ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২ ১৭:৪৪ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা হুজুরাতের ৪নং ও শেষ পর্ব নিয়ে আলোচনা। সূরা হুজুরাতের সংক্ষিপ্ত তাফসির। মদীনায় অবতীর্ণ এই সূরায় মূলত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আচার-আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরায় বর্ণিত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করলে সমাজের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব শক্তিশালী হয় এবং না করলে পরস্পরে শত্রুতা, বিদ্বেষ, অমূলক সন্দেহ ও বিভেদ সৃষ্টি হয়। এই সূরার ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ (13)

“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, আর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পার।  নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তি বেশী মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে বেশী তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।”  (৪৯:১৩)

পৃথিবীর সব মানুষের চেহারা ও গায়ের রং যদি একই রকম হতো তাহলে তাদেরকে চেনা ও খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে যেত। পৃথিবীর মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার একটি বড় নেয়ামত হলো, তিনি মানুষকে বিভিন্ন বর্ণ ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন এবং তাদেরকে নানা ধরনের ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া, প্রতিটি সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদা চেহারা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এমনকি জমজ সন্তানও সব দিক দিয়ে পরস্পরের সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। দুই জমজ ভাইকে অপরিচিত মানুষের কাছে একই রকম মনে হতে পারে কিন্তু তাদের অভিভাবক বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন তাদেরকে ঠিকই আলাদা করে চিনতে পারে। এই আয়াতে শারিরীক ও বর্ণগত দিক দিয়ে মানুষে মানুষে পার্থক্যের বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: এই পার্থক্যের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষ যেন একে অপরকে চিনতে পারে এবং সামাজিক সম্পর্কসহ অন্যান্য বিষয়াদিতে পরস্পরের সঙ্গে মিশে না যায়।

অবশ্য কোনো কোনো বর্ণ বা জাতির লোকজন এই পার্থক্যের বিষয়টিকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব হিসেবে জাহির করতে চায়। অথচ এই আয়াতে বলা হচ্ছে: তোমরা সবাই এক পিতা ও মাতা থেকে এসেছ এবং তোমাদের সবার উৎস হচ্ছেন বাবা আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া সালামুল্লাহি আলাইহা। কাজেই এই বিষয়টি নিয়ে গর্ব করার কোনো সুযোগ নেই। শুধুমাত্র যে যত বেশি মুত্তাকি বা পরহেজগার আল্লাহ তায়ালার কাছে তার মর্যাদা তত বেশি।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- অনারবের ওপর আরবের কিংবা কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সবাই মানুষ এবং সবাই এক পিতা-মাতার সন্তান।

২- এক মানুষের সঙ্গে আরেক মানুষের বাহ্যিক পার্থক্য আল্লাহ তায়ালার প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তের কারণে হয়েছে। এর উদ্দেশ্য পরস্পরকে চিনতে পারা; গর্ব বা অহংকার করা নয়।

৩- বর্ণ, গোত্র, বংশ ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করার বিষয়টি ইসলাম নাকচ করে দিয়েছে। ইসলামে মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার একমাত্র মাণদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া বা খোদাভীতি।

সূরা হুজুরাতের  ১৪ ও ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

۞قَالَتِ ٱلۡأَعۡرَابُ ءَامَنَّاۖ قُل لَّمۡ تُؤۡمِنُواْ وَلَٰكِن قُولُوٓاْ أَسۡلَمۡنَا وَلَمَّا يَدۡخُلِ ٱلۡإِيمَٰنُ فِي قُلُوبِكُمۡۖ وَإِن تُطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَا يَلِتۡكُم مِّنۡ أَعۡمَٰلِكُمۡ شَيۡ‍ًٔاۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٌ (14) إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمۡ يَرۡتَابُواْ وَجَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ (15)

“আরবের বেদুঈনরা বলে, আমরা ঈমান আনলাম। তাদের বলুন, তোমরা ঈমান আননি, বরং তোমরা বল, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, কারণ ঈমান এখনো তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর তবে তিনি তোমাদের আমলসমূহের [পুরস্কার] সামান্য পরিমাণও লাঘব করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”  (৪৯:১৪)

“শুধুমাত্র তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করেনি এবং তাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই [তাদের ঈমানের দাবিতে] সত্যনিষ্ঠ।” (৪৯:১৫)

এই দুই আয়াতে ঈমানের দাবিদার সেসব মানুষের কথা বলা হচ্ছে যারা বলে: আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং এ বিষয়টিকে অন্যের ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ বলে মনে করছি। কিন্তু পবিত্র কুরআন বলছে, তারা মুখে নিজেদের ঈমানদার বলে দাবি করলেও কার্যত তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করেনি। অথচ ঈমান ও আমল পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং একটি ছাড়া আরেকটি অর্থহীন।

এরপর মানুষের অন্তরে ঈমানের প্রভাবের দু’টি লক্ষণ উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, প্রকৃত মুমিন হচ্ছেন তিনি যিনি আল্লাহর অস্তিত্বের ব্যাপারে অন্তরে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করেন না। মুমিনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো- পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য তারা নিজেদের জীবন ও সম্পদ ব্যয় করে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- যে ব্যক্তি নিজেকে ধার্মিক দাবি করে কিন্তু তার কাজকর্ম আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী হয় না সে পার্থিব জীবনে মুসলমান হিসেবে পরিচিতি পেলেও কিয়ামতের দিন এই দাবি তাদের কোনো কাজে আসবে না।

২- মুখে যে যা-ই বলুক, ঈমানের স্থান হচ্ছে মানুষের অন্তর। আর ঈমানদার হওয়ার জন্য মৌখিক দাবি যথেষ্ট নয় বরং কাজে ঈমানদারির প্রমাণ দিতে হবে। অন্য কথায় মানুষের অন্তরে যা কিছু আছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের ক্রিয়াকলাপে।

৩- পবিত্র কুরআনের বাণীর পাশাপাশি আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ পালন করাও মুমিন মুসলমানদের জন্য অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।

৪- যারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি করে তাদের দাবির সত্যতা প্রমাণের অন্যতম মাধ্যম আল্লাহর দ্বীন রক্ষার জন্য জিহাদে অংশ নেওয়া।

সূরা হুজুরাতের ১৬ থেকে ১৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

قُلۡ أَتُعَلِّمُونَ ٱللَّهَ بِدِينِكُمۡ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۚ وَٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٞ (16) يَمُنُّونَ عَلَيۡكَ أَنۡ أَسۡلَمُواْۖ قُل لَّا تَمُنُّواْ عَلَيَّ إِسۡلَٰمَكُمۖ بَلِ ٱللَّهُ يَمُنُّ عَلَيۡكُمۡ أَنۡ هَدَىٰكُمۡ لِلۡإِيمَٰنِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ (17) إِنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ غَيۡبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۚ وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ (18)

“বলুন, তোমরা কি তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে আল্লাহকে অবগত করাচ্ছ? অথচ আল্লাহ জানেন যা কিছু আছে আসমানসমূহে এবং যা কিছু আছে যমীনে। আর আল্লাহ্ সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।”  (৪৯:১৬)

“তারা ইসলাম গ্রহণ করে আপনাকে ধন্য করেছে বলে ভাব দেখায়। বলুন, তোমরা ইসলাম গ্ৰহণ করে আমাকে ধন্য করেছ বলে মনে করো না, বরং আল্লাহই ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, যদি তোমরা [তোমাদের দাবির ব্যাপারে] সত্যবাদী হও।”  (৪৯:১৭)

“নিশ্চয় আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন।”  (৪৯:১৮)

ইসলামের প্রাথমিক যুগে কিছু মানুষ রাসূলুল্লাহ (সা.)কে খোটা দিয়ে বলত: আমরা ছিলাম বলে আপনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং আপনাকে সহযোগিতা করেছি। পবিত্র কুরআনে এ ধরনের মানুষকে উদ্দেশ করে বলছে: তোমরা এ কেমন ধরনের উদ্ভট কথা বলছ? আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলই বরং তোমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন এবং অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে তোমাদেরকে ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন।  তাছাড়া, তোমরা যদি তোমাদের দাবিতে একনিষ্ঠ হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহর রাসূলকে খোটা দিও না।  কারণ, আসমান ও জমিনের সমস্ত গোপন রহস্য যে আল্লাহর জানা তিনি তোমাদের অন্তরের খবরও জানেন। তোমরা কতটুকু ঈমান এনেছো তা তিনি ভালো করে অবগত আছেন।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- ঈমান ও সৎকর্মের ব্যাপারে আমাদের আচরণ যেন এমন না হয় যে, আমরা আল্লাহ ও তার রাসূলকে ধন্য করে ফেলেছি। কারণ, তাঁরা আমাদের ঈমান আনার মুখাপেক্ষী নন। বরং আমাদেরকে সৎপথ প্রদর্শন করার মাধ্যমে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই আমাদেরকে ধন্য করেছেন।

২- মুসলিম সমাজে আমাদেরকে ঈমানের দাবিদারদের দাবির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, তাদের একাংশের মৌখিক দাবি সত্য নয়।

৩- আসমান ও জমিনে এমন অনেক গোপন বিষয় রয়েছে যার অস্তিত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারো জানা নেই।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ