ডিসেম্বর ২৬, ২০২১ ১৮:৫০ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা মহান আল্লাহ'র ক্বাভি বা ক্বাওয়ি নামের অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে কথা বলেছিলাম। শক্তিধর বা ক্ষমতাধর অর্থে এই নামের ব্যবহার রয়েছে।

মহান আল্লাহ হচ্ছেন নিরঙ্কুশ তথা পরিপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী এবং এই অর্থেই তিনি ক্বাভি। মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্দর নাম হল মাতিন যা অর্থের দিক থেকে ক্বাভি নামের কাছাকাছি। মহান আল্লাহ হচ্ছেন এমন মাতিন বা ক্ষমতাধর যাতে কোনো ত্রুটি বা পরিবর্তন নেই। প্রচণ্ডতা বা দৃঢ়তা, স্থায়িত্ব আর বিশালতার দিক থেকে মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও শক্তি হচ্ছে অসীম। আর মাতিন নাম এই ভাবগুলোও তুলে ধরে। মহান আল্লাহর কর্তৃত্ব ও রাজত্বের নেই কোনো ক্ষয় বা দুর্বলতা। মহান আল্লাহর শক্তিমত্তা ও ক্ষমতা পুরোপুরি তুলে ধরার মত কোনো বাক্য বা শব্দও কারো জানা নেই। মানুষের জ্ঞানের সীমায় আল্লাহর শক্তি সম্পর্কে যতটা ধারণা থাকা সম্ভব তিনি তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তির অধিকারী। তাই পরিপূর্ণ মানবীয় বুদ্ধিমত্তা ও বিবেকের অধিকারী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, আপনার প্রশংসা ও গুণের সুখ্যাতি যেভাবে করা উচিত সেই মাত্রায় প্রশংসা করতে আমি অক্ষম, তাই আপনার উপযুক্ত প্রশংসা কেবল আপনি নিজেই করতে সক্ষম। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) বলেছেন,

'প্রতিষ্ঠিত প্রশংসা আল্লাহর। তাঁর গুণরাজী কোন বর্ণনাকারী বর্ণনা করে শেষ করতে পারে না। তার নেয়ামতসমূহ গণনাকারীগণ গুনে শেষ করতে পারে না। প্রচেষ্টাকারীগণ তাঁর নেয়ামতের হক আদায় করতে পারে না। আমাদের সমুদয় প্রচেষ্টা ও জ্ঞান দ্বারা তাঁর পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা সম্ভব নয় এবং আমাদের সমগ্র বোধশক্তি দ্বারা তাঁর সত্ত্বা ও  মাহাত্ম্য অনুভব করা সম্ভব নয়। তাঁর পরিপূর্ণতাগুলো ও সিফাত বর্ণনার কোন পরিসীমা নির্ধারিত নেই এবং সেজন্য কোন লেখা বা বক্তব্য,কোন সময় বা স্থিতিকাল নির্দিষ্ট করা হয়নি।'

মাতিন শব্দটি বলতে অপরিবর্তনীয়, অকাট্য, সন্দেহাতীত, অক্ষয় বা স্থায়ীত্বকেও বোঝায়। মাতিন যা তাতে কোনো অসঙ্গতি নেই, নেই সন্দেহ  এবং তাতে অযৌক্তিক কিছু নেই বরং তা অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত। যা মাতিন তা লক্ষ্যহীনও নয়। যা মাতিন তাতে কোনো চরম পন্থা বা প্রান্তিকতা নেই: যেমন চরম শিথিলতা বা ঢিলেমি ও চরম কঠোরতা বা বাড়াবাড়ি -এসব না থাকা তথা কোনো এক বিশেষ দিকে বেশি ঝুঁকে না পড়া। বরং মাতিন ভারসাম্য বা মধ্যপন্থাকে তুলে ধরে।-

মাতিন মহান আল্লাহর অশেষ ক্ষমতাকে তুলে ধরে যে ক্ষমতায় নেই কোনো জোয়ার-ভাটা ও নেই কোনো ঘাটতি। মহান আল্লাহর ক্ষমতা, ইচ্ছা ও কর্তৃত্বের কাছে সব কিছুই নতজানু। মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও সহায়তা ছাড়া এবং নির্দেশ ও সাহায্য ছাড়া কোনো কিছুই সক্রিয় বা গতিশীল হতে পারে না। আল্লাহ যা চান না তা কখনও হবার নয় ও যা তিনি চান কেবল তা-ই হয় বা ঘটে। আকাশগুলো ও জমিনগুলো তিনি ছয় পর্যায়ে বা ছয় যুগে সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ও তাদেরকে মৃত করবেন ও আবারও জীবিত করবেন এবং এভাবে সব মানুষই তাঁর দিকে ফিরে আসবে।

মহান আল্লাহ মাতিন বলেই জমিনের সব কিছুরই জীবিকা দিয়ে থাকেন। পৃথিবীর বুকে যখন থেকে কোনো জীবনের অস্তিত্ব ছিল সেই আদি যুগ থেকে মহাপ্রলয় বা পুনরুত্থানের যুগ পর্যন্ত তিনি সৃষ্টিকুলকে রিজিক দিয়ে যাবেন অবিচ্ছিন্ন ধারায়! আর এই কাজে মহান আল্লাহর জন্য কোনো কষ্টবোধ, ক্লান্তি বা অভাব কিংবা কষ্টের অবস্থা দেখা দেয় না।

মাতিন শব্দটি পবিত্র কুরআনে তিন বার এসেছে। সুরা জারিয়াতের ৫৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ নিজের রাজ্জাক, জুল ক্বুউয়াত ও মাতিন নাম ব্যবহার করে বলেছেন:

আল্লাহ তা’আলাই তো জীবিকাদাতা, শক্তির আধার, পরাক্রান্ত।

 -এই তিন নাম পাশাপাশি ব্যবহার করে মহান আল্লাহ এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর কাছে এত পর্যাপ্ত ও বেশি রিজিক রয়েছে যে  রিজিক গ্রহীতাদের কাছে রিজিক পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো দুর্বলতা নেই ও রিজিকের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কেবলই আল্লাহর। মহান আল্লাহ এমনই শক্তিশালী যে কোনো কাজ বা কোনো কিছুই তাঁকে দুর্বল বা অক্ষম করে না। 

সুরা আরাফের ১৮৩ নম্বর ও সুরা কালামের ৪৫ নম্বর আয়াতেও মাতিন নামের ব্যবহার লক্ষণীয়: মহান আল্লাহর নিদর্শন অস্বীকারকারীদের উদ্দেশ করে আল্লাহ এ দুই আয়াতের একাংশে বলেছেন: বস্তুত: আমি তাদেরকে ঢিল দিয়ে থাকি। নিঃসন্দেহে আমার কৌশল সুনিপুণ। আর এ থেকে পালানোর উপায় কারোরই নেই।

আমি তাদেরকে সময় দেই। নিশ্চয় আমার কৌশল মজবুত।  

সুরা আরাফের ১৮২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: বস্তুত: যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে আমার আয়াতসমূহকে, আমি তাদেরকে ক্রমান্বয়ে পাকড়াও করব এমন জায়গা থেকে, যার সম্পর্কে তাদের ধারণাও হবে না।

-মহান আল্লাহ ক্ষমতা ও শক্তির জন্য সৃষ্টিকুলের মত খাদ্য, শারীরিক শক্তি ও শরীর-চর্চার বা বাইরের কোনো শক্তির মুখাপেক্ষী নন। মহান আল্লাহর শক্তি তাঁর সত্ত্বাগত। তাই তিনি কারো কাছে ঋণী নন এবং কেউ বিদ্রোহ করলে মহান আল্লাহর কঠোর শাস্তির শিকার হবে। অবশ্য মহান আল্লাহ পাপের শাস্তি তাৎক্ষণিকভাবে দেন না। তিনি পাপীদেরকেও দয়া দেখিয়ে সচেতন হওয়ার সুযোগ দেন। এরপরও পাপীরা দাম্ভিক হয়ে পাপকে তাদের অভ্যাসে পরিণত করলে মহান আল্লাহ তখন তাদের শাস্তি দেন।

মহানবীর (সা) হাদিসেও মাতিন শব্দ এসেছে। তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই পবিত্র কুরআন প্রকাশ্য নুর, সুদৃঢ় রজ্জু বা হাবলুল মাতিন, নির্ভরযোগ্য  সহায়তাকারী বা আশ্রয়, উচ্চতর ঘাঁটি ও সবচেয়ে ভালো সহায়তাকারী।

কেউ যদি সুদৃঢ় রজ্জু আঁকড়ে ধরে তাহলে তার পতন ঘটে না। অর্থাৎ জীবনে কুরআনের শিক্ষা ও নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করা হলে মানুষ বিভ্রান্তি ও ধ্বংস থেকে রক্ষা পাবে এবং সাফল্য ও সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। সুদৃঢ় রজ্জু বলতে এটাও বোঝায় যে কুরআন কখনও আল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, আর তাই তা শক্তিশালী বা সুদৃঢ় ।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে আঁকড়ে ধর ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।

কেবল মুমিন বা বিশ্বাসীরাই মহান আল্লাহর মাতিন নামের নুরে আলোকিত। তাদের ঈমান এতই মজবুত যে কোনো প্রলোভন বা ভয় তাদের ঈমানের সুদৃঢ় ইচ্ছার ওপর কর্তৃত্ব করতে ও তাদেরকে সত্য থেকে দূরে সরাতে পারে না। তারা নিজ লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থাকেন ও এ ক্ষেত্রে অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলেন কিন্তু তাদের ওপর অন্যরা কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না। তবে ইমানের এ পর্যায় এত উঁচু যে কঠোর সাধনা ছাড়া সবার জন্য তা অর্জন সহজ নয়।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।