের জায়গায় নিতে আসেন। কিন্তু অত্যন্ত ভারি হওয়ায় তারা তা উঠাতে সক্ষম হননি।

অনেক বছর পর খাইবারের কামুস দুর্গের দরজার ওই ঘটনা প্রসঙ্গে সাহ্‌ল বিন হুনাইফ-কে লেখা এক চিঠিতে আমিরুল মু'মিনিন বলেছিলেন:  আল্লাহর কসম! আমি দৈহিক শক্তির বলে কামুস দুর্গের লোহার দরজাকে উঠাইনি ও তা বিশ মিটার দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেইনি বরং  এ কাজ করেছি আত্মিক ও মানসিক শক্তির বলে যা মহান প্রতিপালকের নুরে নুরান্বিত হয়েছিল।  শক্তিশালী মানুষ তাকেও বলা হয় যে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। হযরত আলী যখন খন্দকের যুদ্ধে কাফিরদের প্রধান বীর আমরু বিন আবদুদকে মল্ল যুদ্ধে পরাস্ত করে মাটিতে ফেলে দেন তখন মৃত্যুকে সুনিশ্চিত জেনে আমরু হযরত আলীর মুখে থুথু নিক্ষেপ করে। হযরত আলী তখন আমরুকে হত্যা করতে কিছুটা বিলম্ব করেন যাতে তার এই জিহাদে ব্যক্তিগত ক্রোধের কোনো রং না লাগে!#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।