স্বাস্থ্যকথা: হৃদরোগ-পর্ব ১
নীরব ঘাতক 'হৃদরোগ'
হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক এক নীরব ঘাতক। যেকোনো সময় যে কেউ হার্ট অ্যাটাকের শিকার হতে পারেন। ব্যয়াম না করা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ না করা এবং জীবনযাপনে অনিয়ম হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে থাকে। আমরা আজ হৃদরোগ নিয়ে কথা বলব।
শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করছি সবাই ভালো ও সুস্থ আছেন। তবে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে দেশে দেশে। তাই সবাই করোনার বিষয়ে সদা সতর্ক থাকবেন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন এ আহবান জানিয়ে আজকের আলোচনায় যাব।
ব্রেন স্ট্রোকের পর আমরা হৃদরোগ বা হার্টডিজিজ নিয়ে কয়েক পর্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাথে কথা বলব। আর এ বিষয়ে কথা বলবেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.মোহা. তাইফুর রহমান। বিশিষ্ট এই চিকিৎসক কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
ড. মো. তাইফুর রহমান রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
রেডিও তেহরান: ডা. তাইফুর রহমান, মানুষের রোগ বালাইয়ের অভাব নেই। তারমধ্যে হৃদরোগের কথা এখন প্রায়ই শোনা যায়। আর এই হৃদরোগ নিয়ে মানুষের ব্যাপক দুশ্চিন্তা রয়েছে। এই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণটাও সম্প্রতি অনেক বেশি। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই দেখা যায় কেউ না কেউ হার্টডিজেজ বা হৃদরোগে আক্রান্ত। তো আলোচনার শুরুতে জানতে চাইব হৃদরোগ বা হার্টের রোগ আসলে কি?
ডা.তাইফুর রহমান: ধন্যবাদ আপনাকে। হৃদরোগ বলতে আসলে হার্টের যতরকমের রোগ আছে সবগুলোকে বোঝানো হয়। তবে মূলত হৃদরোগ বলতে হার্টের নিজস্ব যে তিনটা রক্তনালী আছে সেই রক্তনালী দিয়ে রক্তপ্রবাহ হয়ে থাকে। কোনো কারণে যদি সেই রক্তনালীগুলোতে ব্লক হয়- আমরা জানি সেগুলোকে করোনারি আর্টাারিজ বলে। মেইন দুইটা রক্তনালী থাকে। একটা বামে এবং একটা ডানে। বাদিকের রক্তনালী আবার দুভাগে ভাগ হয়ে থাকে। তো এই যে রক্তনালীগুলোতে যদি চর্বি দলা বেধে যদি রক্তচলাচলে বাধার সৃষ্টি করে তখন সেটাকে আমরা বলি ইসকিমিক হার্টডিজিজ অথবা হার্টব্লক।
এ প্রসঙ্গে রক্তনালি সম্পর্কে একটু জানিয়ে রাখছি
হার্টের মাংসপেশিতে রক্ত সরবরাহের জন্য তিনটি বৃহৎ রক্তনালি বিদ্যমান থাকে। হার্টের সঙ্গে সংযুক্ত বৃহৎ রক্তনালি যার নাম এওর্টা। এই এওর্টা থেকে দুই পাশে দুটি রক্তনালি হার্টের মাংসপেশিকে রক্ত সরবরাহের জন্য সংযুক্ত করে থাকে।
একটির নাম ডান করোনারি রক্তনালি এবং বাম পাশ থেকে উৎপন্ন রক্তনালিকে বাম করোনারি রক্তনালি বলা হয়। বাম করোনারি রক্তনালি উত্পত্তিস্থল থেকে কয়েক সেন্টিমিটার অগ্রসর হয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়, যার একটির নাম LAD (লেফ্ট এন্টারিওর ডিসেঞ্জিং) এবং অন্যটি LCX (লেফ্ট সারকমপ্লেক্স রক্তনালি)।
RCA হার্টের ডান অংশকে রক্ত সরবরাহ করে থাকে, LAD হার্টের বাম পার্শ্বের সম্মুখ অংশে এবং LCX হার্টের বাম পার্শ্বের পিছনের অংশে রক্ত সরবরাহ করে থাকে। এ তিনটি রক্তনালিকে হার্টের রক্ত সরবরাহের প্রধান রক্তনালি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সাধারণ অবস্থায় এ তিনটি রক্তনালি হার্টের আলাদা আলাদা অংশে রক্ত সরবরাহ করে থাকে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় এ তিনটি রক্তনালির মধ্যে বড় মাপের কোনো ধরনের আন্তঃসংযোগ বিদ্যমান থাকে না, তবে ছোট ছোট রক্তনালি দ্বারা এদের মধ্যে আন্তঃসংযোগ বিদ্যমান থাকে এবং হার্টের রক্ত সরবরাহ ব্যাঘাতমুক্ত রাখতে প্রয়োজন মোতাবেক এসব ছোট ছোট আন্তঃসংযোগ আকারে বৃদ্ধি পেয়ে এক অংশ থেকে অন্য অংশে রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি করে থাকে। এমন অবস্থা ঘটে থাকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন ধরুন হার্টের কোনো একটি রক্তনালির শাখায় ব্লক সৃষ্টির ফলশ্রুতিতে ওই শাখা দ্বারা সরবরাহকৃত অংশে রক্তস্বল্পতা দেখা দিয়ে থাকে এবং এ ব্লক যখন ধীরে ধীরে বছরকে বছর ধরে বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন ওই শাখার রক্তনালির দ্বারা সরবরাহকৃত অংশে রক্তপ্রবাহের স্বল্পতা বা অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়।
এ অবস্থা অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হতে থাকে, ফলে হৃিপণ্ডের কম অক্সিজেনের সরবরাহকৃত অংশ ছোট ছোট রক্তনালির আকার বৃদ্ধি করে পার্শ্ববর্তী স্বাভাবিক সরবরাহকৃত অংশ থেকে রক্ত সরবরাহ গ্রহণ করতে থাকে। রক্তপ্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ছোট ছোট রক্তনালিগুলো সংখ্যায় ও আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে, এ জন্য এসব নতুন রক্তনালিগুলোকে ন্যাচারাল বাইপাস বলা হয়। এ ন্যাচারাল বাইপাস সৃষ্টি হওয়ার ফলশ্রুতিতেই এমনটা ঘটে থাকে যে, ৭০/৮০ বা ১০০% ব্লক নিয়েও অনেকে আংশিক বা সম্পূর্ণ সুস্থ জীবনধারণ করে থাকেন। কাজেই হৃিপণ্ডের রক্তনালি ব্লক পাওয়া মাত্র এমনটা চিন্তা করার কোনো কারণ নেই যে, রোগীর হার্টের রক্ত সরবরাহ খুবই কমে গেছে। কারণ ন্যাচারাল বাইপাস রক্তনালির মাধ্যমে সাধারণভাবে হৃিপণ্ডের অনেক অংশই রক্ত সরবরাহ পেয়ে থাকতে পারে। কারণ হৃিপণ্ডের ব্লক সৃষ্টি হওয়া কোনো পৃথক রোগ নয়, এটা সর্বাঙ্গের রক্তনালিতে ব্লক সৃষ্টি হওয়ার একটি অংশ মাত্র এবং হার্টেও রক্তনালিতে যখন ব্লক সৃষ্টি হয়, তখন একটা-দুটা বা তিনটা-চারটা ব্লক সৃষ্টি হয় না।
রেডিও তেহরান: ডা.তাইফুর রহমান, এই হার্টব্লক হলে কি হয়? একইসাথে জেনে নেব শতকরা কতভাগ ব্লক হলে তবে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং হার্টব্লক হলেই কি সেটাকে হার্ট অ্যাটাক বলা হয়?
ডা. তাইফুর রহমান: ব্লকটা যদি কোনো কারণে শতভাগ হয়ে যায় তখন কি হয়! হঠাৎ করে জমানো চর্বিগুলো ফেটে গেলে সেখানে রক্ত জমাট বাধে। জমাট বাধলে নালী পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এরফলে ঐ অংশটা পচে যেতে শুরু করে। আর পরিস্থিতিকে বলা হয় হার্টঅ্যাটাক। মেডিকেলের ভাষায় আমরা যেটাকে বলি মাওকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশান। শিরার মধ্যে রক্তের গতি বন্ধ হয়ে গেলেই এমনটা হয়। আমরা মূলত হৃদরোগ বলতে মূলত এটাকেই বেশি বুঝি। এটাই হচ্ছে ইমার্জেন্সি এবং এটাকে নিয়েই আমরা বেশি আতঙ্কিত থাকি।
জীবাণুঘটিত রোগ কমে আসছে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে একইসাথে হৃদরোগ বাড়ছে। একটা গবেষণায় এসেছে সারা পৃথিবীতে এক বছরে একশ’ছাব্বিশ মিলিয়ন মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে মারা গেছে ৯ মিলিয়ন মানুষ। আপনি যেকথা বলছিলেন যে প্রতিটি ঘরে কেউ না কেউ হার্টের ব্লকে আক্রান্ত। একথা সত্যি। একটা কথা বলে রাখি কিছু মানুষ নীরবে এই ব্লক বহন করে বেড়াচ্ছে। একটা বিষয় জেনে রাখি- সাধারণত বিশ বছরের পর থেকে রক্তনালিতে ব্লক সৃষ্টি হতে থাকে এবং দেখা যায় মধ্যবয়সী মানুষের মধ্যে প্রায়ই ব্লক থাকে অথচ তারা ধরতে পারেন না যে ব্লক আছে। অনেকেই হঠাৎ করে হার্টঅ্যাটাক হয়ে মারা যান।
রেডিও তেহরান: ডা.তাইফুর রহমান-আপনি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ- হৃদরোগ কি সে প্রসঙ্গে আপনি হার্টে ব্লকের কথা বলছিলেন এটি প্রায় প্রতিটি ঘরেই আছে। অনেকের হার্টে ব্লক আছে কিন্তু তিনি ধরতে পারছেন না কিংবা বুঝতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে করণীয় কি এবং এটি হওয়ার কারণগুলোও যদি বিষয়টি একটু বিস্তারিত আলোচনা করেন।
ডা. তাইফুর রহমান: আপনাকে ধন্যবাদ গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নের জন্য। দেখুন, আমাদের মধ্যে একটা আতঙ্ক আছে এই বুঝি আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। অনেক সময় দেখা যায় একজন তরুণ কিংবা তরুণী চিকিৎসকের কাছে এসে বলছেন তার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না? আসলে বুকে ব্যথা হলে ক্লারিফাই করা দরকার কোন ব্যথা হলে সেটা হার্টঅ্যাটাকে সাথে মিলে যায় আর কোনটা মেলে না।
আমাদের কাছে কোনো মানুষ যখন বুকে ব্যথা নিয়ে আসে তখন আমরা চিকিৎসকরা প্রথম যে চিন্তাটিা করি সেটি হচ্ছে এই রোগীর হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? যখন কোনো তরুণ বয়সের কেউ আসে বুকে ব্যথা নিয়ে তখন আমরা ধরেই নেই যে তার হার্টঅ্যা টাক হওয়ার সম্ভাবনা কম।
যদি নারী হয় সেক্ষেত্রে সাধারণত গড়ে ১৮ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত তার মাসিক হয়। সেই সময় স্ট্রোজেন নামক একটি হরমোন থাকে মহিলাদের সেটি তাদেরকে হৃদরোগ থেকে প্রোটেকশন দেয়। সেক্ষেত্রে আমরা ধরে নেই ব্যথা থাকলেও ঐ নারী হৃদরোগে আক্রান্ত না।
এরপর আমরা দেখি বয়স্ক মানুষ হয় এবং রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো থাকে যেমন ধরুন ডায়াবেটিস, প্রেশার আছে কি না, তার পারিবারিক রিস্কি ইসকিমিক হার্টডিজিস আছে কি না, তার লাইফ স্টাইল কেমন, খাওয়া দাওয়া কেমন, অতিরিক্ত ওজন আছে কি না এসব বিষয় মাথায় রেখে আমরা চিন্তা করি তার হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? তারপর পরীক্ষা করে থাকি তার ব্যথার ধরনটা কেমন? অনেকে বলে বুকে ব্যথা। আসলে ব্যথা নয়। অনেকটা বুকটা চেপে আসে। সে হাত দিয়ে চেপে ধরে থাকে। তার কাছে মনে হয় যেন একটা হাতির পা বুকের মধ্যে চেপে ধরেছে। হৃদরোগের ব্যথাটা ঠিক তেমনটাই হয়।
জনাব ডা. তাইফুর রহমান হৃদরোগ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আর শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! হৃদরোগ বিষয়ক আলোচনার প্রথম পর্বে হৃদরোগ কি, হার্টের ব্লক কি কেন হয় সে সম্পর্কে জানলেন এ বিষয়ে আগামী সপ্তায়ও আলোচনা হবে সে আসরেও আমাদের সঙ্গে থাকতে ভুলবেন না।
আপনাদের সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে স্বাস্থ্যকথার আজকের আসর এখানেই গুটিয়ে নিচ্ছি। সবাই ভালো থাকবেন।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৬